বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় কোন কোন বই তুলে দেবেন আপনার সন্তানের হাতে!

বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় কোন কোন বই তুলে দেবেন আপনার সন্তানের হাতে!

অস্মিতা একজন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট। প্রতিদিনই চেম্বারে নানান সমস্যা নিয়ে হাজির হন বাবা-মায়েরা। গত শুক্রবারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল তেমনই এক দম্পতি, ঐশী ও ঈশান রায়ের। তাঁদের একমাত্র সন্তানের বয়স এখন চার বছর। পেশায় তাঁরা দু’জনেই ইঞ্জিনিয়ার। তাই কাজের সূত্রে বাড়ির বাইরেই বেশির ভাগ সময় কাটে। (Top Children’s Story Books)

ঐশীই প্রথমে বললেন, আমরা চাই যে সময়টা আমরা দু’জন বাড়ির বাইরে থাকি, সেই সময়টা আমাদের ছেলে যেন একটা ভালো সঙ্গ পায়। যেহেতু ও সিঙ্গল চাইল্ড, ওর কোনও খেলার সঙ্গী নেই। এখন কোন জিনিসটি ওকে ভালো সঙ্গ দেবে তা আমরা বুঝতে পারছি না। অস্মিতা প্রথমেই বললেন, আপনাদের ছেলের বয়স চার বছর হয়ে গিয়েছে। আপনাদের কথা অনুযায়ী বাংলাও সে কমবেশি বুঝতে পারে। একজন পেরেন্টিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি তাই বলব, বই-ই এই সময় তার যথার্থ সঙ্গী হতে পারে।

 

বইই কেন সবচেয়ে সেরা সঙ্গী, সময় কাটানোর সেরা বন্ধু! (Why Book Can Be a Company)

বইয়ের কথা শুনে ঐশী ও ঈশান দুজনেই একটু নড়েচড়ে বসলেন। অস্মিতা বললেন, একজন শিশুর জন্য শুধু সঙ্গই সব নয়। এই বয়সটা চারপাশের সমস্ত কিছু শুষে নেওয়ার সময়। আপনি ওকে চিৎকার করে বকাঝকা করলেও, সে সেটাও শুষে নেবে। তাই সঙ্গ এমন হওয়া উচিত যাতে তার সময়ও কাটে, একই সঙ্গে মানসিক বিকাশও হয়। এই বয়সে শিশুর কল্পনাশক্তি যত উস্কে দেওয়া যায়, ততই ওর ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতা বাড়বে। তাই এই সময় বই ওকে ঠিকঠাক সঙ্গ দিতে পারে।

ঈশান জিজ্ঞেস করলেন, কোন কোন বইগুলো ওর জন্য বেছে নেওয়া যায় যদি বলে দেন। ওর বয়সের বাচ্চাদের জন্য বাংলায় লেখা কোনও বই কি আছে? অস্মিতা হেসে বললেন অবশ্যই আছে। আমি আপনাদের বেশকিছু বইয়ের নাম বলে দিচ্ছি । সেই বইগুলো বাজারে সহজেই পাওয়া যায়।

 

বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় কোন বই তুলে দেবেন সন্তানের হাতে! (Books that Can Keep Company to a Single Child)

#1. ঠাকুমার ঝুলি: দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের লেখা এই বইটি আজকের বই নয়। আজ থেকে ১০০ বছর আগে এটি প্রকাশিত। বাংলার ঘরে ঘরে ঠাকুমায়েরা যে গল্পগুলো শোনাতেন সেগুলোই বইটিতে ছাপানো হয়েছিল। এই বইটির গল্পগুলোতে ছড়িয়ে রূপকথার দেশের নানা কাহিনি। সেই দেশের মানুষগুলো, পশুপাখিগুলো কী করত, কোথায় ঘুরে বেড়াত—সেসব গল্প নিয়েই ঠাকুমার ঝুলি।
এই গল্পগুলো ছোটদের মনেও তেমনই রূপকথার দেশ তৈরি করে। তাদের সেই জগতের একজন করে তোলে। ঠাকুমার ঝুলি তাই শুধু সঙ্গ নয়, ছোট্ট সোনাকে কল্পনা করতেও শেখায়। এমন শিশুও আছে ব্যাঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, লালকমল-নীলকমলের গল্প না-শুনলে যাদের ঘুম আসতে চায় না।

