বমি, পেট খারাপে নাজেহাল ছোট্ট সোনা, টোটকাগুলো ট্রাই করেছেন কি?

বমি, পেট খারাপে নাজেহাল ছোট্ট সোনা, টোটকাগুলো ট্রাই করেছেন কি?

বাচ্চাদের মধ্যে ঘন ঘন পেট খারাপের সমস্যা বা বমির সমস্যা হওয়া যতটা স্বাভাবিক, ততটাই কিন্তু কষ্টকর। আমরা বড়রাই এই ধরনের সমস্যায় ২ দিন থাকলে নাজেহাল হয়ে যাই। সেখানে ওই ছোট্ট প্রাণগুলো এত্ত ধকল সয় কী করে বলুন তো!

অপরিণত পাচনতন্ত্র, কম ইমিউনিটি পাওয়ার বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও আনুসঙ্গিক অনেক কিছুর প্রভাবেই বাচ্চার পেট খারাপ বা বমির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। মারাত্মক ভয়ানক কোনও রোগ না হলেও শিশুকে ভালোমতো কাহিল করে দেয় এই উপসর্গগুলি। (Home Remedies for Vomiting & Loose Motion in Babies)

যে কোনও অসুখের নিরাময় যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই মঙ্গল। খুব সাধারণ অসুখও কিন্তু উপেক্ষার ফলে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন প্রথম দিন থেকেই। বাচ্চা অসুস্থ হলে প্রথমেই কড়া কড়া ওষুধ না খাইয়ে হাত ধরুন ঘরোয়া টোটকাগুলোর!

 

বাচ্চাদের পেট খারাপ বা বমি হওয়ার পিছনে কী কী কারণ থাকতে পারে? (Reasons for Vomiting & Loose Motion in Babies)

  • খাওয়ার আগে হাত ঠিক করে না ধুলে বা মলত্যাগের পর হাত ভালো ভাবে না ধুলে সেই থেকে পেটে ইনফেকশন হতে পারে।
  • বাইরে সংক্রমিত মলে বসে থাকা মাছি খাবারে এসে বসলে সেই খাবার থেকে।
  • সংক্রমিত খাবার এবং পানীয় জল থেকে।
  • খাবার খাওয়ার বাসন অপরিষ্কার হলে এবং বাচ্চা নোংরা জায়গায় থাকলে।
  • বাচ্চার দাঁত ওঠার সময় পেট খারাপ হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা।
  • বাচ্চা অপরিষ্কার খেলনা বা অন্য কোনও কিছু খাবার/জিনিস মুখে দিলে।
  • বাচ্চার হজমের গোলমাল হলে।
  • কোনও খাবার সহ্য না হলে বা কোনও খাবারে এলারজি থাকলে।
  • বাতাসে অনেক সময়ে ডায়রিয়া/পেট খারাপের ভাইরাস ছড়ায়। গরমকালে এর প্রকোপ বেশি বাড়ে।
  • এছাড়া, যেসব বাচ্চারা ঠিক করে টয়লেট ব্যবহার করতে শেখেনি, তাদের ডায়রিয়া হলে বাড়ির অন্য শিশুরও ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টয়লেট ঠিক মতো পরিষ্কার না হলে ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ায়।
  • এছাড়াও, কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও পেট খারাপ বা বমির মতো সমস্যা হয়।
  •  বাচ্চাদের মধ্যে ডাইরিয়া হওয়া খুব সাধারণ একটি ঘটনা। শিশুদের ডায়রিয়া হওয়ার পিছনে প্রধান আসামী বলা যায় রোটা ভাইরাসকে। এছাড়াও, নোরো ভাইরাস বা অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রভাবেও ডায়রিয়া হয়ে থাকে।
  • ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশন থেকেও ডায়রিয়া হতে পারে। সাধারণত, সংক্রমিত খাবার বা পানীয় থেকে এই ব্যাকটেরিয়া জনিত ডায়রিয়া হয়ে থাকে (Loose Motion and Vomiting)। এছাড়া,এর জন্য ই- কোলাই, সিগেলা, সালমনেল্লা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও জিয়ারডিয়া ল্যাম্বলিয়া, এন্টামিবা হিসটোলাইটিকা ইত্যাদির মতো পরজীবীরা দায়ী। এইসব রোগজীবাণুরা মানুষের খাদ্যনালীতে হামলা করে ডায়রিয়ার মতো রোগ সৃষ্টি করে।

