মাত্র ২২ দিন হল অপর্ণা সুখবরটা পেয়েছে। রাজীব তো রীতিমতো আনন্দে নাচছে বলা যায়। প্রথমবার বাবা হওয়ার আনন্দই তো আলাদা। প্রেগন্যান্সি টেস্টের পর ডাক্তারবাবু নিশ্চিত করলেন, দু’জনের পরিবারে আরেক ছোট্ট সদস্য আসতে চলেছে। কিন্তু গতকাল থেকেই অপর্ণার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। এমনিতে গর্ভাবস্থায় শরীর ক্লান্ত লাগাই স্বাভাবিক। তবে এই ক্লান্তি তার থেকে অনেকটাই বেশি। খবরটা শোনার পর থেকে রাজীব ওর স্পেশাল কেয়ার নেওয়া শুরু করেছে। খাওয়াদাওয়া থেকে চলাফেরা– সবেতেই ওর কড়া নজর। তা সত্ত্বেও শরীর এতই দুর্বল যে শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। রাজীব এসব দেখে সেদিন অফিস ছুটি নিল। অপর্ণাকে নিয়ে সোজা চিকিৎসকের চেম্বারে। ডাক্তারবাবু পুরোটা শুনেই কয়েকটি ব্লাড টেস্ট লিখে দিলেন। পরদিনই পরীক্ষাগুলো করিয়ে বিকেল নাগাদ রিপোর্ট হাতে রাজীব আর অপর্ণা আবার ওঁর চেম্বারে হাজির। ডাক্তারবাবু যা আন্দাজ করেছিলেন, রিপোর্টে তাই এসেছে। অপর্ণার শরীরে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া (Anemia)-র লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তবে বিপজ্জনক অবস্থা মোটেই নয়। ডাক্তারবাবু কিছু ওষুধ লিখে দিলেন আর নতুন ডায়েট চার্ট করে দিলেন। এর কিছুদিন পর থেকে অপর্ণা সুস্থবোধ করতে লাগল। হঠাৎ করে যে অসম্ভব ক্লান্তিটা চেপে ধরেছিল, তা এখন একেবারে উধাও। (What are different complications during pregnancy in Bengali, Gorbhabasthay er samay ki ki samasya hote pare. What are the problems during pregnancy in Bangla. What are the complications during pregnancy in Bengali.)
প্রেগন্যান্সির সময় হবু মায়েদের শরীরে এমন আরও নানাধরনের জটিল সমস্যা দেখা যায়। তাই অপর্ণা যে এখানে ব্যতিক্রম, তা নয়। শরীরে আরেকটি নতুন প্রাণ এলে কী কী সমস্যা দেখা দেয় মায়েদের শরীরে? চলুন দেখে নেওয়া যাক।
#1.অ্যানিমিয়া: অপর্ণার কথা দিয়ে যখন শুরু হল, ওর সমস্যা দিয়েই শুরু করা যাক। মানুষের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা বা আরবিসি (রেড ব্লাড করপাসলস) নামে কোষ থাকে, তা সবাই জানেন। এই কোষের কাজই হল অক্সিজেন বয়ে বেড়ানো। অ্যানিমিয়ায় এই কোষের সংখ্যা কমে যায় এবং এর উৎপাদনও হ্রাস পায়। ফলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমতে শুরু করে। সেই কারণেই শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
কেন হয়?: আরবিসি-এর প্রধান উপাদান হল আয়রন, ভিটামিন বি-১২ আর ফোলেট। প্রেগন্যান্সির সময় শরীরে এগুলোর চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই চাহিদা মিটিয়ে, শরীর তারপরে আরবিসি উৎপাদন শুরু করে। যার ফলেই দেখা দেয় অ্যানিমিয়া।
কী কী হয়: অ্যানিমিয়া হলে শরীর দুর্বল তো লাগেই, এমনকী শ্বাস নিতেও অসুবিধা হতে পারে। অ্যানিমিয়া গুরুতর অবস্থায় চলে গেলে শিশুর জন্ম সময়ের আগে হয়ে যেতে পারে। ফলে জন্মের পর শিশুর ওজন কম হয়। কিছুক্ষেত্রে শিশু নিজেও অ্যানিমিয়ার সমস্যায় ভুগতে পারে।
কী করা উচিত: প্রেগন্যান্সির পর একটি নতুন ডায়েট চার্ট সব মায়েদেরই মেনে চলতে হয়। আগে কখনও অ্যানিমিয়া হয়ে থাকলে ডায়েটে ভিটামিন বি-১২, ফোলিক অ্যাসিড আর আয়রনসমৃদ্ধ খাবার অবশ্যই রাখুন। চিকিৎসকও এই পরামর্শ দেন। অবস্থা গুরুতর হলে আয়রন, ফোলিক অ্যাসিড ইত্যাদির সাপ্লিমেন্টও নিতে হয়। তবে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শই শেষ কথা।
