কলিক খুবই স্বাভাবিক এক সমস্যা, আপনার পুঁচকের জন্য সমাধানও বাড়িতেই আছে

কলিক খুবই স্বাভাবিক এক সমস্যা, আপনার পুঁচকের জন্য সমাধানও বাড়িতেই আছে

মিষ্টির জন্মের সময় সবই স্বাভাবিক ছিল। শ্রীময়ী আর অর্পণও প্রথম সন্তানের মুখ দেখে খুব খুশি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই এক সন্ধের দিকে মিষ্টির প্রচণ্ড কান্না। একদিন, দু’দিন, প্রায়দিনই এমনটা হতে লাগল। মিষ্টির ডাক্তার বললেন, ও নাকি ‘কলিক বেবি’। মানে, সহজে যাকে বলা যেতে পারে, ঘনঘন পেটে ব্যথা হয়, এমন বাচ্চা। তবে এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, এমনটা চার-ছয় মাস বয়স পর্যন্ত চলবে। কিন্তু চিন্তা নেই বললেই তো আর চিন্তা যায় না। ডেলিভারির পর এমনিতেই শরীর দুর্বল, তার উপর মিষ্টির কান্না শ্রীময়ীকে মাঝে মাঝেই ডিপ্রেসড  করে দিত। তবে চিকিৎসক যেমন বলেছিলেন, তেমনটাই হল। এই পর্বটা বেশি দিন টেকেনি। মিষ্টির যখন চারমাস হল, কান্নাও বন্ধ হয়ে গেল ধীরে ধীরে। (Colic: Symptoms, Reasons and Home Remedies To Treat Colic In Babies in Bengali, Bachchar colic hole kibhabe samlaben, Colic-er lokkhon, karon ar chikitsa.Symptoms, Reasons and Home Remedies To Treat Colic In Babies in Bengali.)

 

 

শিশুর কলিক পেইন-এর ঘরোয়া সমাধান! (Home Remedies To Treat Colic In Babies)

 

শুধু শ্রীময়ীই এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল ভাবছেন? মোটেই না। বরং প্রায় সব বাবা-মায়েরাই এমন পরিস্থিতিতে পড়েন। তবে কলিক কিন্তু ক্ষতিকর কিছু নয়। এমনকী ভবিষ্যতে শিশুর উপর কোনও প্রভাব পড়তে পারে, এমনটাও ভাববেন না। তবে কলিকের লক্ষণ জানা না থাকলে প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ধরতেই সমস্যা হয়। তাই দেখে নেওয়া যাক কলিক হলে ঠিক কী কী লক্ষণ ফুটে ওঠে বাচ্চার হাবেভাবে‌।

 

 

কলিক হওয়ার লক্ষণ (Symptoms of Colic in Bangla)

  • একই সময় কান্না (crying at same time): কলিক হলে বাচ্চা প্রতিদিনই একইসময় কাঁদে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কান্নার সময়টা হয় বিকেলবেলা নয়তো সন্ধের সময়।

 

  • প্রচন্ড কান্না (intense crying): কলিক হলে বাচ্চার কান্না একদম আলাদা হয়। এই সময় বাচ্চা প্রচণ্ড চেঁচিয়ে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল হয়ে যায়। অনেক বাচ্চাই কাঁদতে কাঁদতে পা পেটের কাছে তুলে নিয়ে আসে। কেউ কেউ তো হাত মুঠো করে রাগ দেখিয়ে কাঁদে।

 

  • ঘুমে অনিয়ম (irregular sleeping): শুধু কান্নাই নয়, কান্নার জন্য বারোটা বেজেছে ঘুমেরও। ঠিক সময়ে কিছুতেই একরত্তিকে ঘুম পাড়ানো যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত ঘুম  না হওয়ায় ছোট্ট সোনা কান্নকাটিও বেড়ে যাচ্ছে। এই অনিয়ম কিন্তু কলিকেরই লক্ষণ।

 

  • বমি, ডায়রিয়া (vomiting, diarrhea): কান্নার সঙ্গে বমি হচ্ছে মাঝে মাঝেই। বাচ্চার মল দেখে বুঝতে পারছেন ডায়রিয়া হয়েছে শিশুর। কলিক হলে এই ঘটনাগুলো স্বাভাবিক।

 

  • একশোর উপর জ্বর (high fever): কাঁদতে কাঁদতে কাহিল হয়ে পড়েছে ছোট্ট শরীরটা। এতদূর তাও ঠিক ছিল। কিন্তু ছোট্ট শিশুর তাপমাত্রাও যে বাড়তে শুরু করেছে। থার্মোমিটারে একশোর দাগ ছাড়িয়ে যাচ্ছে জ্বর। কলিকের কারণেই এমনটা হচ্ছে।

 

