সারা রাত হাত-পা ছুঁড়ছে, কেঁদেই যাচ্ছে ছোট্ট ছানা? ও স্লিপ ডিসঅর্ডারে ভুগছে না তো?

সারা রাত হাত-পা ছুঁড়ছে, কেঁদেই যাচ্ছে ছোট্ট ছানা? ও স্লিপ ডিসঅর্ডারে ভুগছে না তো?

শ্যামশ্রী গত পাঁচ রাত জাগা। ক্লান্তিতে শরীর আর চলতে চায় না। দিনের বেলা সারাক্ষণ ঘুম ঘুম পায়। ওর অবস্থা অবশ্য তারপরেও এক হিসেবে পারিজাতের থেকে ভালো। কারণ শ্যামশ্রীকে এখনই অফিস যেতে হচ্ছে না। কিন্তু পারিজাতকে এর মধ্যেই অফিসও যেতে হচ্ছে। (Why Don’t Babies Sleep at Night)

শ্যামশ্রীর মতোই পারিজাতও গত পাঁচ রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। অফিস থেকে ছুটিও নেওয়া যাচ্ছে না। আসলে সমস্যাটা হয়েছে ওদের দু’সপ্তাহের সন্তান পিয়াকে নিয়ে। কিছুতেই রাতে ঘুমাতে চাইছে না সে। সারা রাত জেগে হাত-পা ছুঁড়ছে। কখনও কাঁদছে। কান্না থামাতে বাবা-মা কোলে নিয়ে দোল খাওয়াতেই আবার খিলখিলিয়ে হাসছে। চোখে ঘুমটি নেই (Sisur Ghum)। অথচ, যেই মাত্র ভোর হচ্ছে, তার চোখে ঘুমের বন্যা।

কিন্তু তা বলে তো তার বাবা-মা তখন ঘুমাতে যেতে পারে না! তাই সব মিলিয়ে, খুবই চাপের মধ্যে শ্যামশ্রী এবং পারিজাত (My Newborn Doesn’t Sleep at Night)।

তবে প্রথম বার বাবা-মা হওয়ার পর, শ্যামশ্রী-পারিজাত যে চাপের মুখে পড়েছে, এই চাপের মুখে সব বাবা-মা’কেই পড়তে হয়। সেটাও ওদের অজানা নয়। কিন্তু এটাই যদি পিয়ার অভ্যাস হয়ে যায়! যদি বড় না-হওয়া পর্যন্ত ও রাতে ঘুমের নাম না-করে! এই আশঙ্কা থেকেই শ্যামশ্রী এবং পারিজাত কথাটা জানালো পিয়ার চিকিৎসকের কাছে।

জন্মের পর থেকে যে চিকিৎসক পিয়াকে দেখেছেন, তিনি জানালেন একটা অদ্ভুত তথ্য। তাঁর কথায়, অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মা যখন ৩২ সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেন, গর্ভে থাকা শিশুর মধ্যেও তখন একটা বায়োলজিক্যাল ক্লক কাজ করতে শুরু করে। সে-ও তখন গর্ভের মধ্যে কখনও জেগে থাকে, কখনও ঘুমায়। (Newborn Not Sleeping)

সারাদিন মা যখন মোটামুটি এদিক-ওদিক করছেন, গর্ভের মধ্যে শিশু তখন তুলনায় শান্ত হয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকে। আর রাতে মা যখন ঘুমাতে যান, তিনি শান্ত হন, গর্ভের শিশুর তখন অ্যাক্টিভিটি বেড়ে যায় (1 Month Old Baby Not Sleeping)। এই কারণেই অনেক সদ্যজাত বাচ্চাদের মধ্যে রাতে ঘুমানোর প্রবণতা কম হয়।

তবে এটা যেমন একটা কারণ, তেমনই কোনও কোনও শিশু ঘুমের সমস্যা বা স্লিপিং ডিসঅর্ডার (Sleeping Disorder)-এও ভোগে। কী দেখে বোঝা যাবে, শিশুর এই সমস্যা হচ্ছে, তা-ও বলে দিলেন চিকিৎসক। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।

 

 

শিশুর ঘুমের সমস্যার লক্ষণ (Sign of baby’s sleeping disorder):

 

