খুব সমস্যায় পড়েছে নন্দিতা আর সুপর্ণ। আগামীকাল ওদের আবার এক কঠিন পরীক্ষা। পরীক্ষাটা যে এত কঠিন হতে পারে, এটা ওরা আগে বুঝতে পারেনি। কিন্তু গত মাসে প্রথম বার টের পেল বিষয়টা যতটা সহজ হবে বলে ভেবেছিল, ততটাও হচ্ছে না। সবে মাত্র বাবা-মা হয়েছে ওরা। সব নতুন বাবা-মা’র মতোই ওদেরও চিন্তা একটাই, কী করে ওদের জীবনের নতুন অতিথি অন্তুকে সুস্থ করে বড় করে তুলবে। আর এই ‘সুস্থ’ থাকার পিছনে ভ্যাকসিনেশন বা ইমিউনাইজেশন (Vaccination or Immunization)-এর একটা বড় ভূমিকা আছে। চিকিৎসকের করে দেওয়া তালিকা মিলিয়ে একদম ক্যালেন্ডার ধরে ভ্যাকসিন দিতে হবে অন্তুকে। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সব বাবা-মা’ই যান। এর মধ্যে বিরাট অভিনবত্ব কিছু নেই। কিন্তু অন্তু-নন্দিতা আর সুপর্ণর প্রথম সন্তান। তাই এই জাতীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আগে যেতে হয়নি ওদের। এবং অভিজ্ঞতাটা যে মোটেই সুখকর নয়, তা ওরা গত মাসে টের পেয়েছে। গত মাসে অন্তুর প্রথম ভ্যাকসিন নেওয়ার দিন ছিল। সকালবেলা ঠিকঠাক সময়ে ভ্যাকসিন তো নেওয়া হল। কিন্তু তারপর থেকেই অন্তুর জ্বর। ডাক্তারবাবু অবশ্য বলেছিলেন, এমনটা হতেই পারে। সেই জ্বর পরের দিনের আগে কমল না। তার সঙ্গে সে কি কান্না! খিদেও উধাও। (Tips to reduce pain or swelling after vaccines shots in Babies in Bangla, tikar por bachhar byatha komanor upay, sishur tikakoron/tika o tar side-effect.Vaccination pain in babies and tips to reduce in Bengali.)
এই গোটা ঘটনা থেকে নন্দিতা আর সুপর্ণ বেশ হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে, অন্তুর ভ্যাকসিনের দিনগুলো তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো হতে চলেছে। তবে এই সমস্যা শুধুমাত্র তাদের দু’জনের নয়, প্রত্যেক বাবা-মা’ই জানেন তাঁদের সন্তানদের ভ্যাকসিন দেওয়ানোর মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে দুটো নেই। তবে এই যন্ত্রণা কমানোর কিছু উপায়ও আছে। সেগুলো মাথায় রাখলেই আপনার সোনার ব্যথার অনেকটা উপশম করতে পারবেন।
পরিবেশে নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে। সেগুলো যে কোনও মুহূর্তে শিশুর শরীরে ইনফেকশন তৈরি করতে পারে। ভ্যাকসিনেশন বা ইমিউনাইজেশন হল সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শিশুকে এই আক্রমণগুলোর জন্য আগাম প্রস্তুত রাখা যায়। ভ্যাকসিন শিশুর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে। তাই সঠিক সময়ে শিশুর ভ্যাকসিনেশন না-হলে, তার বিপদ ঘটতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশেই এখন ভ্যাকসিনেশন না-করানোর বিষয়েও সওয়াল করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, শিশুরা নিজে-নিজেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম। কিন্তু তাঁদের এই দাবি এখনও সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত নয়।
ভ্যাকসিন দেওয়া হলেই শিশুর বেশ কয়েকটি সমস্যা হতে পারে। এর প্রতিটাই সাময়িক। কিন্তু তার পরেও এগুলোর জন্য বাবা-মায়ের প্রস্তুত থাকা উচিত। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে জানা থাকলে, তার উপশম সম্পর্কেও প্রস্তুত থাকা যাবে।
আরও পড়ুনঃ হঠাৎ বিপদে শিশুকে সুস্থ করবেন কী করে? কখনই বা যেতে হবে ডাক্তারের কাছে!
