সন্তান প্রসবের সময় সিজারিয়ান সেকশন; কোনও জরুরি অবস্থা না ঐচ্ছিক সিদ্ধান্ত!

সন্তান প্রসবের সময় সিজারিয়ান সেকশন; কোনও জরুরি অবস্থা না ঐচ্ছিক সিদ্ধান্ত!

যেদিন প্রথম শুনলেন যে যার অপেক্ষায় এতদিন বসেছিলেন সে গুটিসুটি মেরে বসে আছে আপনার পেটে; সেই মুহূর্তে নিশ্চয় নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ধনী ব্যক্তি মনে হয়েছিল, তাই তো? মাতৃত্ব তার একেক পর্যায়ে নিয়ে আসে ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা। নাহ, আমি রং লাগিয়ে কথা একেবারেই বলব না, একবারও বলব না যে মাতৃত্বের ধাপ আপনার ওই পশমের রেজাইটার মতো নরম তুলতুলে, বলব না কোনও অবস্থাতেই কষ্টে আপনার চোখে জল আসবে না। সব হবে, আপনি কাঁদবেন, কষ্ট পাবেন, অস্থির হবেন, কোনও সময় বিরক্তও হবেন; কিন্তু কী জানেন,সপ্তাহের শেষে ডাক্তারি চেক আপে গিয়ে যখন ছোট্ট একজনের হার্ট-বিট শুনবেন বা রাত-বিরেতে পেটের ভিতর ছোট্ট পায়ের লাথি খাবেন, তখন মনে হবে এর জন্য আমি এমন কষ্ট শতবার করতে পারি। আর এখানেই তো মায়ের মমত্ত্ব সব্বার থেকে আলাদা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। (Common Reason for C-Section Delivery and Emergency C-Section in Bangla. C-section niye jabotiyo tothyo. What is A C-Section In Bangla)

সি-সেকশন নিয়ে আপনার যা যা জানা দরকার (Everything You Need To Know About A C-Section)

মাতৃত্বের ধাপকে যদি প্রধান তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে চাই, তা হলে প্রথমে আসে গর্ভধারণের সময়কাল, তারপরে আসে বাচ্চা প্রসব বা ডেলিভারি হওয়ার সময় আর শেষ ধাপ হল বাচ্চাকে মানুষ করা। অর্থাৎ, এই তিন ধাপেই মোটামুটি আপনার নারী জীবনের অধিকাংশ সময়ই যাবে আর কী। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হল সিজার বা সি-সেকশনের সাহায্যে বাচ্চার জন্ম নিয়ে। আজ জানবো এই সি- সেকশনের ইতি-বৃত্তান্ত। প্রসবের সময় কেন সি-সেকশন করা হয়, কী কারণে ডাক্তাররা এমারজেন্সি সি-সেকশন করতে বাধ্য হন এবং এর ফলাফলই বা কেমন। দেখে নিন একনজরে।

আরও পড়ুনব্রণর বাড়াবাড়ি? হবু-মায়ের সৌন্দর্য ফেরাবে ঘরোয়া টোটকাই!

সি-সেকশন বা সিজার আসলে কী? (What is A C-section In Bangla)

গর্ভাবস্থার নির্দিষ্ট সময়ে মায়ের পেট ও জরায়ুর দেওয়ালের একটা অংশ কেটে বাচ্চাকে পেট থেকে বের করে আনা হয়, প্রসব করানোর এই পদ্ধতিতে সি-সেকশন বা সিজার বলে। নর্মাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসবের বিকল্প হিসেবে সি-সেকশন করা হয়ে থাকে।

সি-সেকশন কে আমরা কয়টি ভাগে ভাগ করতে পারি? (Types of C-section)

  • পরিকল্পিত সি-সেকশন।
  • ইচ্ছাকৃত সি-সেকশন।
  • এমারজেন্সি সি-সেকশন।

পরিকল্পিত সি-সেকশন কী ও কেন করা হয়? (Planned c-section and reasons behind it?)

