অন্যের হাতে ছোট্ট বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার আগে জেনে রাখুন এই তথ্যগুলো

অন্যের হাতে ছোট্ট বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার আগে জেনে রাখুন এই তথ্যগুলো

৫টা মাস ধরে যাকে এক মুহূর্ত কাছ ছাড়া করেননি, রাতে ঘুমোতে ঘুমোতেও ৫ বার উঠে দেখতেন সে ঠিকভাবে ঘুমোচ্ছে কি না, যে কাঁদতে শুরু করলে আপনার পৃথিবীতে ভূমিকম্প শুরু হয়; তাকেই বাড়িতে রেখে এবার আপনাকে বাইরে বেরোতে হবে রোজ। কোলের একরত্তিটিকে ছেড়ে জীবিকায় মনোনিবেশ করতে মায়ের মন একেবারেই সায় দেবে না। কিন্তু সন্তানকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্যই বাবার সাথে তাল মিলিয়ে অর্থ উপার্জন করতে হবে মাকেও। মনে হাজার কষ্ট চেপে ছোট্ট সোনাকে বাড়িতে রেখে এবার আপনাকে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি  যে শেষ হতে চললো!এখন জীবিকার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে দাদু-ঠাম্মা-কাকু-পিসিদের নিয়ে সরগরম যৌথ পরিবার পরিণত হয়েছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে। তাই ছোট্ট বাচ্চাগুলোকেও বেড়ে উঠতে হয় সদা ব্যস্ত মা আর বাবাকে নিয়েই। সবই মানিয়ে গুছিয়ে হয়তো চলা যায়, গোল বাঁধে মায়ের ম্যাটারনিটি লিভ শেষ হয়ে গেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দাদু-ঠাকুমা বা দাদুভাই-দিদুনরা  একটানা এসে বাচ্চার কাছে থাকতে পারেন না। মনের টান ১০০ ভাগ থাকলেও বাদ সাধে তাঁদের বয়স আর দূরত্ব।(Steps to finding a Super Babysitter in Bangla. Bacchar jonyo aaya khojar shorto. Super Babysitter for your baby in Bengali.)

 

অগত্যা উপায়, এমন একজন মানুষকে বাড়িতে নিয়ে আসা, যে কিনা নিজের বাচ্চার মতো ভালোবেসে যত্ন করবে তাদের বাচ্চাটিকেও। আগলে রাখবে সারাটা দিন। যারা এই জীবিকার সাথে যুক্ত, তাদের কিন্তু খুব সুন্দর একখানি নাম আছে। পোশাকি ভাষায় “বেবিসিটার” বা “ন্যানি” বা আয়া বলা হয় তাদের। ভারতীয় সংস্কৃতিতে আমরা সব্বাইকে আপন করে নিতে ভালোবাসি, তাই আপনি আপনার বাচ্চার বেবিসিটারকে সম্মান দিয়ে “দিদি”, “মাসি” বা “ম্যাডাম” বলে ডাকতেই পারেন।

 

বাচ্চার দেখভালে লোক খুঁজছেন? জেনে নিন উপযুক্ত গৃহকর্মী খুঁজে নেওয়ার শর্ত! (Steps to finding a Super Babysitter)

মায়ের মন সবসময় যেন মন্দটাই আগে দেখতে পায়। নানারকম খবরে একলা বাচ্চাদের সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সব দুর্ঘটনা অস্থির করে তোলে তাদের। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষের কাছে কীভাবে সারাদিন রেখে যাবেন তাদের নাড়ি-ছেঁড়া ধনকে, এই ভাবনাতেই আকুল হয়ে যান তারা। তবে কী জানেন, চোখ-কান খোলা রেখে এবং নিজের বিচার-বিবেচনা কাজে লাগিয়ে যদি একটু সন্ধান করেন, তা হলেই কিন্তু আপনার বাচ্চার জন্য পারফেক্ট বেবিসিটার খুঁজে পাবেন। বাচ্চার জন্য বেস্ট বেবিসিটার বা বাচ্চাকে সর্বক্ষণের দেখভালের কাউকে কাজে বহাল করার আগে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক হবেন,দেখে নিন একনজরে।

 

#1. ভালোভাবে নিজের হোমওয়ার্ক শুরু করুন:আপনার ম্যাটারনিটি লিভ শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকে বাচ্চাকে কার কাছে রেখে যাবেন, সে বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিন। বাচ্চার জন্য পারফেক্ট সঙ্গী খোঁজার ক্ষেত্রে মাথায় রাখুন এই বিষয়গুলি;

