তিন মাস হল প্রণয় ও অনুসূয়ার পরিবারে নতুন সদস্য এসেছে। ছোট্ট চিকুবাবু। কিন্তু চিকুবাবুকে নিয়ে তার বাবা-মা’র খুব দুশ্চিন্তা। কারণ নিয়ম মেনে ওজন বাড়ছে না তার। চিকুর জন্মের সময় সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। সবটাই নির্বিঘ্নে মিটলেও প্রথম মাস থেকেই তার ওজন সমবয়সি সব বাচ্চাদের থেকে কম। অথচ, সব কিছু নিয়ম মেনেই করানো হচ্ছে তাকে। তবুও চিকুর ওজন বাড়ছে না ঠিকঠাক ভাবে। সমস্যা এতটাই বেড়েছে যে, প্রণয় আর অনুসূয়ার কপালে সব সময়ই চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু এটা শুধু তাঁদের দু’জনের সমস্যা নয়। সন্তানদের নিয়ে এই সমস্যায় ভুগছেন অনেক বাবা-মা’ই। (Your guide to Baby’s Weight Gain in Bangla. Bachchar ojon baranor guideline.Your guide to Baby’s Weight Gain in Bengali.)
আপনার সন্তানের ক্ষেত্রেও কি এই একই সমস্যা? তার ওজন অন্য বাচ্চাদের তুলনায় কম? চিন্তা করবেন না। ওর ওজনের ঘাটতি খুব জটিল বিষয় না-ও হতে পারে। এর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। অপুষ্টি যেমন একটা কারণ হতে পারে, তেমনই আবার জন্মের সময় কিছু জটিলতাও শিশুর ওজনের স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা পেডিয়াট্রিশিয়ানরা বলেন, প্রথম বছরে শিশুর বৃদ্ধির হার থাকে সবচেয়ে বেশি। পরের বছর থেকে তা কমে যায়। প্রথম এক বছরে শিশুর ওজন বৃদ্ধি ঠিক কেমনটি হলে তা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায়, তার একটি তালিকা চিকিৎসকরা দেন। চিকিৎসকদের মতে এই মাপকাঠিটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত, দেখে নেওয়া যাক একনজরে। (Your guide to Baby’s Weight Gain in Bangla)
#1. জন্মের সময় (Birth weight): জন্মের সময় শিশুর ওজন আড়াই থেকে সাড়ে চার কেজির মধ্যে থাকলে, তাকে ডাক্তাররা স্বাভাবিক ওজন বলে থাকেন। জন্মের পরেই শিশুর শরীর থেকে বেরিয়ে যায় অতিরিক্ত তরল পদার্থ যা এতদিন গর্ভে থাকায় জমেছিল তার শরীরে। এই তরল শিশুর ওজনের পাঁচ থেকে দশ শতাংশ মতো দখল করে থাকে। তরল বেরিয়ে যাওয়ায় ওই পরিমাণ ওজন কমে যায়। তবে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই।
#2. প্রথম তিন মাস (First three months): প্রথম তিন মাসে শিশুর একমাত্র খাদ্য হল মায়ের দুধ বা শুধুমাত্র বাচ্চাদের জন্যই তৈরি দুধ বা সাপ্লিমেন্ট (Supplement)। তবে আপনার ছোট্ট সোনাকে বুকের দুধ খাওয়ানোই সবচেয়ে ভালো। এসময় শিশু দিনে ৮ থেকে ১১বার দুধ খায়। ঠিক কতটা দুধ শিশু খেতে চাইছে তা এই তিনমাসে ভালো করে বোঝা যায় না। তবে তৃতীয় মাসে দুধ খাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। এই তিন মাসে ওর ওজন প্রতিদিন প্রায় ২৯ গ্রাম করে বাড়ে। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০ গ্রামের কাছাকাছি ও প্রতিমাসে আপনার একরত্তির ওজন বৃদ্ধি পায় ৭০০ থেকে ৭০০ গ্রাম মতো।