  • নাক ডাকা: এমনিতে নাকা ডাকাটা সমস্যার না-হলেও, শিশুদের মধ্যে অত্যাধিক নাক ডাকার প্রবণতা থাকলে বুঝতে হবে, তার ফুসফুসে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন পৌঁছচ্ছে না. সেক্ষেত্রে এটা ঘুমের সমস্যার অন্যতম লক্ষণ।

 

  • দিনে অতিরিক্ত ঘুম: আপনার সন্তান কি দিনে অতিরিক্ত ঘুমাচ্ছে? বা দিনের বেলা তার খেলাধুলা বা কাজ করার ক্ষমতা খুব কমে যাচ্ছে? তা হলে বুঝতে হবে ও ইডিএস-এ ভুগছে। সদ্যজাত থেকে ১২-১৩ বছরের শিশু—যে কোনও বয়সেই এই সমস্যা হতে পারে। (Sisur Ghumer Somosya)

 

  • দুঃস্বপ্ন: রাতে দুঃস্বপ্ন দেখছে এবং বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে? সেক্ষেত্রেও ওর ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা দরকার এই অবস্থায়।

 

  • ঘুমাতেই চাইছে না: একদিন ঘুমাতে চাইছে না, তাতে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রতি রাতেই যদি একই ঘটনা ঘটে, তবে বুঝতে হবে, আপনার শিশুর মারাত্মক ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।

 

  • রাতে ভয়: কোনও ভয়ের গল্প বলেননি, বা কোনও ভয় পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। তবু যদি হামেসাই আপনার সন্তান রাতে ভয় পায়, তাহলেও বুঝতে হবে ওর এই জাতীয় সমস্যা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দ্রুত মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

 

  • স্লিপ ওয়াকিং: এতে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। বহু শিশুর মধ্যেই এই সমস্যা দেখা যায়। এবং অনেকের মধ্যে টিনএজ পর্যন্ত এই সমস্যা চলতেই থাকে। রাতে তারা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে এবং হাঁটতে থাকে। এই ঘটনার সময় তারা ঘুমিয়ে থাকলেও, তাদের চোখ খোলা থাকতে পারে। বিষয়টা আরও বিপদের হয়, যদি শিশু ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে ঘরের বা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়। কিংবা কোনও জিনিসে আঘাত পায়। (2 Month Old Baby Not Sleeping)

এই ধরনের সমস্যা থাকলে বুঝতে হবে শিশু স্লিপ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। তারা আঘাত পেতে পারে, এমন বস্তু নাগালের বাইরে রাখাই ভালো। আরও একটা কথা, এই ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটার সময় হঠাৎ করে তাদের ঘুম ভাঙানো উচিত নয়। সেক্ষেত্রে তারা মারাত্মক ভয় পেতে পারে। শিশুর মধ্যে এই সমস্যা দেখা গেলে, অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

 

  • বিছানায় হিসু: শিশুদের মধ্যে এই প্রবণতাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুর মধ্যে ঘনঘন এই প্রবণতা দেখা গেলে, তা চিন্তার বইকি! বুঝতে হবে, সে স্লিপিং ডিসঅর্ডার ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবেগতাড়িত সমস্যা থেকেও শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়।

 

 

আরও পড়ুন: শিশুকে ভালো করে ঘুমাতে দিন। ওর সুন্দর জীবনের চাবিকাঠি আছে এই ঘুমেই

 

 

সমস্যার কথা তো জানা গেল। এবার আসা যাক সমাধানের কথায়। চিকিৎসকরা বলছেন, কোন কোন নিয়ম মেনে চললে শিশুদের ঘুমের মান ভালো হয়, তাদের স্লিপিং ডিসঅর্ডার তুলনায় কমে। ঝলকে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।

 

শিশুদের ভালো ঘুম দেওয়ার উপায় (Tips for Improving Child’s Sleep)

 

#1. রুটিন মেনে: ঘুমের সময় এক রাখুন। সদ্যজাত শিশুর যেমন ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন, তেমনই ১০ বছরের শিশুর আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। শিশু যত বড় হতে থাকবে, তার ঘুমের সময় একটু একটু করে কমতে পারে। কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের বিশেষ হেরফের যেন না-হয়। নির্দিষ্ট সময় প্রতি রাতে ঘুমাতে গেলে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠলে, ঘুম গভীর হবে। (Why Don’t Babies Sleep at Night)।