  • অসময়ে খাবার অভ্যাস (irregular feeding): ছোট্ট সোনার কান্না থামছেই না। এদিকে দুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে কান্না যখন থামল তখন দুধ খাওয়ানো গেল। এই কয়েকদিনে দুধ খাওয়ার সময়টাই ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। কলিক হলে এমনটা হয়ে থাকে। তবে সময় ওলটপালট হলেও চিন্তা নেই। কারণ বাচ্চা কলিকের আগে প্রতিদিন যতটা দুধ খেত, ততটাই খাবে।

 

  • পেটে বায়ু (wind pass): কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎই বাচ্চার পেটের গ্যাস বেরিয়ে গেল। আপনি বুঝতে পারছেন না, কী সমস্যা হচ্ছে আপনার বাচ্চার। পেট থেকে গ্যাস বেরিয়ে যাওয়া কলিকের সময় স্বাভাবিক ঘটনা। শুধু এটাই নয়, কান্নার সময় বাচ্চার মুখের দু’পাশ দিয়ে লালাও গড়াতে থাকে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।

 

আরও পড়ুনঃ বমি, পেট খারাপ? বাচ্চার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

 

কীভাবে বুঝবেন বাচ্চার কলিক হয়েছে, তা তো বোঝা গেল। কিন্তু কেন প্রায় সব শিশুরই কলিক হয়, তার কারণ নিয়ে ডাক্তাররা এখনও নিশ্চিত নন। তাও বেশকিছু সম্ভাবনার কথা তাঁরা বলেন।

 

 

দেখে নেওয়া যাক, কী কী কারণে আপনার ছোট্ট সোনার কলিক হতে পারে (Reasons behind colic)

 

  • অপরিণত খাদ্যতন্ত্র (immature digestive system): বাচ্চার খাদ্যতন্ত্র বড়দের মতো পরিণত নয়। আর সে কারণেই দুধ খাওয়ালে তা ঠিকঠাক হজম না হয়েই চলে যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে। এর জন্য পেটে গ্যাস তৈরি হয়। যার জন্য বাচ্চা কান্নাকাটি করে।

 

  • অ্যাসিড রিফ্লাক্স (acid reflux): দুধ খাওয়ার পর অনেক সময় বাচ্চার খাদ্যতন্ত্র তা ঠিকঠাক হজম করতে পারে না। ফলে পাকস্থলীতে গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস খাদ্যনালী বেয়ে উঠে আসে উপরের দিকে। গ্যাস একাই উঠে আসে না। পাকস্থলীতে হজমকারী যে অ্যাসিড জমা হয়, তাকেও ঠেলে তুলে আনে। এই দুয়ের ব্যথা সহ্য করতে না পেরেই ছোট্ট সোনা কেঁদে ওঠে।

 

  • দুধের সঙ্গে হাওয়া ঢুকছে (Ingesting gas while feeding): ছোট্ট একরত্তি শুয়ে শুয়ে দুধ খাচ্ছে। শুয়ে দুধ খেতে গিয়ে তার পেটে দুধের সঙ্গে হাওয়ায় চলে যাচ্ছে। এই হাওয়াই পেটে গ্যাস তৈরি করছে।

 

  • দুধে অ্যালার্জি (milk-allergic): শুনেই ঘাবড়াবেন না। বাচ্চার খাদ্যতন্ত্র অপরিণত বলে অনেকসময় ল্যাকটোজ সহ্য করতে পারে না (lactose intolerant)। তাই দুধে অ্যালার্জি থেকেও কলিক হতে পারে। চিকিৎসক এই বিষয়ে ভালো করে পরামর্শ দিতে পারবেন আপনাকে।

 

  • মায়ের ধূমপান (smoking in pregnancy): গর্ভবতী মায়েদের কখনও ধূমপান করা উচিত নয়। এমনকী বাচ্চা যতদিন স্তন্যপান করছে, ততদিনও ধূমপান একদম নিষেধ। মা যখন গর্ভধারণ করছেন, তারপর থেকে যতদিন তিনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁর ধূমপান করা উচিত নয়। করলে তার প্রভাব পড়ে শিশুর শরীরে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন কলিকের আরেকটি কারণ হতেই পারে মায়ের ধূমপান।

 

  • সংবেদনশীল শিশু (sensitive baby): ছোট্ট সোনারা অনেক সময়ই খুব সংবেদনশীল বা সেনসিটিভ হয়। চারপাশে আওয়াজ বা পরিবেশ যদি তার পছন্দ না হয়, তা হলে তার মধ্যে কলিকের প্রবণতা বাড়ে।

 

এই কারণে আপনার সোনা এমন গলা ফাটিয়ে কেঁদেই চলেছে। শুনে হয়তো অবাকই হচ্ছেন, তাই না। তবে কারণের পাশাপাশি এর সমাধানগুলোও  তো জেনে নিতে হবে। চলুন দেখে নেওয়া যাক,