#3. চার থেকে ছয় মাস (Fourth to sixth months): ডাক্তাররা বলেন, জন্মের সময় এক সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুর ওজন যা থাকে, তিন বা চার মাস বয়সে এসে ওজন ঠিক তার দ্বিগুণ হয়। চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে আপনার ছোট্ট সন্তানটির ওজন প্রতিদিন ২১-২২ গ্রাম করে বৃদ্ধি পায়। বোঝাই যাচ্ছে, আগের তিন মাসের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে। প্রতিদিন ২১-২২ গ্রাম করে ওজন বৃদ্ধি পেলে সপ্তাহে সেই বৃদ্ধির পরিমাণটা এসে দাঁড়ায় ১৫০ গ্রামের কাছাকাছি। অর্থাৎ আপনার সন্তানের ওজন এই সময় প্রতিমাসে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম বাড়তে পারে। এই তিন মাসও কিন্তু তার প্রধান খাবার মায়ের দুধই। তবে ছ’মাসে এসে শিশুকে সলিড খাবার (যেমন ফল-সবজি) সেদ্ধ করে, পেস্ট বানিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, নতুন খাবারে তার একেবারেই আগ্রহ নেই। তখন কিন্তু জোর করলে চলবে না। ধরে নেওয়া উচিত, এখনও সে নতুন খাবারের জন্য প্রস্তুত নয়। তা হলে আবার কয়েক দিন পরে এই চেষ্টা করা ভালো।
#4. সাত থেকে নয় মাস (sixth to ninth months): আপনার ছোট্ট সোনার এবার দাঁত গজানোর সময় হয়েছে। তার মাড়িতে আঙুল দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে দেখুন। অল্প অল্প আভাসও পাবেন। এই সময় শিশুদের ওজনের বাড়-বৃদ্ধি আগের তিন মাসের মতোই থাকে। অর্থাৎ মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের আশেপাশে। এই বয়সে দিনে তিন চার ঘণ্টা অন্তর অল্প অল্প পরিমাণে খাওয়ানো উচিত তাকে। খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন চটকানো সবজি, চটকানো ডালভাত জাতীয় খাবার। দুধের পাশাপাশি এসব খাবার শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাবে।
#5. দশ থেকে বারো মাস (tenth to twelfth month): ডাক্তাদের মতে, এই সময়ে এসে শিশুর ওজন, তার জন্মের সময়ের ওজনের প্রায় তিনগুণ হয়ে যায়। আগে ছোট্ট সোনা হাত পা নাড়তো শুধু। এখন রীতিমতো এদিক ওদিক ছুঁড়ছে। এর সঙ্গে হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা, ছোট ছোট দুষ্টুমি তো আছেই। এই সময় আপনার সন্তান কিন্তু হুটোপুটি করে ক্লান্ত হতে শুরু করে। তাই ওর খাবারের তালিকায় রাখুন বেশি পরিমাণ প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, যা তার নতুন নতুন দুষ্টুমির জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরির জোগান দেবে।
ওজন না বাড়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। আপনার সন্তান পাঁচজন বাচ্চার মতো বেড়ে উঠছে না— এ দেখে চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রিম্যাচিওর বেবি (premature baby), স্তন্যপানে ঘাটতি বা মায়ের যথাযথ দুধের অভাব— এই জাতীয় কিছু কারণেই শিশুর ওজন বৃদ্ধি থমকে যায়। (Your guide to Baby’s Weight Gain in Bangla)
জীবনের প্রথম বছরেই শিশুর ওজন অনেকটা বাড়ে। তাই কোনও কারণে শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে বাধা আসুক, তা কোনও মা-বাবা’ই চান না। ওজন যাতে ঠিক সময় মতো বাড়ে, তার বেশ কিছু উপায় আছে। চিকিৎসকদের মতে এই উপায়গুলি ঠিক কী কী, আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