এবার দেখে নেওয়া যাক,
কীভাবে ছোট্টসোনার ভ্যাকসিনের ব্যথা বা অস্বস্তি কমাবেন (Ways to relieve babies vaccination pain):
#1. ঘনঘন খাওয়ান: শিশুর মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া গেলে তার ব্যথার বোধটা খানিক কমে যেতে বাধ্য। তাই ভ্যাকসিন দেওয়ার পর, ওকে ঘনঘন খাওয়াতে থাকুন। বিশেষ করে স্তন্যপান করানোটা তো খুব দরকারি। খাওয়ার দিকে মন দিলে ব্যথার কথাটা ভুলে থাকবে আপনার সোনা। তা ছাড়া খাওয়ানোর ফলে ওর শরীরে জলের পরিমাণ বাড়বে। শরীর হাইড্রেটেড থাকবে। তাতে ব্যথা দ্রুত কমবে।
#2. আদর করুন: পরিসংখ্যান বলছে, শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে থাকলে কম কাঁদে। ফলে ভ্যাকসিনের পর আপনার সোনাকে নিজের কাছে রাখুন। ওকে একটু বেশি মাত্রায় আদর করুন। এমন কিছু করুন, যাতে ও খুব খুশি থাকে। তা হলে ওর ব্যথার দিকে মন যাবে না।
#3. চিনির জল: যে সব বাচ্চার বয়স ছ’মাসের নীচে, তাদের জন্য এই পদ্ধতি খুবই কার্যকারী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিনির জল শরীরে গেলে ভ্যাকসিনেশনের সময় শিশুরা কম ব্যথা পায়। ওকে ভ্যাকসিন দেওয়ানোর আগে, ওর মুখে কয়েক ফোঁটা চিনির জল দিন। তা ছাড়া চুসির মধ্যে মিষ্টি জল রেখে ওর মুখে দিতে পারেন। তবে কীভাবে এই জল দেবেন, তাতে মিষ্টির পরিমাণ কতটা হবে, তা চিকিৎসকের থেকে ভালো করে বুঝে নিন। আর চিনির জল দেওয়ার কত ক্ষণ আগে বা পরে ওকে স্তন্যপান করানো যাবে, সেটাও জেনে নিতে ভুলবেন না।
#4. অ্যাসেলুলার বা ব্যথাবিহীন ইনজেকশন: এখন অনেক নতুন ধরনের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। যার মধ্যে অনেকগুলোকে অ্যাসেলুলার ভ্যাকসিন বলা হয়। এগুলোতে ব্যথার পরিমাণ অনেকটাই কম হয়। আপনার সোনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এই ধরনের ভ্যাকসিন দেওয়াতে পারেন ওকে। তবে একটাই সমস্যা এক্ষেত্রে, অন্য যে ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়, তার তুলনায় এই ধরনের ভ্যাকসিনের দাম একটু বেশি। তবে কম্বিনেশন ভ্যাকসিনও পাওয়া যায়। যার দাম অ্যাসেলুলার ভ্যাকসিনের তুলনায় কম, পাশাপাশি সাধারণ ভ্যাকসিনের তুলনায় এতে ব্যথাও কম হয়। খরচ নিয়ে চিন্তা না-থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, এই রাস্তায় যেতে পারেন।
#5. মালিশ করুন: ইনজেকশন দেওয়ার জায়গাটায় খুব অল্প চাপ দিয়ে টানা মালিশ করতে থাকুন। এতে ওখানে রক্তসঞ্চালন বাড়বে। তার ফলে ব্যথার দ্রুত নিরাময় হবে।
#6. বেশি হাঁটা নয়: বেশির ভাগ ভ্যাকসিন শিশুর পায়ে দেওয়া হয়। এরপর যদি তারা বেশি হাঁটাহাটি করে, তা হলে ব্যথা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই চেষ্টা করুন ওকে কোলে তুলে রাখতে। যদি সেটা সম্ভব না-হয়, তা হলে এমন কিছু দিয়ে ব্যস্ত রাখুন, যাতে ও খুব বেশি চলাফেরা না-করতে চায়।