 

 

কীভাবে বাড়িতে আপনিই বাচ্চার কলিক সারাতে পারবেন। (Home remedies for Colic in Bengali)

 

#1. উঁচু করে খাওয়ান (feed at upright position): বাচ্চাকে শুইয়ে দুধ খাওয়ালে সহজে বাচ্চার পেটে দুধের সঙ্গে হাওয়া ঢোকে। তা বলে তো দু’-তিন মাসের একরত্তিকে বসিয়ে দুধ খাওয়ানো যায় না। তাই দুধ খাওয়ানোর সময় ওর মাথাটা একটু উঁচুতে রেখে দুধ খাওয়ান। ওকে আপনার কোলে শুইয়ে নিজের থাই জুড়ে নিয়ে অল্প উপরে তুলুন। থাইয়ে ওর মাথাটা রাখলে, সেটাও এই সঙ্গে উঁচুতে উঠে যায়। অনেকটা আরামকেদারায় বসানোর মতো করে ওকে বসিয়ে নিতে পারেন এভাবে। তারপর দুধ খাওয়ালে সহজে পেটে হাওয়া ঢুকবে না।

 

#2. গ্যাস বের করান (burp your baby): প্রতিবার খাওয়ানোর পর বাচ্চার পেটের গ্যাস বের করান। শুয়ে খেতে হয় বলে খাওয়ার সময় বাচ্চার পেটে দুধের সঙ্গে হাওয়া ঢোকে। তাই খাওয়া হলে বাচ্চাকে কাঁধে শুইয়ে পেট আর পিঠ মালিশ করে দিন। এতে গ্যাস বেরিয়ে যাবে।

 

# ‌3. প্যাডলিং এক্সারসাইজ (peddling exercise): পেটের গ্যাস যাতে বেরিয়ে যায়, তার অন্য উপায়ও আছে। বাচ্চাকে খাটে শোওয়ান। এরপর ছোট্ট পা দুটো সাইকেল প্যাডলিং-এর মতো একবার ভাঁজ করুন আর একবার সোজা করুন। দেখবেন কিছুক্ষণেই পেটের গ্যাস বেরিয়ে গেছে।

 

#4. পরিবেশ শান্ত রাখুন (keep calm): ওইটুকুর শিশুর মনেও পরিবেশের প্রভাব পড়ে। তার চারপাশে শব্দ যত কম হয় ততোই ভালো। তাই বাচ্চার চারপাশের পরিবেশ শান্ত রাখুন।

 

#5. হেঁটে আসুন (keep in motion): বাচ্চাও কিন্তু বোর হয়। তাই একভাবে শুইয়ে না রেখে তাকে নিয়ে হাঁটুন। চাইলে অল্পসময়ের জন্য বাইরে ঘুরেও আসতে পারেন। এতে বাচ্চা সহজে শান্ত হবে।

 

#6. বডি মাসাজ করুন (body massage): সংবেনশীল শিশুর মনে স্ট্রেস তো হবেই। তাই প্রতিদিন বডি মাসাজ অয়েল দিয়ে বাচ্চাকে ভালোভাবে মাসাজ করুন। হোল বডি মাসাজ বাচ্চার স্ট্রেস বা মনের চাপ কমাতে সাহায্য করে। ফলে সহজে বাচ্চার মেজাজ খিটখিটে হবে না। কান্নাকাটিও দূরে থাকবে।

 

#7. পেটেও মাসাজ করুন (belly massage): যদি গ্যাসের কারণে আপনার ছোট্ট সোনার এত কান্না হয়, তবে মাসাজে সে অনেক আরাম পাবে। পেটের অংশে মাসাজ করার সময় গোলকার বৃত্তে হাত ঘুরিয়ে মাসাজ করুন। মাসাজ অয়েলে মেশাতে পারেন পিপারমিন্ট অয়েলের দু’-এক ফোঁটা। মাসাজ করলে পেটের গ্যাস সহজে বেরিয়ে যায়।

 

#8. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন (consult with doctor): কান্নার সঙ্গে বমি, ডায়রিয়াও হচ্ছে বাচ্চার? এই কলিক তো বাড়িতে একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। বাচ্চার জ্বর একশোর উপর উঠে গেলেও তাই করুন।

 

কলিক বাচ্চাকে ভবিষ্যতে খিটখিটে মেজাজের করে তুলবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কলিক হলে আপনি নিজেই তা সারিয়ে তুলতে পারবেন। তবে অবস্থা যদি জ্বর, বমির মতো সিরিয়াস হয়, চিকিৎসকের কাছে যেতে কিন্তু ভুলবেন না।

 

আরও পড়ুনঃ কচি বাচ্চার কচি পেটে গ্যাসের সমস্যা ও প্রতিকার

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null