#1. প্রিম্যাচিওর শিশুর ওজন (How to gain weight of premature baby?): প্রিম্যাচিওর শিশুর নানারকম সমস্যা থাকতে পারে। তার মধ্যে কম ওজনের সমস্যাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্যাঙারু কেয়ার (kangaroo care for baby)-এর মাধ্যমে প্রিম্যাচিওর শিশুর ওজন কিছুদিনেই স্বাভাবিক করে ফেলা যায়। এই পদ্ধতিটা সম্পর্কে গুগল থেকে সহজেই জানা যায়। বিষয়টা অনেকটা এইরকম— মা তাঁর নিজের অনাবৃত বুকে শিশুকে উপুর করে শুইয়ে রাখবেন। তারপর শিশুর পিঠের ওপর দিয়ে আলতো করে চাদর ঢাকা দেবেন। এভাবে দু’-তিন ঘন্টা পর্যন্ত আপনার সন্তানকে নিয়ে আপনি থাকতে পারেন। যেহেতু প্রিম্যাচিওর শিশু নিজের উষ্ণতা নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাই এই ক্যাঙারু কেয়ারের সাহায্য নেওয়া। এর ফলে শিশু আপনার শরীর থেকে প্রয়োজনীয় তাপ নিজের শরীরে নেয়। এতে আশেপাশের হাওয়া বাতাসের সঙ্গে তাকে খুব বেশি লড়াই করতে হয় না। ঠিক সময়ে দুধ খেতেও শিশুর সমস্যা হয় না। ছোট্ট সোনার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্রিয়া উষ্ণতার ভারসাম্যের কারণে ঠিক মতো চলতে। ফলে দুধ থেকে পাওয়া পুরো পুষ্টিই শরীরের ওজন বৃদ্ধির কাজে লাগে।
#2. মায়ের দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি (How to produce more breat milk): মায়ের দুধের উৎপাদন কোনও কারণে কমে গেলে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুর দুই বছর বয়স পর্যন্ত স্তন্যপান করালে ওজনের সঙ্গে তার স্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। তাই মায়ের দুধের উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়, তার পরামর্শ নিন ডাক্তারের থেকে। আপনার খাবারে রাখুন বেশি পরিমাণ সবুজ শাকসবজি। এই জাতীয় পদ দুধের উৎপাদন বাড়ায়। সবসময় চেষ্টা করুন বোতলের দুধের বদলে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে। এতে ওর বৃদ্ধির হার অনেকটাই বাড়বে।
#3. শিশুর খাদ্যনালীর সমস্যা (gastrointestinal track problems in baby): এমনটা হতেই পারে খাদ্যনালীতে কোনও ইনফেকশন (infection) বা সংক্রমণ হওয়ায় শিশু কম পরিমাণ দুধ খাচ্ছে। ওর দুধ খাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখুন। যদি মনে হয়, আপনার শিশুটি পর্যাপ্ত দুধ খাচ্ছে না, তবে ওর শরীর সুস্থ আছে কি না সে বিষয়ে চিকিৎসেরর পরামর্শ নিন। উনি সহজেই বলতে পারবেন, আপনার সোনার খাদ্যনালীতে কোনও সমস্যা হয়েছে কি না। তা হলে নিয়মমাফিক চিকিৎসা করালেই এর থেকে মুক্তি পাবে সে। আর খিদেও বাড়বে।
#4. সময় মতো খাওয়ানো (Feeding baby on time): ছোট্ট সোনা অঘোরে ঘুমাচ্ছে? ভাবছেন, এখন ঘুমাক, পরে খাওয়াবেন? একেবারেই না। নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময় বাদে বাদে ওকে খাওয়ানোটা খুব দরকারি। ঘুমকাতুরে হলেও ওর দুধ খাওয়ায় কোনওভাবেই যেন ছেদ না পড়ে। তাই সময় মেনে দরকারে ঘুম ভাঙিয়েই দুধ খাওয়ান।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null