#2. প্রি-একল্যাম্পসিয়া: প্রেগন্যান্সি প্রথম থেকে স্বাভাবিক থাকলেও ২০ সপ্তাহ পর প্রি-একল্যাম্পসিয়ার মতো মারাত্মক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এর আরেক নাম টক্সিমিয়া। এক্ষেত্রে শিশুকে সময়ের আগেই জন্ম দিতে হয়, যা শিশুর জন্য মোটেই সুখবর নয়। মাকেও ডেলিভারির সময় বেশি ‘লেবার’ দিতে হয়।
কেন হয়: এটি মূলত হয় অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন মায়ের উচ্চ রক্তচাপের কারণে। তবে রক্তচাপ একা নয়, এর পাশাপাশি কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গের কোনও রকম সমস্যা হলে তবেই প্রি-একল্যাম্পসিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে।
কী কী হয়: রক্তচাপ মারাত্মক বেড়ে যায়। প্রচণ্ড পেট ব্যথার পাশপাশি মাথাও ঘুরতে থাকে। হাত পা ফুলে যায়। অধিকাংশ সময় মাথাব্যথা করে আর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এই সময় মূত্রে প্রোটিনজাতীয় পদার্থের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
কী করা উচিত: ৩৭-৪০ সপ্তাহের মাথায় এমন সমস্যা দেখা দিলে শিশুকে সময়ের আগে জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। এক্ষেত্রে মায়ের কষ্টও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়। তবে প্রি-একল্যাম্পসিয়া আরও আগে হলে ডাক্তাররা মাকে চোখে চোখে রাখেন। চেষ্টা করেন যেভাবেই হোক রক্তচাপ যেন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে মনিটর করা হতে পারে।
আরও পড়ুনঃগর্ভকালে থাইরয়েড: সম্ভাব্য বিপদ ও নিরাময়ের উপায়
#3. উচ্চ রক্তচাপ:: গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ কেটে গেলে মায়ের রক্তের চাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এই উচ্চ রক্তচাপ বাচ্চার জন্ম হওয়া পর্যন্ত থাকে।
কেন হয়: শিশুর জন্মের সময় এগিয়ে আসছে, তা নিয়ে হওয়া চিন্তা থেকে রক্তের চাপ বাড়তে পারে । এছাড়াও জরায়ুতে থাকা ভ্রুণের আকারও তো বাড়ছে। তাই রক্তের চাপ বেড়ে যায়।
কী কী হয়: এক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া আর কিছুই হয় না। তবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখলে প্রি-একল্যাম্পসিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কী করা উচিত: ডাক্তারের পরামর্শ এক্ষেত্রে জরুরি। তিনি এই সময় মাকে চোখে চোখে রাখেন, যাতে কোনওভাবে রক্তচাপ থেকে প্রি-একল্যাম্পসিয়া না হয়।
#4. জেস্ট্যাশনাল ডায়াবেটিস: প্রেগন্যান্সির সময় রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মা এই সমস্যার শিকার হন। এই ধরনের ডায়াবেটিস হলে রক্তে সুগারের মাত্রা ভীষণভাবে বেড়ে যায়, যা মা ও শিশু কারও জন্যই ভালো নয়।
কেন হয়: প্রেগন্যান্সির সময় প্লাসেন্টা থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনই রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই সময় প্যাংক্রিয়াসও প্রয়োজন বুঝে ইনসুলিন উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্যাংক্রিয়াসে ইনসুলিনের উৎপাদন ঠিকঠাক না হলে রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ।
কী কী হয়: রক্তে গ্লুকোজ বাড়লে, পরীক্ষা না করা পর্যন্ত তা ধরা পড়ে না। তবে এই সময় খিদে বেড়ে যায়, শরীর ক্লান্ত লাগে। ব্লাড সুগার সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রি-একল্যাম্পসিয়ার মতো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। শিশুকে তখন সময়ের আগে জন্ম দিতে হয়। এমনকী সদ্যোজাত শিশুর শরীরে শ্বাসকষ্ট, লো ব্লাড সুগার, জন্ডিস ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কী করা উচিত: চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে খাওয়াদাওয়ার নতুন চার্ট করে দেন। খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখলেই ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে অনেকক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হলে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ইনসুলিন নিতে হয়।
