নার্স এসে রিম্পিকে দীক্ষার কোলে তুলে দিল। এইমাত্র ওর ঘুম ভাঙল। এখন দুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। মাত্র একদিন আগে রিম্পি এই পৃথিবীর আলো দেখেছে। প্রথমবার মা হওয়ার পর দীক্ষার জীবনেও যেন এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। দুধ খাওয়ানোর সময় এটাই ভাবছিল দীক্ষা। হঠাৎই ও লক্ষ করল রিম্পির নাভি থেকে কিছুটা চামড়া উঠে আছে। গতকাল শরীর খুব ক্লান্ত থাকায় ওর চোখে পড়েনি। পাশে দাঁড়ানো নার্সকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ওটা মায়ের নাড়ির অংশ। কিছুদিন পর শিশুর দেহ থেকে ওটা ঝরে যায়। (Umbilical Cord Care Cleaning and Signs of Infection)
নার্সিংহোম থেকে ছুটির দিন দেবাঞ্জন এসেছিল। চিকিৎসক বাবা-মাকে বলে দিচ্ছিলেন কী ভাবে ছোট্ট সোনার যত্ন নিতে হবে। তিনিই বুঝিয়ে দিলেন কর্ড স্টাম্পের যত্ন কী ভাবে নেওয়া উচিত।
কথায় আছে, নাড়ির টান। এই নাড়িই আসলে চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় আম্বিলিকাল কর্ড। আম্বিলিকাল কর্ড গর্ভাবস্থার সময় মায়ের প্লাসেন্টা থেকে তৈরি হয়। মায়ের শরীরের সঙ্গে ভ্রুণের যোগাযোগ এই কর্ডের মাধ্যমেই হয়। বিশেষজ্ঞদের কথায়, গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের বৃদ্ধির সম্পূর্ণটাই এই কর্ডের উপর নির্ভরশীল। কারণ এই কর্ডের মধ্যে দিয়েই মায়ের শরীর থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিদ্রব্য ভ্রুণের শরীরে যায়। শিশুর জন্মের পর কর্ডটি শিশুর নাভির কাছ থেকে কেটে দেওয়া হয়।
কর্ডটি যখন চিকিৎসক কাটেন তখন রং থাকে হলদে-সবুজ। কাটার পর ধীরে ধীরে শুকিয়ে এটি কালো হয়ে যায়। জন্মের পর সাধারণত সাত থেকে ২৮ দিনের মধ্যে এটি ঝরে যায়। ঝরে যাওয়ার সময় সামান্য হলুদ বা স্বচ্ছ তরল বের হয়। এর মধ্যে নার্ভ না-থাকায় ঝরে পড়ার পর কোনও ব্যথা অনুভূত হয় না। বিশেষজ্ঞদের কথায , অনেক সময় কর্ডটি পড়ে যাওয়ার পর নাভির অংশে কিছু টিস্যু থেকে যায়। একে বলা হয় আম্বিলিকাল গ্রানুলোমা। এই গ্রানুলোমা নিজে থেকে ঝরে না-গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে এটি ঝরাতে হয়।
আম্বিলিকাল কর্ড যতদিন না, ঝরে যাচ্ছে, ততদিন এটির যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। কীভাবে এর যত্ন নিতে হয়? জিজ্ঞেস করেছিল দীক্ষা। চিকিৎসক এর যত্ন নিতে বেশ কয়েকটি টিপস্ বলে দিলেন।
#1. পরিস্কার রাখুন: আম্বিলিকাল কর্ড না-ঝরা পর্যন্ত পরিষ্কার রাখা জরুরি। কোনও কারণে এতে ময়লা জমলে বা এটি আঠা-আঠা হয়ে গেলে কাপড় দিয়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কারের সময় কোনও রকম সাবান ব্যবহার করতে নিষেধ করেন চিকিৎসকরা। এতে কর্ডে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এছাড়া সাবান ব্যবহার করলে ছোট্ট সোনার ত্বকেরও ক্ষতি হয়।
#2. স্পঞ্জ দিয়ে স্নান: কর্ড স্টাম্প না-শুকোনো পর্যন্ত নাভিতে জল লাগানো খুদের জন্য ক্ষতিকর। জল লাগলে স্টাম্পটিতে যে কোনও রকম ইনফেকশন হতে পারে। জন্মের পর চিকিৎসকরা এই কারণেই সোনামণিকে বাথটবে স্নান করাতে নিষেধ করেন । বাথটবের স্নানের বদলে এই সময় ছোট্ট শরীরটা ভালোমতো স্পঞ্জ করে দেওয়া উচিত। স্পঞ্জ করানোর সময় খেয়াল রাখুন যাতে কর্ড স্টাম্পে জল না-লাগে।
