বাচ্চার নজর সারাক্ষণ মোবাইল ফোন বা টিভির স্ক্রিনে? কতটা ক্ষতি হচ্ছে জানেন?

বাচ্চার নজর সারাক্ষণ মোবাইল ফোন বা টিভির স্ক্রিনে? কতটা ক্ষতি হচ্ছে জানেন?

বছর চারেকের বুবলাইকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির বিনয় আর ইশা। না, খাওয়া নিয়ে কোনও ঝামেলা করে না; অহেতুক আবদার করে বাড়ি মাথায় করে না; আপাতদৃষ্টিতে ভারী ভালো এবং শান্ত বাচ্চা সে! কিন্তু এই শান্ত হয়ে থাকার পিছনে যার হাত; তাকে নিয়েই চিন্তায় পড়েছে বুবলাইয়ের বাবা-মা। বোঝেননি তো এখনও? বুবলাই আসলে মোবাইল ফোন, টিভি, ল্যাপটপ ছাড়া আর কিচ্ছুটি চায় না। (Reliable Ways To Reduce Screen Time For Your Child)

এইসব ইলেক্ট্রনিক আধুনিক জিনিস ওর হাতে দিয়ে দিন, ব্যস ঘণ্টার পর ঘণ্টা ও কাটিয়ে দেবে চুপচাপ। হাঁ করে গিলবে স্ক্রিনে ভেসে চলা সব কাণ্ডকারখানা। টিভির সামনে থেকে ওকে নড়ানোই মুশকিল। হাত থেকে মোবাইল ফোনটি বা বাবার ল্যাপটপটি সরিয়ে নাও; বুবলাইয়ের শান্ত ভোল বদলে অশান্ত হতে ২ সেকেন্ডও লাগবে না।

আর এখানেই সব গোলমালের সূত্রপাত। স্ক্রিন টাইম বেড়ে যাওয়া অর্থাৎ টিভি, ফোন বা ল্যাপটপ/কম্পিউটার ইত্যাদি নিয়ে বেশি সময় কাটানো যে বাচ্চার চোখ এবং স্বাস্থ্যের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে; সে কি আর আলাদা করে বলতে হবে?

আধুনিক যুগের যেসব গ্যাজেট ছাড়া আমাদের দিন চলে না, বাচ্চার মস্তিষ্কের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে তারাই; অবশ্যই বেশি ব্যবহার করলে। মাঝেসাঝে সময় বেঁধে মোবাইল ঘাঁটা বা টিভিতে কার্টুন দেখা এতে কোনও সমস্যা না হলেও অতিরিক্ত হয়ে গেলে বা এটা নেশায় পরিণত হয়ে গেলে কিন্তু বিপদ অবশ্যম্ভাবী। (Tips for Limiting Your Child’s Screen Time )

বাচ্চার অতিরিক্ত টিভি দেখা, মোবাইল ফোন নিয়ে ঘাঁটা বা ল্যাপটপ নিয়ে কারিকুরি করা কীভাবে কমাতে পারেন, তারই কয়েকটি ফন্দি বাতলে দেবো আমরা; আজ এই প্রতিবেদনে। বাচ্চার খাতিরে না হয় একটু সময় খরচ করে পড়েই ফেলুন।

 

অতিরিক্ত টিভি দেখা, ফোন নিয়ে বসে থাকার কুপ্রভাবগুলি কী কী? (Why to Avoid TV, Mobile Phones for Infants & Toddlers)

  • খেলনা নিয়ে খেলা, দৌড়-ঝাঁপ করা বা বন্ধুদের সাথে খেলা ইত্যাদি শারীরিক পরিশ্রম কমে যায় বলে বাচ্চা মোটা হয়ে যায়। বাড়ন্ত বয়সে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মোটা হয়ে যাওয়া প্রভাব ফেলে অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজেও।
  • ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখের স্বাস্থ্য। একটানা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের ওপর চাপ পড়ে।
  • বাচ্চা কারও সাথে মিশতে শেখে না, অসামাজিক হয়ে যায়।
  • নতুন কিছু শেখার আগ্রহ কমে যায় ওর মধ্যে।
  • বাস্তববাদী হতে পারে না। বাস্তবের সাথে টিভিতে দেখা অনুষ্ঠান মেলাতে গিয়ে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে।
  • কোনও কিছু প্রোগ্রাম যা ছোট মনে ভয় সৃষ্টি করে বা নেগেটিভিটি তৈরি করে; সেরকম কিছু দেখলে মানসিক ভারসাম্য টালমাটাল হয়ে যায়।
  • অনেক অনুষ্ঠান বাচ্চাদের মনে নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। বিচার করে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে না ছোট্ট বাচ্চাগুলোর মধ্যে। তাই অনেকক্ষেত্রেই টিভির অনুষ্ঠানের বা মোবাইল ভিডিওর অনুসরণ করতে গিয়ে
  • বাচ্চা উদ্ধত, জেদি হয়ে পড়ে।
  • মস্তিষ্কের নিজে ভাবনাচিন্তা করার সময়টাও কেড়ে নেয় অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম। তাই মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হয়।

 

কীভাবে আয়ত্তে আনবেন বাচ্চাকে? (Effective Ways to Limit Your Kids’ Screen Time)

#1. বদলে ফেলুন নিজেকে: বাচ্চার ওপর যা বিধিনিষেধ লাগাবেন, নিজেও মেনে চলুন। বাচ্চারা যা দেখে সেটাই অনুসরণ করে। কাজেই বাচ্চার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন নিয়ে বসে থাকবেন না বা ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখে বা পড়ে হাসবেন না। এতে বাচ্চার মনে অহেতুক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। বেঁধে নিন টিভি দেখার সময়ও। কোনও উত্তেজক শো/সিনেমা, বাচ্চার দেখার উপযুক্ত নয় এমন প্রোগ্রাম ওর সামনে চালাবেন না। বেডরুমে টিভি কিন্তু একদম নয়!