#2. ঠাকুরদাদার ঝুলি: ঠাকুমার মতোই ঠাকুরদাদাও তার খুদে নাতি-নাতনিদের গল্প শোনান। কখনও সে গল্প মজার, কখনও বা প্রচণ্ড ভয়ের। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ছোট্ট সোনার মন ভরে ওঠে বাঁধ ভাঙা আনন্দে। কারণ কল্পনার ওই দেশগুলোয় হারিয়ে যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা।
ঠাকুরদাদার ঝুলি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের আরেক সৃষ্টি। এর গল্পগুলোও একইভাবে প্রচলিত প্রত্যেক বাড়ির ঠাকুরদাদার মুখে। তাই ছোট্ট সোনার জন্য বই কেনার কথা ভাবলে এই বইটি তালিকা থেকে বাদ দিলে চলবে না।

#3. টুনটুনির বই: দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের পর যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তাঁর লেখা অধিকাংশ বইই ছোটদের জন্য। এর মধ্যে ঐশী ও ঈশানের ছেলের বোঝার জন্য উপযুক্ত হল টুনটুনির বই।
টুনটুনির গল্প কোনও রূপকথার গল্পের মতো নয়। বরং এই বই আমাদের চারপাশে থাকা পশুপাখিদের নিয়েই লেখা। সোনামণি এই বইয়ে শুধু আনন্দের জগত খুঁজে পাবে না, বরং সে বুঝতে শিখবে মানুষের মতো পশুপাখিদেরও প্রাণ আছে, তাদের মধ্যেও রাগারাগি, কান্নাহাসি, সুখ-দুঃখ আছে। টুনটুনি ও নাপিতের কথা, টুনটুনি ও রাজার কথা তাদের সারাটা দিন যেমন মাতিয়ে রাখবে। তেমনই নরহরি দাসের গল্প তাদের শেখাবে বিপদের সময় কী ভাবে বুদ্ধির ব্যবহার করতে হয়।

#4. হাসিখুশি: ‘অ এ অজগর আসছে তেড়ে/ আমটি আমি খাব পেড়ে/ ইঁদুরছানা ভয়ে মরে/ ঈগল পাখী পাছে ধরে।’
এই ছড়ার মাধ্যমেই ছোট্টবেলায় অআকখ-এর সঙ্গে অনেকের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এবার পালা ছোট্ট সোনাদের। তারাও এমন মজার ছড়ার মধ্যে দিয়ে বাংলা অক্ষর শিখে নেবে।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার এটা ভেবেই আজ থেকে ১০০ বছর আগে লিখেছিলেন এই ছড়াগুলো। ছড়াগুলো যেমন সোনামণিকে আনন্দ দেবে, তার সঙ্গে সময় কাটাবে, তেমনই শিখিয়ে দেবে তার মাতৃভাষার প্রথম ধাপ।

#5. গুপী গাইন বাঘা বাইন: কিছু বই শুধু শিশুদের মধ্যেই নয় বড়দের মধ্যেও সমান জনপ্রিয় । তেমনই একটি বই হল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর যুগান্তকারী লেখা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। এই বইতে দুই বন্ধু গুপী আর বাঘা ভূতের বর পেয়ে নানা মজার কান্ড ঘটায় (Story Books for Kids)।
ছোট্ট সোনা ভূতের ভয় পেলেও এই বইয়ের ভূতকে তার বেশ পছন্দ হবে। কারণ এখানে ভূতের রাজা দারুণ দারুণ বর দেয়। গুপীবাঘার গল্প আধা বাস্তব আধা রূপকথা। ফলে শিশুরা চারপাশের বস্তুগুলো নিয়েই নানারকম কল্পনার জগত গড়তে শেখে। কল্পনাগুলো পুরোপুরি আজগুবি হয় না। এই কল্পনাশক্তিই ভবিষ্যতে ওদের নানারকম সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ জোগায়।

 

আরও পড়ুন: ফিরে আসুক মা-দিদিমার আঁচলে ছেয়ে থাকা নানান গল্প

 