#7. ভুলিয়ে রাখুন: ব্যথা কাটানোর এটা আরও একটা রাস্তা। চেষ্টা করুন আপনার সোনার মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে। ওর পছন্দের খেলনা বা বই ওর হাতে তুলে দিন। যদি তেমন কিছু না-থাকে, তা হলে ওকে কোলে নিয়ে নিজেই গুনগুন করে গান গাইতে থাকুন। তার সঙ্গে ওকে হালকা করে দোলান। দেখবেন, ওর মন অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছে। ফলে ব্যথার বোধটা অনেকটাই কমে যাবে।
#8. বরফের ব্যবহার: বরফের ব্যবহার শুনে ভাববেন না, শিশুর ইনজেকশনের জায়গায় আইস-প্যাক বা সরাসরি বরফ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কারণ এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। ইনজেকশনের জায়গায় সরাসরি বরফ দিলে ব্যথা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বরং এক টুকরো বরফ প্রথমে নিজের হাতের তালুতে ঘষে নিন। তারপর আপনার হাতের ঠান্ডা তালু দিয়ে সোনার ইনজেকশনের জায়গায় আলতো করে চাপড় দিতে থাকুন। এই ঠান্ডার অনুভূতি ওর ব্যথা কমিয়ে দেবে অনেকটাই।
#9. ব্যথা কমানোর ক্রিম: এখন শিশুদের এই জাতীয় সমস্যার সুরাহার জন্য নানা ধরনের ব্যথার মলম বা ক্রিম পাওয়া যায়। এই ধরনের ক্রিম ব্যবহার করার আগে ওর চিকিৎসকের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলে নেবেন। তবে এই ক্রিমের ব্যবহারে ব্যথা অনেকটাই কমে।
#10. নিজে শান্ত থাকুন: মনে রাখবেন, আপনার খোকা-খুকু যদি এই অবস্থায় দেখে, আপনি খুব উত্তেজিত হয়ে রয়েছেন, তা হলে ওর ব্যথা আরও বাড়বে। কারণ সে ভয় পেয়ে যাবে। বরং এমন একটা ভাব নিয়ে থাকুন, যেন কিছুই হয়নি। গোটাটাই খুব স্বাভাবিক। এটা হলে ওর ভয় কমবে।
#11. বেশি সময় কাটান: ওকে একটু বেশি সময় দিন। ওকে নিয়ে খেলা করুন। ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করুন। তা হলে ব্যথার অনুভূতি অনেকটাই কমে যাবে।
#12. প্যারাসিটামল ড্রপ: এখন অনেক চিকিৎসকই ভ্যাকসিনেশনের ব্যথা কমাতে শিশুদের তরল প্যারাসিটামল দেন। এটাও খুব কাজের। কিন্তু এই জাতীয় ওষুধ দেওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে নিন।
যাই-হোক আর তাই-হোক না কেন, ভ্যাকসিনেশনের ব্যথায় তো শিশুমাত্রই ভোগে। কিন্তু এই নিয়ে অযথা ভয় পাবেন না। বরং নিজে শান্ত থাকুন এবং আপনার ছোট্টসোনাকে শান্ত রাখুন। তার সঙ্গে উপরে উল্লেখ করা পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে দেখুন। খুব সহজেই আপনার সোনা হয়ে উঠবে ভ্যাকসিন-বীর!
আরও পড়ুনঃ ছোট্ট বাচ্চার যেসব শারীরিক উপসর্গ এড়িয়ে গিয়ে ভুল করেন অধিকাংশ বাবা-মায়েরা
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null