 

  • রেফারেন্স কাজে লাগান: ভরসাযোগ্য বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করুন। তাদের চেনাজানা যদি কেউ থাকে, তা হলে সবথেকে ভালো হয়। এক্ষেত্রে একদম অজানা মানুষের সাথে মোলাকাত করতে হবে না আপনাকে। যোগাযোগ করতে পারেন কোনও সেন্টারেও। এই সেন্টারগুলি থেকে যেসব বেবিসিটার আসেন, তারা বাচ্চা সামলানোর ক্ষেত্রে বেশ অভিজ্ঞ ও পাকাপোক্ত হয়ে থাকেন।

 

  • সঠিক পদ্ধতিতে ইন্টারভিউ নিন: হ্যাঁ, একদম ঠিক শুনেছেন। বাচ্চার সুরক্ষার খাতিরে ইন্টারভিউ নিতেই হবে আপনাকে। কাউকে ইন্টারভিউ করার সময় লক্ষ্য রাখুন এই বিষয়গুলিতে,

 

1.শিক্ষাগত যোগ্যতা। ছোট্ট বয়স থেকেই বাচ্চার রুচিবোধ ও শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠে।প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষিত ও রুচিশীল একজন মানুষের সাথে যদি বাচ্চা সময় কাটায়,তা বাচ্চার স্বভাব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেবে।

 

2.সমস্ত পরিচয়পত্র ও নাগরিকত্বের প্রমাণ ভালোভাবে যাচাই করুন। দুই কপি ফটো সমেত সমস্ত জেরক্স কপি আপনার কাছে রাখুন।

 

3.ইন্টারভিউ চলাকালীন তিনি বাচ্চার সাথে কীভাবে মিশছেন তা লক্ষ্য রাখুন। বাচ্চাকে ওর মতো করে বোঝার ধৈর্য বা ক্ষমতা ওনার আছে কি না, বোঝা যাবে এখান থেকেই।

 

4.প্রাথমিক ফার্স্ট-এড এবং সিপিআর(CPR) জানা জরুরি।

 

5.লক্ষ্য রাখুন পরিচ্ছন্নতার ওপরেও। বাচ্চাকে যার কাছে ছেড়ে যাবেন, তাকে যে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, এ কথা আর আলাদা করে নাই বা বললাম।

 

6.বাচ্চাদের নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বা আগের কাজের অভিজ্ঞতা শুনুন তার মুখ থেকেই। পরে যাচাই করে নিতে পারেন।

 

7.পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী তিনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন,ছোটখাটো প্রশ্ন করে বুঝে নিন। যেমন আপনি প্রশ্ন করলেন “বাচ্চা কিছুতেই খেতে চাইছে না ও প্রচণ্ড কাঁদছে, কী করবেন আপনি?” যার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, তার উত্তর শুনে পটুত্ব বোঝার চেষ্টা করুন।

 

  • অভিজ্ঞতা ও ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করুন: বাচ্চার স্বার্থে আপনাকে পরিশ্রম করতেই হবে। যে কোনও বেবিসিটার বহাল করার আগে তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, বেবিসিট করার কারণ এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা ভালো করে খতিয়ে দেখুন। উনি যদি আগে কারও বেবিসিটার ছিলেন, তা হলে প্রয়োজনে তার বাড়ি গিয়ে কথা বলে আসুন।

 

  • কাউকে ফাইনাল করার আগে কিছুদিন যাচাই করুন: যদি কাউকে আপনার মনে ধরে, আপনি কাজে যোগ দেওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে তাকে বাচ্চাকে দেখতে বলুন। এতে তিনটে লাভ হবে। প্রথমত, বাচ্চা আপনি সামনে থাকতে থাকতে ওনার সাথে পরিচিত হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, আপনি কীভাবে বাচ্চাকে দেখেন বা কীভাবে ওর যত্ন নিয়ে থাকেন, উনি সেটা বুঝতে পারবেন। তৃতীয়ত, উনি কীভাবে আপনার বাচ্চার দেখভাল করছেন বা বাচ্চা ওনাকে পছন্দ করছে কি না, তা আপনি বুঝে যাবেন। ওনার কাজের পদ্ধতি পছন্দ হলে ফাইনাল করে দিন নিশ্চিন্তে। হাতে সময় রেখে কাজ করুন।

 

আরও পড়ুনঃ ছোট থেকেই শুরু হোক নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা, জেনে নিন কৌশল

 

#2. একজন বেবিসিটার কী কী নির্দেশ মেনে চলবেন?