এই ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা চলাকালীনই হবু মা জানতে পেরে যান যে, তাঁর সি-সেকশন করে প্রসব হবে। মা ও সন্তানের শারীরিক স্থিতি বিচার করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ও হবু মা-বাবাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসকরা যেসব কারণের জন্য সি-সেকশন করানোর সিদ্ধান্ত নেন, সেগুলি হল;

  • গর্ভবতী মহিলার যদি উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে বা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস (gestational diabetes)হয়ে থাকে।
  • জরায়ু ও প্রসবপথে টিউমার থাকলে।
  • হবু মা যদি শারীরিক দিক থেকে দুর্বল থাকেন এবং তার প্রসব-যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি না থাকে।
  • বাচ্চার মাথা যদি প্রসবপথের তুলনায় বেশ বড় হয়।
  • বাচ্চা যদি ব্রিচ পজিশনে থাকে। অর্থাৎ, বাচ্চার মাথা ওপর দিকে থাকে বা বাচ্চা একপাশে কাত হয়ে থাকে।
  • মায়ের কোমরের নীচের অংশ সরু হলে।
  • গর্ভে একাধিক সন্তান থাকলে।
  • প্লাসেন্টা প্রিভিয়া জরায়ুর নীচের দিকে থাকলে।
  • মায়ের যোনিপথে আগে কোনও ইনফেকশন যেমন, হারপিস জাতীয় কিছু হয়ে থাকলে সংক্রমণ এড়াতে সি-সেকশন করা হয়।
  • মায়ের যদি হার্টে কোনও সমস্যা থাকে।
  • মায়ের বয়স বেশি হয়।

ইচ্ছাকৃত সি-সেকশন কী ও কেন করা হয়? (What is elective c-section?)

এই ক্ষেত্রে হবু মা নিজেই চিকিৎসককে অনুরোধ করেন সি-সেকশনের মাধ্যমে প্রসব করানোর জন্য। একে এক ধরনের পরিকল্পিত সি-সেকশনই বলা যেতে পারে। যেসব কারণে, হবু মা সিজার করাতে চান, সেগুলি হল;

  • মা দীর্ঘ প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে অপারেশনের কষ্ট ভোগ করা ভালো মনে করেন।
  • ছোট ফ্যামিলিতে সর্বক্ষণ দেখাশুনা করার কেউ থাকে না এবং হবু মা-বাবা সবসময় ভয়ে থাকেন যে, কখন প্রসব যন্ত্রণা উঠবে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে তারা সারাক্ষণ একটা অনিশ্চয়তায় ভোগেন। এই উদ্বেগ কম করতে অনেকেই সি-সেকশন করতে চান।

এমারজেন্সি সি-সেকশন কী ও কেন করা হয়? (What is emergency c-section and when do doctors choose this?)

এই সি-সেকশন অনেকটা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো। প্রসবের সময় বা প্রসব যন্ত্রণা চলাকালীন যদি মা বা বাচ্চার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়, তা হলে এমারজেন্সি সি-সেকশন করা হয়। হবু মা বা তার পরিবার স্বাভাবিক প্রসব চাইলেও, এই সব এমারজেন্সি পরিস্থিতিতে সি-সেকশন না করলে মা ও বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যেসব অবস্থায় চিকিৎসকরা এমারজেন্সি সি-সেকশন করার সিদ্ধান্ত নেন;

  • বাচ্চা যদি প্রসবের সময় ঠিক অবস্থানে না থাকে।
  • বাচ্চার মাথা বেরনোর আগেই যদি অ্যাম্বিলিকাল কর্ড প্রসব পথ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
  • অ্যাম্বিলিকাল কর্ড যদি কোনও ভাবে বাচ্চাকে বেরোতে বাধা দেয়।
  • ১২-১৪ ঘণ্টা প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করার পরও প্রসব হচ্ছে না এবং মা ক্রমাগত নেতিয়ে পড়ছেন।
  • প্রসব শুরু হওয়ার আগেই বেশি রক্তপাত হলে।
  • মায়ের রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে।
  • ইনজেকশন দেওয়ার পরেও প্রসব সংকোচন ঠিকভাবে না হওয়া।
  • বাচ্চা প্রসবের ধকল নিতে না পারলে।
  • কোনও কারণে বাচ্চা ঠিক মতো অক্সিজেন না পেলে।