 

আরও পড়ুন: ছোট্ট সোনার মন ও শরীরের বিকাশে কোন বয়সে, কোন খেলনা দরকারি

 

#2. বেঁধে দিন সময়: বাচ্চাকে যে একটুও টিভি দেখতে দেবেন না বা মোবাইল হাতে দেবেন না, এমন কিন্তু বলিনি। শুধু মাথায় রাখুন আধঘণ্টা মানে আধঘণ্টা। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়েই সে টিভি দেখবে বা হাতে ফোন পাবে। তাতে যদি হাজার চিৎকারও করে, আপনি কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না। (How to Manage Your Child’s Screen Time)

#3. বাচ্চা ভোলাতে টিভি/মোবাইল নয়: জানি, বাচ্চাকে খাওয়ানো বলুন বা ভোলানো; টিভি দেখিয়ে বা ফোন হাতে দিলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু তাতে আপনার হয়তো সাময়িক লাভ হবে; বাচ্চার অভ্যেস ধীরে ধীরে বিগড়ে যাবে। তাই বায়না বা ঝোঁক দমনের অস্ত্র হোক গল্প, গান আর আপনার ধৈর্য। কোনও গ্যাজেট নয়।

#4. বাচ্চার সাথে সময় কাটান: বাচ্চার সাথে সময় কাটান। ওর সাথে খেলতে যান, গল্প পড়ে শোনান, নিজের ঘরের টুকটাক কাজে ওকে সাহায্য করতে শেখান বা দেশ-বিদেশের ছবি দেখান বইতে। এতে বাচ্চার শরীর ও মন ভালো হবে তাই শুধু নয়; অন্যের প্রতি দরদি হয়ে বেড়ে উঠবে ও। (Tips on How to Reduce your Children’s Screen Time)

#5. প্রথম থেকেই লাগাম টানুন: ‘ঠিক আছে, একটা দিন করুক’। এভাবে একটা একটা করে কবে যে অনেকদিন হয়ে যাবে; তা আপনি টেরটিও পাবেন না। তাই নিয়ম নিয়মের মতোই রাখুন। শৃঙ্খলাবোধ এবং সময়জ্ঞান ছোট থেকে পুঁতে দিন বাচ্চার মধ্যে।

#6. সৃজনশীল কাজ শেখান: বই পড়া, ছবি আঁকা, গাছ লাগানোর মতো কাজ শেখান ছোট্ট বয়স থেকেই। মানসিক চিন্তাধারার উন্নতি ঘটবে এখান থেকেই আর গ্যাজেট নিয়ে মাতামাতিও কমবে। (Techniques for Managing Your Child’s Screen Time)

#8. সজাগ থাকুন সবসময়: বাচ্চা টিভিতে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখে কি না বা মোবাইলে কার্টুন বা পশু-পাখির মজাদার ভিডিওই দেখে কি না; এটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব কিন্তু আপনার।

#9. ধৈর্য ধরুন: বাচ্চা যদি এসবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে; একবারে সব বন্ধ করে দেবেন না বা বকাঝকা করবেন না। ধৈর্য ধরে, সময় নিয়ে বোঝান। নিজের রুটিন বদলে ফেলুন আমূল। সকালে উঠেই ফোন নিয়ে না বসে নিউজ পেপার খুলে বসুন দেখি, বাচ্চা আপসেই বদলে যাবে।

#10. উপকারিতা ও অপকারিতা বোঝান: টিভি বা ফোনে যে শুধু খারাপ অনুষ্ঠান দেখা যায় বা বাজে গেম খেলা যায়; এমন তো নয়। এমন অনেক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হয় যা বাচ্চাদের দেখা দরকার। আবার, এমন অনেক গেম আছে যাতে বাচ্চার মেধা ক্ষুরধার হয়। (Reliable Ways To Reduce Screen Time For Your Child)

তবে খারাপ দিকও কম নেই আর উত্তেজক প্রোগ্রামেরও কমতি নেই। বাচ্চাকে খারাপ ভালো দুই বোঝাতে চেষ্টা করুন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন আপনার অনেকটা ধৈর্য। তবে এভাবে ছোট থেকে খারাপ- ভালো বোধ গড়ে দিতে পারলে বাচ্চার বিচারশক্তিও সময়োপযোগী হয়।

বাচ্চা মানুষ, যা শেখাবেন তাই শিখবে ধীরে ধীরে। তাই কোনও বাজে অভ্যাস ধরে ফেললে আর দেরি নয়; সজাগ হন প্রথম থেকেই। আর যদি অ্যাডিকশন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে মনে হয়; টুক করে কেবল কানেকশনটাই ৩ মাসের জন্য কেটে দিন দেখি। বাচ্চাটাও শুধরোবে আবার আপনার ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্সটাও ফুলে ফেঁপে উঠবে। (Reliable Ways To Reduce Screen Time For Your Child)

 

আরও পড়ুন: সন্তানের গুড হ্যাবিটস গড়ে তুলতে পারেন আপনিই, বলছেন মনোবিদরা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null