#6. খুকুমণির ছড়া: খুকুমণির খেলার জন্যই যোগীন্দ্রনাথ সরকার লিখে গিয়েছিলেন ‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকির/ চামে কাটা মজুমদার/ ধেয়ে এলো দামোদর’। তাদের আনন্দ দিতেই তাঁর লেখা ‘আটুঁল বাঁটুল শ্যামলা শাঁটুল/ শ্যামলা গেছে হাটে/ শ্যামলাদের মেয়ে দুটি পথে বসে কাঁদে…’। খুকুমণির ছড়া এ রকমই কিছু ছড়ার অসামান্য সংকলন।
এতে রয়েছে হারাধনের দশটি ছেলের কথাও। ‘হারাধনের দশটি ছেলে ঘোরে পাড়াময়, একটি কোথায় হারিয়ে গেল, রইল বাকি নয়’। এই বইয়ের প্রতিটি ছড়াই তাই ছোটদের মনের খুব কাছের। ছড়াগুলো তাদের ভাবতে শেখায়। দামোদর কীভাবে ধেয়ে আসে, শ্যামলাদের মেয়ে কী তার মতোই কাঁদে?– এমন প্রশ্ন জাগায়। এই বই ওর হাতে দিয়ে অফিস গেলেও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। হারাধনের দশটি ছেলের মজার কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতেই ওর সময় কেটে যাবে।

#7. আবোল তাবোল: খুদের জন্য বই কেনা হবে আর সে তালিকায় সুকুমার রায়ের বই থাকবে না, তাও কি হয়? ‘আবোল তাবোল’ সুকুমার রায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সৃষ্টি। কাতুকুতু বুড়ো, সৎপাত্র, রামগরুড়ের ছানা, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, বাবুরাম সাপুড়ে, বইটির এক একটি কবিতার স্বাদ একেক রকম। পড়তে পড়তেই কবিতার চরিত্রগুলোই খুদের কল্পনার চরিত্র হয়ে উঠবে।
কবিতাই শুধু নয়, বইটিতে রয়েছে চরিত্রগুলোর অদ্ভুত মজার মজার ছবি। কবিতার পাশপাশি ছবিগুলোও হাসাবে ছোট্ট খুদেকে, ভাবাবে এও আবার হয় নাকি! আর এভাবেই কেটে যাবে তার সারাদিন।

 

গল্পের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে কার্যকর টিপস্ (Tips Regarding Books): 

অস্মিতা শুধু বইয়ের নামই বলেননি। পাশপাশি খুদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আগে মনে করিয়ে দিলেন বেশ কিছু টিপস্।

  • পড়ে শোনান (Read For Him): সোনামণি বাংলা বুঝতে পারলেও পড়তে গিয়ে অসুবিধা বোধ করতে পারে। এই অবস্থায় ওকে পড়তে না-বলে আপনিই ওকে পড়ে শোনান। আপনি অফিসে থাকাকালীন বাড়িতে যিনি ওর দেখভাল করেন, তাকেও পড়ে শোনাতে বলুন।

 

  • আস্তে আস্তে পড়ুন (Read Slowly): খুদে বাংলা বুঝতে পারলেও শুনে শুনে কোনও কিছু বোঝার জন্য সে একটু সময় নেয়। তাই গল্প বা কবিতা পড়ে শোনানোর সময় পড়ার গতির দিকে খেয়াল রাখুন। এক লাইন করে পড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। ওর রেসপন্স শোনার জন্য অপেক্ষা করুন।

 

  • পছন্দের বইটি দিন (Give Him His Favourite Book): ছোট্ট সোনার সব বই সমান পছন্দ হবে, তা নাই হতে পারে। তাই যে বইটি পড়ার সময় ও বেশি রেসপন্স করছে, যে গল্প শুনে ওর বেশি ভালো লাগছে, সেই গল্পটা ওকে বারবার শোনান।

অস্মিতার কথা মতোই ঐশী ও ঈশান ছোট্ট তাতানকে নানারকম বই কিনে দিল। এরপর ওর দিদাই বইগুলোর গল্প পড়ে শোনাতেন। সেই গল্প নিয়ে হাসিমজায় কাটতো তাতানের সারাদিন। কিছুদিন পর থেকে ওই ঐশী আর ঈশানকে গল্প শোনাতে শুরু করে। ততদিনে ছোট্ট তাতান গল্পের বইয়ের পোকা হয়ে উঠেছে যে! (Top Children’s Story Books)

 

আরও পড়ুন: যৌথ বা অণু পরিবার, কচি-মনের চাহিদা মেটানোই শেষ কথা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null