আরও পড়ুনগর্ভকালীন ডায়াবেটিস; কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

সি-সেকশনের ভালো দিক (Advantages Of A C-section)

  • কখন প্রসব ব্যথা উঠবে সেই ভেবে মানসিক দুশ্চিন্তা করতে হয় না।
  • বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরে পরবর্তী যৌনজীবন সুখকর থাকে।
  • পুরো প্রক্রিয়ায় বাচ্চার অক্সিজেনের কমতি হয় না।
  • ভ্যাজাইনাল ইঞ্জুরি হওয়ার ভয় থাকে না।

সি-সেকশনের ক্ষতিকর দিক/ Disadvantages Of A C-Section

  • সি-সেকশনের মাধ্যমে জন্মানো বাচ্চারা শারীরিক ভাবে একটু দুর্বল হতে পারে। স্বাভাবিক প্রসবে যেসব বাচ্চা জন্মায়, তাদের অ্যাজমা জনিত সমস্যা কম হয়।
  • সি-সেকশনের পর মায়ের সেরে উঠতে বেশ সময় লাগে এবং পর্যাপ্ত যত্নের প্রয়োজন হয়।
  • ভবিষ্যতের আবার গর্ভধারণের কথা ভাবলে সি-সেকশনের তুলনায় স্বাভাবিক প্রসব নিরাপদ।
  • তুলনামূলক বেশি রক্তক্ষরণ হয়।
  • জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • ভবিষ্যতে জরায়ু অপসারণ করতে হতে পারে।
  • বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে দেরি হয়।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (Some points to remember)

  • আপনার শরীর ও আপনার গর্ভস্থ বাচ্চার অবস্থা সবথেকে ভালো বোঝেন আপনার চিকিৎসক। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মতোই চলুন। নিজেদের ইচ্ছে ওনার ওপর চাপাতে চেষ্টা করলে আখেরে ক্ষতি আপনারই।
  • শারীরিক কোনও অসুবিধা না থাকলে, ভয় না পেয়ে মনে মনে প্রস্তুত থাকুন স্বাভাবিক উপায়ে প্রসব করার জন্য।
  • এমনটা একেবারেই নয় যে, স্বাভাবিক প্রসবে মায়ের কষ্ট বেশি আর সিজারে কম; দুই ক্ষেত্রেই কষ্ট দুই রকমের আর যারা ভোগ করছেন তারাই জানেন।
  • কাজেই, সেই ভেবে নিজেকে তৈরি করুন।
  • অনেক সময়ই চিকিৎসক নরমাল ডেলিভারি হবে বলে ওটিতে ঢোকালেন কিন্তু বেরিয়ে বললেন সি-সেকশন করতে হয়েছে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে এটা হয়তো অর্থ রোজগারের বাহানা মাত্র। কিন্তু প্রতিবেদনে দেখলেন তো, কত রকম এমারজেন্সি পরিস্থিতি আসতে পারে নরমাল ডেলিভারিতে? আপনার চিকিৎসক বাধ্য হয়েই সি-সেকশন করেছেন। ভরসা রাখুন।
  • মা কীভাবে বাচ্চার জন্ম দেবেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তার পূর্ণ অধিকার আছে। তাই নিজের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা বিচার করে ও ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে যেটা উচিত সেটা করুন।
  • সি-সেকশনের পর নিজের পর্যাপ্ত যত্ন নিন ও বিশ্রাম করুন। প্রয়োজনে এমন কারও সহায়তা নিন, যিনি বাচ্চা দেখভাল করতে আপনাকে সাহায্য করবেন।
    অযথা দুশ্চিন্তা করে ভয় পাবেন না। সব সময় ভালো ভাবুন, সবকিছু ভালোই হবে।

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null