  • বেবিসিটিং করার আগে, অর্থাৎ বাচ্চাকে একা ঘরে একা সামলানোর আগে বাচ্চা ও মা-বাবার সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত হয়ে যাবেন।
  • মা-বাবা যেভাবে নির্দেশ দেবেন, বাচ্চাকে ওই ভাবেই যত্ন করবেন। এমারজেন্সি এলে নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী অবস্থা সামাল দেবেন।
  • বাচ্চাকে খেলাবেন, নানারকম গল্প বলবেন ও বাচ্চাকে খেলতে খেলতে পড়াশোনার পাঠও দেবেন।
  • ফার্স্ট এড ট্রেনিং না থাকলে সত্বর নিয়ে নেওয়া।
  • বাচ্চা সারাদিন কী করে, কেমনভাবে থাকতে পছন্দ করে, তা মায়ের কাছে জেনে নেওয়া।
  • বাচ্চা ঘুমালে একটু সময় পরপর তাকে দেখে আসা বা সে ঠিকভাবে ঘুমোচ্ছে কি না তা দেখা।
  • সমস্ত বিপদজনক জিনিস থেকে বাচ্চাকে দূরে রাখা।

 

 

#3. একজন বেবি সিটারের যা কখনই করা উচিত নয়?

  • বাচ্চাকে কখনও একা ছাড়া।
  • বাচ্চাকে খেলতে বসিয়ে ফোনে গল্প করা বা টিভি দেখা বা ফোনে ব্যস্ত থাকা।
  • বাচ্চা যা খায় না সেটা বাচ্চাকে খেতে দেওয়া। বাচ্চার খাবার তার মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী না বানিয়ে তাতে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি মেশানো।
  • বাচ্চাকে নিজের এঁটো খেতে দেওয়া।
  • বাচ্চাকে ভয় দেখানো,উল্টোপাল্টা বাজে গল্প শোনানো।
  • ধূমপান বা মদ্যপান করা।
  • বাড়ি ফাঁকা পেয়ে নিজের বন্ধুদের ডেকে গল্প করা।

 

 

#4. বেবিসিটারকে কী কী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানো আপনার অবশ্য কর্তব্য?

  • বাচ্চার খাওয়ার রুটিন।
  • কোনও খাবারে বাচ্চার এলারজি থাকলে তার নাম বলে দেওয়া।
  • বাচ্চার নিয়মিত ওষুধের রুটিন।
  • বাচ্চার বিশেষ কোনও শারীরিক অসুবিধা থাকলে।
  • আপনি কীভাবে আপনার বাচ্চাকে যত্ন করতে চান।
  • আপনাদের দু’জনের মোবাইল ফোন নম্বর।
  • বাড়ির লিখিত ঠিকানা।
  • আপনাদের কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা ও যোগাযোগের উপায়।
  • বাড়ির চাবি কোথায় রাখা থাকে, কোনও এমারজেন্সি হলে ওনাকে যাতে অসুবিধায় না পড়তে হয়।
  • একজন পরিচিত ডাক্তারের ফোন নম্বর।
  • বাচ্চার ওষুধপত্র কোথায় থাকে এবং ফার্স্ট এড বক্স কোথায় রাখেন, সেই নির্দিষ্ট জায়গাটি।
  • কোন কোন পরিস্থিতিতে উনি নির্দ্বিধায় আপনাদের ফোন করতে পারেন।

 

একটু সতর্ক হয়ে, বিশ্বস্ত সূত্র ধরে বেবিসিটার বা আয়া বহাল করুন। দেখবেন, বাচ্চার যত্নে কোনও ত্রুটি হবে না। তবে, মায়ের মন কি না, সবসময় খুঁতখুঁত করে। তাই বাড়তি মানসিক শান্তি পেতে বাড়িতে ইনস্টল করতে পারেন “ন্যানি ক্যামেরা” বা “সিটার ক্যামেরা”। এর মাধ্যমে অফিসে বসেই আপনি দেখতে পাবেন বাড়িতে বাচ্চা কীভাবে বেবিসিটারের সাথে সময় কাটাচ্ছে, তাও সবার অজান্তে। আপনিও নিশ্চিন্ত আর বাচ্চাও সুরক্ষিত। সতর্ক হয়ে বিশ্বাস করতে শিখুন, শুধু বেবিসিটার বাছাই কেন, জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই কম ঠকবেন!

 

আরও পড়ুনঃ যৌথ বা অণু পরিবার, কচি-মনের চাহিদা মেটানোই শেষ কথা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null