 

বাচ্চার পেট খারাপ/ পাতলা পায়খানা সারিয়ে তোলার ঘরোয়া প্রতিকার (Home Remedies for Loose Motion in Babies)

#1. ব্রেস্ট মিল্ক: ঠিক শুনেছেন, ছোট্ট বাচ্চাগুলোর পেট খারাপে ওদের ওষুধ কিন্তু মায়ের দুধই। শুধু পেট খারাপ সারিয়ে তোলা নয়, ডিহাইড্রেশনের হাত থেকেও বাঁচায়। অনেক চিকিৎসক এটাও বলে থাকেন যে, বাচ্চার পেট খারাপ বা ডাইরিয়া হলে ফরমুলা, অন্য কোনও দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্য বন্ধ করে মায়ের দুধই খাওয়াতে। ৬ মাসের নীচে বাচ্চার ওপর কোনও রকম অন্য টোটকা প্রয়োগ করা উচিত নয়। ডাইরিয়া বা পেট খারাপের লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা উচিত ও মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত।

#2. সাবুর জল: বাচ্চার বয়স ৬ মাসের ওপর হয়ে গেলে উপকারে আসতে পারে এই সাবুর জল। পরিমাণমতো সাবুদানা ঘণ্টাখানেক জলে ভিজিয়ে রাখুন। এবার পাত্রে জল নিয়ে সাবুদানা সমেত ফুটতে দিন। সাবুদানাগুলো নরম হয়ে আসা পর্যন্ত ফোটান। এবার গ্যাস থেকে নামিয়ে জলটা আলাদা করে নিন। ঠান্ড হলে বাচ্চাকে খাওয়ান (How to Stop Loose Motion Immediately)।

#3. ভাতের মাড়: পরিষ্কার করে ধুয়ে নেওয়া সাধারণ চাল জলের মধ্যে ফুটতে দিন। একটু বেশি নরম করে ভাত তৈরি করুন। এবার ভাতের থকথকে মাড়টা আলাদা করে নিন। ঠান্ডা করে বাচ্চাকে খাওয়ান (Baby Loose Motion Home Remedies)। বিস্বাদ লাগলে মিলিয়ে নিতে পারেন সামান্য রক সল্ট।

#4. মুড়ির জল: এই পদ্ধতি শুধু বাচ্চা কেন, আমরা কেউ এমন নেই যে পেট খারাপের সময় এটা খাইনি। মুড়ির জল শুধু বারবার মলত্যাগ করার হাত থেকে রেহাই দেয় তা নয়, পেট ঠান্ডা করে আরামও দেয়। পরিষ্কার পাত্রে মুড়ি নিয়ে সেটা জলে ভিজিয়ে রেখে দিন কিছুক্ষণ। এরপর মুড়িটা জলে চটকে নিয়ে ছাঁকনিতে ছেঁকে নিন। চামচে করে বাচ্চাকে খাওয়ান। ৬ মাস হয়ে গেলেই দিতে পারেবেন।

#5. ডালের জল: এই টোটকাটিও ৬ মাসের বেশি বয়সি বাচ্চাদের জন্য প্রযোজ্য এবং দারুণ কাজ করে। খোসা ছাড়ানো আনপলিশড মুগ ডাল ভালো করে ধুয়ে জল, এক চিমটে হলুদ আর এক চিমটে রক সল্ট মিলিয়ে কুকারে সেদ্ধ হতে দিন। ডাল সেদ্ধ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া না করে রেখে দিন। ডাল পাত্রের নীচে থিতিয়ে গেলে ওপরের জলটা তুলে বাচ্চাকে খাওয়ান।