#5. প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন: এক্ষেত্রে শিশুর জন্মের আগে মায়ের জরায়ুর দেওয়াল থেকে প্লাসেন্টা আলগা হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। এই সময় ভ্রুণ যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর পদার্থ আর অক্সিজেন পায় না।
কেন হয়: এর কোনও নির্দিষ্ট কারণ এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে নেই। তবে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় পেটে চোট লাগলে বা পড়ে গেলে তা থেকে এমন সমস্যা হতে পারে বলে মত অনেক বিশেষজ্ঞের।
কী কী হয়: এই সময় যোনিপথ দিয়ে প্রচন্ড রক্তপাত হতে থাকে। পেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়, সঙ্গে পেশির টান (মাসল ক্র্যাম্পিং)-এর মতো সমস্যা দেখা দেয়।
কী করা উচিত: এক্ষেত্রে চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ভর করে প্লাসেন্টা জরায়ুর দেওয়াল থেকে কতটা আলগা হয়েছে, তার উপর। অল্প পরিমাণে আলগা হলে ডাক্তাররা সাধারণত বেড রেস্টের পরামর্শ দেন। অর্ধেকের কম আলগা হলে সেক্ষেত্রেও একই পরামর্শ। কিন্তু অর্ধেকের বেশি আলগা হলে শিশুকে সময়ের আগে জন্ম দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
#6. এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি: এই ধরনের প্রেগন্যান্সি প্রত্যেক মেয়ের কাছেই অত্যন্ত খারাপ খবর। মায়ের জরায়ুতে ভ্রুণের রোপন হলে তবেই ভ্রুণ স্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে। কিন্তু এই প্রেগন্যান্সিতে ভ্রুণ জরায়ুর বাইরে ফ্যালোপিয়ান টিউবে বা অন্য কোথাও রোপিত হয়। এভাবে ভ্রুণের বৃদ্ধি হলে মায়ের জীবন নিয়ে টানাটানি হয়।
কেন হয়: জরায়ুতে বা ফ্যালোপিয়ান টিউবে কোনওরকম ইনফেকশন হলে এই ধরনের প্রেগন্যান্সির শিকার হন মহিলারা। এই ইনফেকশন যে কোনও কারণে হতে পারে। এর পোশাকি নাম হল পেলভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজিজ। তবে অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় গনোরিয়ার মতো সংক্রামক রোগের কারণেও ইনফেকশন হয়।
কী কী হয়: ভ্রুণের রোপন জরায়ুর বাইরে হলে, যোনিপথ দিয়ে রক্তপাতের মতো ঘটনা ঘটে। এছাড়া পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে, একইসঙ্গে ঘাড়েও ব্যথা হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড মাথা ঘোরে। এমনকী জ্ঞান হারানোও অস্বাভাবিক নয়। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সিতে ইন্টারনাল ব্লিডিংয়ের জন্য মায়ের প্রাণ নিয়ে টানাটানির আশঙ্কাও থাকে।
কী করা উচিত: প্রথমদিকে মেডিসিনের মাধ্যমে এটি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হলে ডাক্তাররা ল্যাপারোস্কপি বা অন্য কোনও সার্জারির মাধ্যমে এক্টোপিক টিস্যুগুলোকে নষ্ট করে দেন।
সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গেলে প্রত্যেক মাকেই অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। তা সত্ত্বেও কিছু জটিলতা কমবেশি সবার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। সেই সব বাধা পেরিয়েও সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান বলেই তো তিনি মা।
আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম- উপকারিতা আর সাবধানতা!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null