 

#2. ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে দূরে: এখন অনেক শিশুই ছোটবেলা থেকে হাতে ইলেকট্রনিক যন্ত্র পেয়ে যায়। বিশেষ করে ফোন বা ট্যাব। কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে শিশুর কাছ থেকে এই জাতীয় যন্ত্র সরিয়ে ফেলুন। এর থেকে নির্গত আলো শিশুদের তো বটেই বড়দেরও ঘুমের সমস্যা ডেকে আনে। তা ছাড়া ঘুমানোর আগে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে ফ্ল্যাশ বা জোরালো আলো ব্যবহার করে শিশুর ছবি তুলবেন না। সেটিও ঘুমের সমস্যা ডেকে আনতে পারে।

 

#3. ভারী খাবার নয়: ঘুমাতে যাওয়ার আগে শিশুদের ভারী খাবার একদম দেবেন না। এক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা ডেকে আনার আশঙ্কা থাকে। ভারী খাবার দিতে হলে চেষ্টা করুন, ঘুমানোর তিন-চার ঘণ্টা আগে সেটা দিয়ে দিতে। কফির মতো পানীয়ও যদি তাকে দেন, তা হলে সেটাও দিতে হবে ঘুমাতে যাওয়ার ঘণ্টা পাঁচেক আগে। (Baby Sleep Tricks)

 

#4. জোরালো শব্দ বা আলো থেকে দূরে: শিশু যে ঘরে ঘুমায় সেই ঘরে বেশি রাতে জোর আলো জ্বালাবেন না। আপনার সোনা ঘুমিয়ে পড়ার পরে তো এমন আলো জ্বালানোর প্রশ্নই নেই। আর সম্ভব হলে সেই ঘরে টেলিভিশন বা কমপিউটারের মতো যন্ত্র রাখবেন না। ঘুমানোর সময় এসে গেলে শিশুর ঘর যত দূর সম্ভব নিঃস্তব্ধ রাখুন। দরকার হলে ভারী পর্দা দিয়ে বাইরের আলো বা শব্দ আসার আশঙ্কা কমান।

 

#5. বিছানায় যাওয়ার সময়: কখন শিশু বিছানায় যাবে, এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন থাকে। মনে রাখবেন, শিশু যখন ক্লান্ত, কিন্তু সে জেগে রেয়েছে, সেই অবস্থায় তাকে বিছানায় পাঠান। খেলতে খেলতে সে যদি অন্য ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে, বা বাবা-মা’র কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর তাকে বিছানায় পাঠানো হয়, তা হলে তার মধ্যে পরবর্তীকালে স্লিপ ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে (How Do I Get My Baby to Sleep Through The Night)। বরং নিজের বিছানায় তাকে জেগে থাকা অবস্থা থেকে ঘুমিয়ে পড়তে দিন। এটা ঘুমের সুঅভ্যাস তৈরি করবে।

 

স্লিপ ডিসঅর্ডার মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে শিশু বড় হলে, তার মধ্যে অন্য নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার বা অবসাদে ভোগার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই আপনার খোকা বা খুকুর মধ্যে যদি এমন লক্ষণ দেখেন অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন (Why Don’t Babies Sleep at Night)।
যদি পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওর টনসিল বা এয়ার প্যাসেজের কোনও সমস্যার কারণে ঘুম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তবে তিনি ততক্ষণাৎ চিকিৎসার পদ্ধতি বাতলে দেবেন। আর যদি দেখা যায়, মানসিক কোনও সমস্যা ঘুমের পথে ব্যাঘাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হলেও কী করতে হবে, তিনি সেই পথও দেখিয়ে দেবেন আপনাকে। শুধু আপনার সোনার স্বার্থে এমন সমস্যার কথাটা চিকিৎসকের কানে পৌঁছে দিতে হবে।

 

আরও পড়ুন: রাতভর শিশুর নিশ্চিন্ত ঘুমের ৭টি সহজ টিপস! সেই সাথে জেনে নিন, পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি কেন?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null