আরও দুটো ফলের পিউরির রেসিপি দিলাম ছবিতে, যেগুলো দারুণ কাজ করে বাচ্চাদের পাতলা পায়খানার সমস্যায়। যেমন, আপেলে থাকা পেকটিন পেট খারাপের সময় পটি শক্ত হতে সাহায্য করে। ৬ মাস পেরোলেই দিতে পারেন। আমরা সাধারণ রেসিপিই দিলাম, তবে পেট খারাপের সময় ঘি, এলাচ, ফরমুলা বা গুড় কোনও পিউরিতে মেলাবেন না যেন! (Tips & Natural Remedies to Cure Loose motion in Babies)

 

আরও পড়ুন: ডায়রিয়া ও তার লেজুড় দোস্ত ডিহাইড্রেশন; কারণ ও ঘরোয়া ভাবে প্রতিকারের উপায়!

 

#6. ডাবের জল: বাচ্চাকে দিতে পারেন ডাবের জল। শরীরে জলের সাম্যতা বজায় রাখতে ভীষণ কার্যকরী এইটি।

#7. কাঁচকলা ও আলু সেদ্ধ: যে কোনও বয়সের মানুষের পেট খারাপ সারাতে কাঁচকলার ভূমিকা কতটা সেটা আর খুলে নাই বা বললাম। খুদের বয়স ৮ মাস পেরিয়ে গেলেই পেট খারাপ সারাতে কাঁচকলা দিন ওর পাতে। আলু, কাঁচকলা সেদ্ধ করে ওতে এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো ও রক সল্ট মিশিয়ে চটকে মেখে দিন। যদি কাঁচা হলুদ থাকে, তা হলে হলুদ গুঁড়োর পরিবর্তে অল্প কাঁচা হলুদ বেটে ওতে মেশান। ডালের জল, অল্প নরম ভাতের সাথে চটকে মেখে দিন এই হলুদ মেলানো আলু-কাঁচকলা মাখা।

#8. চিঁড়ে সেদ্ধ: ৬ মাস থেকে ৬০ বছর, সব বয়সের জন্য দারুণ এই চিঁড়ে সেদ্ধ। ডাইরিয়া বা পেট খারাপের সমস্যায় চিঁড়ে সেদ্ধ খুব ভালো কাজ করে। পাতলা চিঁড়ে ধুয়ে নিয়ে জলে একটু সেদ্ধ করে নিন। ঠাণ্ডা করে খাওয়ান।

#9. টক দই: বাচ্চার বয়স এক বছরের ওপর হয়ে গেলে ওকে দিন টক দই। এই টক দই দুগ্ধজাত দ্রব্য হলেও প্রবায়টিক হিসেবে কাজ করে ও শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সাম্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

#10. পোস্তবাটা: বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলে, ১.৫ বছরের ওপর বয়স হলে পোস্তবাটা খেতে দিন ওকে। পোস্ত স্বাদেও দারুণ আবার পেট খারাপের মতো বিপত্তিকে দূর করতেও সাহায্য করে। পাতলা কাঁচকলার ঝোল, আলুসেদ্ধ ও পোস্তবাটা দিয়ে ভাত খাইয়ে দিন দস্যিটাকে।

#11. আদা ও জায়ফল: এই টোটকা কিন্তু একটু বড় বাচ্চার জন্য কার্যকর। টাটকা আদা গ্রেট করে রসটা নিংড়ে নিন। ১ চা চামচ আদার রসে ১ গ্রাম মতো জায়ফল গুঁড়ো মেশান। আদার রস ও জায়ফল গুঁড়ো ভালো করে মিশে গেলে আধ কাপ জলের সাথে ভালো করে গুলে নিন। মিশিয়ে দিতে পারেন অল্প মধুও। বাচ্চাকে এই মিশ্রণ দিনে ২-৩ বার দিন। বাচ্চার বয়স ২ বছর পেরিয়ে গেলে তবেই দেবেন।

#12. নুন-চিনির জল: বাড়িতে থাকা ও আর এস হঠাৎ যদি ফুরিয়ে যায়, ঘাবড়ে যাবেন না একেবারেই। ডাইরিয়া, পেট খারাপের সমস্যায় নুন চিনির জল যে ও আর এস-এর থেকে কিছু কম নয়, সেটা সব্বাই জানেন। বাচ্চার বয়স ১ বছর পেরিয়ে গেলে তাই ওকে একটু একটু করে খাওয়াতে থাকুন নুন-চিনির জল। বাচ্চার বার বার পটি যাওয়ার প্রবণতা কমবে, আরাম পাবে ডায়রিয়ায় আবার ডিহাইড্রেশনও হবে না। এই নুন চিনির জল এতো উপকারী বলে একে ঘরোয়া ও আর এস ও বলা হয়।

