একরত্তি একটা শিশু, বাইরের পৃথিবীটার সাথে যোগাযোগ করতে তার একটাই ভাষা জানা। সেটা হল “প্যাঁ”। মুখ ফুলিয়ে, চোখের জলে ভেসে গিয়ে, গলা ফাটিয়ে সে হয়তো দাবি জানাচ্ছে কেঁদেই। কী করবে বলুন তো, কান্নাটাই যে ওর একমাত্র ভাষা। কিন্তু, এরকম ছোট্টটি হয়ে থাকলে কী আর হবে? স্বাভাবিক নিয়মেই তাকে বড় হতে হবে। হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন সে দৌড়ে বেড়াবে একদিন বা চ্যাঁ-প্যাঁ করতে করতেই একদিন বলে ফেলবে গোটা একখানা অর্থপূর্ণ বাক্য। একটি ছোট্ট বাচ্চা বড় হওয়ার প্রত্যেকটি ধাপ বা মাইলস্টোনগুলি এভাবেই পার করে সময়ের সাথে সাথে, একটি নির্দিষ্ট বয়সে। একেকজনের ক্ষেত্রে এই সময়ের একটু এদিক-ওদিক হতেই পারে; আর সেটাই স্বাভাবিক। (Speech Development in Babies; What’s Normal, What’s Not)
ধরুন, বাচ্চা কথা বলতে একটু দেরি করছে বলে আপনি রাতের ঘুম উড়িয়ে বসে আছেন। বা, ওকে কথা শেখাতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে আপনার। অহেতুক চিন্তায় জেরবার হচ্ছেন সঙ্গীর সাথে। ঠিক এই কারণেই আমাদের এই প্রতিবেদন। আমাদের বন্ধু মায়েরা, বিশেষত যারা নতুন মা হয়েছেন, প্রায়ই আমাদের বার্তা পাঠান যে “বাচ্চা কথা বলছে না কেন” বা “কীভাবে বুঝবো বাচ্চা এবার কথা বলবে” বা “বাচ্চা যে ঠিক ভাবে শুনছে এবং কথা বলার চেষ্টাটা স্বাভাবিক সেটা বুঝবো কীভাবে”; ইত্যাদি ইত্যাদি (Speech and Language Development)।
আমরা চিকিৎসক নই ঠিকই। কিন্তু আমাদের সাথে এমন অনেক মা বা বাচ্চাদের ব্যাপারে অভিজ্ঞ মানুষজন বা বন্ধু চিকিৎসক আছেন যারা অনায়াসে এসব ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। তাই, বাচ্চাদের কথা বলা / কথা শেখা সংক্রান্ত নানান প্রশ্ন নিয়েই ওনাদের সাথে আলোচনায় বসেছিলাম আমরা। কী কী কথা হল? জানতে পড়ে ফেলুন প্রতিবেদন।
স্পিচ এবং ল্যাঙ্গুয়েজ কীভাবে আলাদা? (Difference between Speech and Language)
ডাক্তারি আলোচনায় বাচ্চার কথা বলার মাইলস্টোনের প্রশ্নে স্পিচ এবং ল্যাঙ্গুয়েজ এই কথা দু’টি বারবার এসে উপস্থিত হয়। স্পিচ ডেভেলপমেনট ও ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেনট- এর ওপরেই জোর দেওয়া হয় বেশি। গালভারী কথা হলেও আদতেই আহামরি কিছু নয় এরা।
- সোজা কথায় বললে, আমরা নিজেদের ভাষায় যেভাবে অর্থপূর্ণ বাক্যগঠন করে, সাবলীল ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করি; সেটাই স্পিচ।
- ল্যাঙ্গুয়েজ হল ছোট ছোট তথ্য বা শব্দ আদানপ্রদান করেই অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। সবকিছু গুছিয়ে না বলেও অন্যকে মনের কথা বুঝিয়ে দেওয়ার উপায়। তা সে মৌখিক হোক, ইঙ্গিতে হোক বা লিখিত।