#3. স্টাম্প শুকনো রাখুন: স্টাম্প ঝরে না-পড়া পর্যন্ত এটি সব সময় শুকনো রাখা প্রয়োজন। তবে স্পঞ্জ করিয়ে দেওয়ার সময় কর্ড স্টাম্পে জল লেগে যেতে পারে। স্পঞ্জ করার পরে ছোট্ট খোকাখুকুকে খোলা হাওয়ার মধ্যে কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখুন। এতে স্টাম্পে জল লেগে থাকলে তা শুকিয়ে যাবে।
#4. খোলামেলা পোশাক পরান : পোশাক আঁটোসাঁটো হলে কর্ড স্টাম্পে চাপ পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে যা একেবারেই উচিত নয়। খুদেকে আঁটোসাঁটো পোশাকের পরিবর্তে খোলামেলা পোশাক পরান। এতে কর্ড স্টাম্পের উপর অযথা চাপ পড়ে না (Newborn Umbilical Cord Care)। খুকুমণির পোশাক কেনার সময়ও আঁটোসাঁটো নয় এমন পোশাকই কিনুন।
#5. সাবধানে ডায়পার পরান: ডায়পার পরানোর সময় কখনোই কর্ড স্টাম্পটি ঢেকে দেওয়া উচিত নয়। তলপেটের উপর থাকা ডায়পারের অংশ অনেকসময় কর্ড স্টাম্পকে ঢেকে দেয়। ডায়পারটি পরানোর আগে ওই অংশটি গোল করে কেটে নিন। এতে কর্ড স্টাম্প ঢাকা পড়বে না।
#6. তুলে ফেলার চেষ্টা নয়: অনেক বাবা-মাই অধৈর্য হয়ে কর্ড স্টাম্পটি তুলে ফেলার চেষ্টা করেন বা হাত দিয়ে দেখেন কতটা আলগা হয়ে এল। বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্ড স্টাম্পে বারবার এমন করলে ছোট্ট সোনার নাভির ক্ষতি হতে পারে। বরং এটিকে নিজে থেকে ঝরে যেতে দেওয়াই উচিত।
আরও পড়ুন: ছোট্ট বটে কিন্তু ধার খুব। সংক্রমণ, আঁচড় এড়াতে আজই শুরু করুন কচি নখের যত্নআত্তি!
#7. হাত পরিষ্কার রাখুন: শিশুর অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় কর্ড স্টাম্প যথেষ্ট সেনসিটিভ হয়। অপরিষ্কার হাতে কর্ড স্টাম্প ধরলে সহজেই ইনফেকশন ছড়িয়ে যায়। এই কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলেন, কর্ড স্টাম্পে হাত দেওয়ার আগে সব সময় ভালো হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিন (Caring for Your Newborn’s Umbilical Cord Stump)।
বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রে কর্ড স্টাম্প কোনওরকম ইনফেকশন ছাড়াই শুকিয়ে যায়। তবে স্টাম্প অত্যন্ত সেনসিটিভ। তাই চিকিৎসকের কথায়, এতে ইনফেকশন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। দীক্ষা জিজ্ঞেস করলো, যদি ইনফেকশন হয় কী করে তা বোঝা সম্ভব? চিকিৎসক তার উত্তরে বলে দিলেন বেশ কিছু লক্ষণের কথা।
নাভির সঙ্গে ছোট্ট শরীরের শিরা উপশিরার সরাসরি সংযোগ থাকে। তাই কর্ড স্টাম্পে কোনও রকম সংক্রমণ হলে তা সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে। রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে খুদের প্রাণসংশয়ও হতে পারে। তাই উপরের কোনও একটি লক্ষণ চোখে পড়লে দেরি না-করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
জন্মের ১৪ দিনের মাথায় রিম্পির কর্ড স্টাম্প ঝরে পড়ে। এখন ওর বয়স প্রায় চার মাস। নাহ্, কর্ড স্টাম্প পড়ে যাওয়ার সময় কোনওরকম সংক্রমণ হয়নি। দীক্ষাই হতে দেয়নি। প্রথমবার বাবা-মা হলেও ও আর দেবাঞ্জন রিম্পির ব্যাপারে সবসময় তটস্থ। স্নান, পোশাক পরানো, সবদিকেই কড়া নজর ছিল ওদের। এখন ওরা প্ল্যান করছে রিম্পির অন্নপ্রাশনে কী মেনু করা যায়! (Umbilical Cord Care Cleaning and Signs of Infection)
আরও পড়ুন: যেভাবে যত্ন নিলে সুন্দর হয় শিশুর চুল
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null