একটা মেয়েকে যে কত যন্ত্রণা আর কষ্ট সহ্য করে একটা ফুটফুটে, একরত্তি প্রাণের জন্ম দিতে হয়, তা বোধ করি আরেকজন মা-ই বুঝতে পারেন। একথা অনস্বীকার্য যে, একজন মা প্রসবের চরম যন্ত্রণা ভোগের পর তার নিজের সন্তানকে দেখে শারীরিক কষ্ট অনেকটাই ভুলে যায়; কিন্তু সেই নতুন মায়ের শরীর আসলে খুবই দুর্বল থাকে। গর্ভাবস্থা থেকেই মেয়েদের শরীরে নানারকম পরিবর্তন শুরু হয় আর সেই লড়াইটা শেষ হয় বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পরে। মায়ের শরীর সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সবার শারীরিক অবস্থা সমান না হওয়ার জন্য, এই সেরে ওঠার সময়টা প্রত্যেকের জন্য আলাদা। এছাড়াও, বাচ্চা নর্মাল ডেলিভারি হয়েছে, না সি সেকশন হয়েছে, এর ওপরও মায়ের সেরে ওঠার সময় নির্ভর করে। পরিস্থিতি যেমনই হোক, নতুন মা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারলে আর সহানুভূতির কয়েকটা হাত নিজের চারপাশে পেলে এক-দুই মাসেই সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রসবের পর কী করলে আপনি ঝটপট চনমনে হয়ে উঠবেন আর নতুন উদ্যমে আপনার জ্যান্ত পুতুলের সাথে খেলতে পারবেন, তারই কিছু উপায় বাতলে দিচ্ছি আমরা। (Tips to speed up postpartum recovery)
প্রসবের পরেই ৮-১০ ঘণ্টা মায়ের সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। মায়ের যদি নর্মাল ডেলিভারি হয় এবং কোনও শারীরিক জটিলতা না থাকে, তা হলে ডাক্তাররা অল্প অল্প হাঁটাচলা শুরু করতে বলেন। নতুন মা যদি সম্পূর্ণ শুয়ে না থেকে, সামান্য হাঁটাচলা করেন, তা হলে জরায়ুর ভিতর যে রক্ত জমে থাকে, তা বের হয়ে যায়। প্রস্রাব বা মলত্যাগের মতো দৈনন্দিন কার্যকলাপে মায়ের কষ্ট আস্তে আস্তে কমতে থাকে। বাচ্চা যখনই ঘুমবে, আপনিও ঘুমিয়ে নিন বা বিশ্রাম নিয়ে নিন। কারণ,পরে এটা হতেই পারে যে বাচ্চা আপনাকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছে। যখনই ঘুম পাবে বা বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছে হবে, তা করুন। দরকারে বাড়ির অন্য সদস্যদের বাচ্চাকে দেখতে বলুন। প্রসবের পরে দুই থেকে তিনমাস কোনও ভারী কাজ ও পরিশ্রমের কাজ করবেন না। যেসব মায়ের সি সেকশন হয়েছে, তারা সেলাই শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত খুবই সাবধানে থাকবেন। এই মায়েদের যদি ডাক্তার বেশি হাঁটাচলা করতে বারণ করেন, তা হলে তা না করাই ভালো।
প্রসবের সময়, নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে, অনেকসময় পেরিনিয়াম ফেটে যায় বা কাটতে হয়। বাচ্চা বেরিয়ে গেলে এই স্থান সেলাই করে দেওয়া হয়। এই সেলাই শুকোনোর জন্য জায়গাটি পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখা প্রয়োজন। প্রতিবার বাথরুমে যাওয়ার পর, এই স্থানটি ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং পরিষ্কার কাপড় দিয়ে শুকিয়ে নিন। অনেকে এই স্থানে আরাম পেতে কাপড়ে বরফ মুড়ে সেঁক দিয়ে থাকেন। প্রসবের পরে মেয়েদের রক্তস্রাব শুরু হয়। এসময় উন্নতমানের ভালো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করুন। কিছু সময় পরপরই এই ন্যাপকিন পাল্টে ফেলুন যাতে আপনার সেলাই বেশীক্ষণ রক্তে ভিজে না থাকে। সি সেকশন যাদের হয়, সেলাই শুকোতে তাদের তো ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খেতেই হয়। নর্মাল ডেলিভারিতেও ডাক্তাররা অনেকসময় ওষুধ খেতে বলেন। এছাড়াও, পরিষ্কার জামাকাপড় পরুন, স্নান করুন। তবে খেয়াল রাখবেন, সেলাই-এর স্থান যেন জল না পায়। ডাক্তারের কথামতো পেটের কাটা স্থান পরিষ্কার করুন এবং ওষুধ লাগান।
এসময় স্তন ভারী ও বড় হয়ে যায়। প্রতিদিন স্নান করার সময় ভালো করে স্তন পরিষ্কার করুন। এতে নিপল পরিষ্কার থাকবে ও দুধ বেরোনোর ছিদ্র বন্ধ হবে না। অনেক সময় স্তনে দুধ বেশি হয়ে ব্যথা হতে পারে। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর পরেও যদি এই অস্বস্তি থাকে, তা হলে বুকের দুধ কিছুটা করে ফেলে দিন। বাচ্চার মুখের ঘর্ষণেও নিপল ছড়ে যেতে পারে ও ব্যথা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান। নরম ও ভালো মানের কাপড়ের নার্সিং ব্রা ব্যবহার করুন। ব্রা নিয়মিত পরিবর্তন করুন এবং পরিষ্কার করে কেচে দিন। হাল্কা গরম সেঁক দিলেও স্তনের ব্যথায় আরাম পাবেন।
সঠিক খাওয়াদাওয়াও একজন মাকে জলদি সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। শরীরকে আর্দ্র রাখুন, প্রতিদিন প্রায় ৮-১০ গ্লাস জল খান। প্রসবের পরেই তেলমশলা দেওয়া খাবার বা ভাজা খাবার খাবেন না। অল্প তেলে রান্না করা ও সহজপাচ্য খাবার খান। মাংস খেলে চিকেন স্যুপ খেতে পারেন। খাবারে যেন কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন সঠিক মাত্রায় থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। শাক সবজি, ডিমের সাদা অংশ, ফল এসব খাওয়া শরীরের জন্য উপকারী আবার সঠিক ডায়েট মেনে চললে বুকের দুধের পরিমাণও বাড়ে। মনে রাখবেন, মায়ের খাদ্যাভ্যাসের ওপর বুকের দুধের গুণগত মান ও পুষ্টিগুণের হেরফের হয়। কাজেই নিজের জন্য তো বটেই, বাচ্চার জন্যও সঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করুন। কোনও রকম অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় খাবেন না। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য নতুন মাকে সহজে কাবু করতে পারে না।
বাচ্চার জন্মের পরে অনেকেই নিজের প্রতি আর যত্নশীল থাকেন না। কিন্ত জানেন তো, আপনার একরত্তিকে বড় করে তোলার পিছনে একজন মা হিসেবে আপনার অবদান কতখানি? কাজেই নিজের শরীরকে কখনওই অবহেলা করবেন না, নিজেকে সুস্থ করে তুলুন। যে কোনও রকম অসুবিধার কথা আপনার জীবনসঙ্গীকে জানান। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলুন ও তাদের কথা মেনে চলুন। কোনও পরিস্থিতিতেই নিজে নিজে কোনও ভিটামিন বা ব্যথার ওষুধ খাবেন না। কিছুমাস পর্যন্ত নিয়মিত ডাক্তার দেখান।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null