বাচ্চার ক্ষেত্রে, স্পিচের ধারণাই আগে তৈরি হয়। তারপর আসে ল্যাঙ্গুয়েজ। কারণ, বাচ্চা প্রথমে মুখের সাহায্যে নানারকম আওয়াজ করতে শেখে। সময়ের সাথে সাথে যখন বাচ্চার ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্কের বিকাশ হয় তখন সে বিভিন্ন আওয়াজের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শেখে এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু বাচ্চার মাইলস্টোন খুঁটিয়ে দেখলে এদের অস্বীকারও করতে পারি না। শুধু কলকল করে কথা বলাই নয়; আওয়াজ শোনা, চেনা, তাতে সাড়া দেওয়া বা ইঙ্গিত সবকিছুই কিন্তু জড়িয়ে আছে স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্টের সাথে (Language Development in Childhood)। আসুন দেখে নিই, বাচ্চার স্পিচ ডেভেলপমেন্টের মাইলস্টোনগুলি।
স্পিচ ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে কোন বয়সে কী কী শিখবে খুদে? (Milestones of Speech Development in Babies)
#1. বয়স যখন ৩ মাস:
- মা-বাবার আওয়াজ চিনবে
- কেউ তার দিকে তাকিয়ে কথা বললে চুপ করে শুনবে
- মুখ দিয়ে আওয়াজ করবে
- দুধ খাওয়ার সময় জোরে কোনও আওয়াজ শুনলে ল্যাচ করা বন্ধ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করবে
- বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবে
#2. বয়স যখন ৬ মাস:
- কোনও আওয়াজ পেলে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে ঘুরে দেখবে
- গান বা কোনও মিউজিক বাজালে সেটা শুনবে
- একা একা খেলতে খেলতে মুখে নানারকম আওয়াজ করবে বা কেউ কথা বললে মুখে হযবরল আওয়াজ করেই তার কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে
- বাজনা বাজা খেলনা বা জুতোর ওপর আকর্ষণ জন্মাবে খুব।
- কান্না, হাসি বা মুখে আওয়াজ করা ছাড়াও মুখে নানারকম হাবভাব করবে খুদে। (Stages of Language Development)
- আপনি কথা বললে আপনার দিকে তাকিয়ে শুনবে।
#3. বয়স যখন ১ বছর:
- যে কোনও আওয়াজ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে উৎস খুঁজবে।
- “এদিকে এসো” বা “আমাকে দাও” বা “না” ইত্যাদি এই ছোট্ট কথাগুলোর মানে বুঝবে। (Baby Speech Development Timeline)
- কেউ কথা বললে সেটা মন দিয়ে শুনবে।
- বারবার একই শব্দ উচ্চারণ করে যেমন বাবাব্ববাবা বা মাম্মাম্মমা ইত্যাদি বলার চেষ্টা করবে।
- মুখ দিয়ে আওয়াজ করে কাউকে ডাকার চেষ্টা করবে।
- হাত দিয়ে জিনিস দেখাবে, ইঙ্গিতে ডাকবে বা হাত ধরে কিছু বলতে চাইবে।
- অন্যের নকল করার চেষ্টা করবে।
আরও পড়ুন: বাচ্চা কিন্তু কেঁদেই আপনার কাছে ওর আবদার বা অভিমান জানায়; কীভাবে বুঝবেন ওর কান্নার ভাষা?
#4. বয়স যখন ৩ বছর:
- নতুন নতুন শব্দ শিখে যাবে তাড়াতাড়ি।
- ওপর- নীচে বা ছোট-বড় এই কথাগুলো যে একে অন্যের বিপরীত সেটা বুঝতে পারবে।
- বড় বড় বাক্য বুঝতে পারবে এবং নির্দেশ মানতে শিখবে।
- বড়দের মাঝে আলোচনায় কিছু বলতে চেষ্টা করবে। এদের একটা বা দুটো শব্দ খুব প্রিয় হয়; যে কোনও কথায় এরা সেগুলোই বলতে থাকে। তাতে সেই শব্দ বা শব্দগুলি যদি আলোচনার বাইরে হয়, তাতেও খুদের কিছু আসে যায় না।
- প্রশ্নের উত্তর দেবে ছোট্ট ছোট্ট করে।
- ঘরে কোনও প্রিয় জিনিস না দেখলে তার অভাব বোধ করবে এবং সেটার কথা বলবে।
- শিখবে ছোট্ট ছোট্ট বাক্য।
- এখন খুদের কথা বা সে কী বলতে চায়; বাড়ির পরিবারের সবাই বুঝতে পারবে সহজেই। (language Milestones by Age)
বাচ্চা যে কথা বলা শিখতে দেরি করছে; তা বুঝবেন কীভাবে? (Signs of a Speech Developmental Delay)