 

 

বাচ্চার বমি বন্ধ করার ঘরোয়া প্রতিকার (Home Remedies for Vomiting in Babies)

 

#1. আদার সাথে মধু মিলিয়ে: এক চা চামচ পুদিনা পাতার রস, ১ চা চামচ মধুর সাথে কয়েক ফোঁটা পাতিলেবুর রস মেলান। বাচ্চাকে ২ থেকে ৩ বার খাওয়ান। ১.৫ বছরের নীচে বাচ্চাকে দেবেন না। শুধু যে বমিভাব বন্ধ হবে তাই নয়, পেটের সমস্যা থাকলে তাও মিটে যাবে।

গা-বমি ভাব বন্ধ করতে আদার আরও একটি টোটকা দিলাম ছবিতে ->

#2. ভাতের মাড়: গ্যাসট্রাইটিসের কারণে বমি হলে ভাতের মাড় খাওয়ালে সেরে যায়। ভাতের মাড় কীভাবে দেবেন তা আগেই বলে দিয়েছি। প্রয়োজন অনুযায়ী শিশুকে দিন।

#3. দারচিনি ও মধু: গা গোলানো, বমিভাব থেকে মুক্তি দিতে পারে দারচিনি চা। একটা পাত্রে জল নিয়ে দারচিনি গুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিন। ছেঁকে নিয়ে মধু মিলিয়ে দিন ওতে। অল্প ঠান্ডা করে বাচ্চাকে খাওয়ান (How to Stop Vomiting)। ১.৫ বছরের নীচে বাচ্চাকে দেবেন না।

#4. লবঙ্গ: বাচ্চা যদি চিবোতে শেখে, তা হলে গা গোলানো ভাব কমাতে ওকে লবঙ্গ চিবোতে বলুন। আর যদি বাচ্চা চিবোতে না পারে, তা হলে লবঙ্গ জলে ফুটিয়ে সেই জলটাও ওকে খাওয়াতে পারেন। এতে মিলিয়ে দিতে পারেন খাঁটি মধু। বাচ্চার বয়স ১.৫ বছর পেরলে তবেই দিন।

#5. জিরা ও মৌরি: কিছুটা মৌরি জলে ১০-১৫ মিনিট ফুটিয়ে জলটা ছেঁকে নিন। বাচ্চার গা গোলানো ভাব ও বমি বন্ধ করতে ওকে দিনে ৩-৪ বার খাওয়ান। বাচ্চার বয়স ১ বছর পেরলে তবেই দিন। একইভাবে দিতে পারেন জিরে ফোটানো জল।

 

বিশেষ কিছু টিপস:

  • পেট খারাপের সমস্যা বা বমির সমস্যায় বাচ্চাকে বেশি পরিমাণে জল এবং তরল জাতীয় জিনিস খাওয়ান।
  • বাচ্চাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং ওকে ফোটানো/পরিশুদ্ধ জল খাওয়ান।
  • এই ধরনের সমস্যা এড়াতে খাওয়ার আগে জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার অভ্যেস গড়ে তুলুন ওর মধ্যে।
  • যদি দেখেন বাচ্চা বারবার পটি করে নেতিয়ে পড়ছে বা খুব জ্বর আসছে, দেরি না করে ডাক্তার দেখান।
  • ঘরোয়া টোটকার প্রয়োগ করবেন প্রথম ২-৩ দিন। এতে কাজ না হলে, বা বাচ্চার অসুখ বেড়ে গেলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। (Home Remedies for Vomiting & Loose Motion in Babies)

 

আরও পড়ুন: কোষ্ঠকাঠিন্যে নাজেহাল বাচ্চার বেহাল পেটের হাল ফেরাতে কী খাওয়াবেন, কী খাওয়াবেন না!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null