সব বাচ্চার ক্ষেত্রেই সময়ের এদিক ওদিক একটু হতেই পারে। তবে সেটা যেন অস্বাভাবিক না হয়ে যায়। বাচ্চার ৩/৪ মাস বয়স হয়ে গেলে সে যদি আপনার ডাকে না তাকায়, কোনও রকম আওয়াজের প্রভাব ওর মধ্যে না পড়ে, তা হলে সত্বর ডাক্তার দেখাবেন। জেনে রাখুন, বাচ্চার কথা বলা শেখার ক্ষেত্রে কোনগুলি অস্বাভাবিক।
- ৬ মাস বয়স পূর্ণ: বাচ্চা মুখে কোনও আওয়াজ করছে না, হাসছে না, কারও কোলে গিয়ে খেলছে না বা কোনও আওয়াজে সাড়া দিচ্ছে না।
- ১২ মাস বয়স পূর্ণ: বাচ্চা হাত দিয়ে কোনও জিনিস দেখাতে পারছে না। ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে পারছে না। হাত নেড়ে টা-টা করতেও তাকে শেখানো যায়নি। খুবই কম আওয়াজ করে মুখে বা ডাকলে যেন শুনতেই পায় না।
- ১৮ মাস বয়স পূর্ণ: কথা বলার কোনও চেষ্টা না করে আকারে ইঙ্গিতে অন্যের সাথে যোগাযোগ করছে। কোনও নির্দেশ বুঝতে পারছে না চট করে।
- ২ বছর বয়স পূর্ণ: হাবভাব নকল করছে বা কেউ কিছু বললে তার পরেই সেটা বলতে পারছে। কিন্তু নিজের থেকে অর্থপূর্ণ কথা গুছিয়ে বলতে পারছে না। কাউকে ডাকতে হলে মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকছে এবং কোনও নির্দেশ বুঝতে পারছে না।
খুব সাধারণ কয়েকটি স্পিচ ডিসঅর্ডার জেনে রাখুন:
- তোতলানো (Stammering)-> কোনও বাক্য বলতে গিয়ে আটকে যাওয়া বা বারবার একই শব্দ বলে যাওয়া। বাচ্চা কোনও কিছুতে ভয় পেলে বা ঘাবড়ে গেলে এই তোতলানো বেড়ে যায়।
- লিস্পিং (Lisping)-> বাচ্চা হয়তো কোনও বর্ণ উচ্চারণ করতে পারছে না, সেটাকে সে নিজের মতো করে অন্য বর্ণ দিয়ে সাজিয়ে শব্দ তৈরি করে। যেমন, “জল” বলতে না পেরে হয়তো বললো “জন”।
- ডিসারথিয়া (Dysarthria)-> নার্ভের সমস্যা থাকলে বা মস্তিষ্কের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে কথা বলতে সমস্যা হয়। বাচ্চার কথা বলার ধরনটাই অস্বাভাবিক শুনতে লাগে।
- ক্লাটারিং (Cluttering)-> এক্ষেত্রে বাচ্চা এই হয়তো কথা বলছে আবার হঠাৎ চুপ করে গেলো। পরের পর বাক্য সাজিয়ে অনেকটা কথা বলতে পারে না এরা। ফলে, ভাব প্রকাশে অসুবিধা হয়।
- আপারেক্সিয়া অফ স্পিচ (Apraxia of Speech (AOS))-> মস্তিষ্ক এবং কথা বলার কাজে নিযুক্ত পেশির মধ্যে সমন্বয়ে সমস্যা দেখা দেয় বলে বাচ্চা যা বলতে চায় সেটা বলতে পারে না।
- আলালিয়া( Alalia)-> এই ডাক্তারি নামটাই হয়তো সবচেয়ে পরিচিত বাচ্চার স্পিচ ডেভেলপমেন্ট মাইলস্টোনের প্রশ্নে। কথা বলার দেরি হতে পারে সাধারণ কোনও সমস্যা বা স্বাভাবিক বা মস্তিষ্কের কোনও সমস্যা; সবক্ষেত্রেই এই দেরিকে এই আলালিয়া নাম দিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়াও জিনগত সমস্যা বা ডাউন সিন্ড্রোম বা অটিজম ইত্যাদি অসুখে আক্রান্ত বাচ্চার ক্ষেত্রেও স্পিচ এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্টে প্রচুর সমস্যা দেখা যায়।
এত ভারী ভারী নাম শুনে বা সমস্যার কথা শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার কিন্তু এত্তটুকু প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রতিবেদনগুলি মূলত সতর্কতামূলক হয়; যাতে যে কোনও অসুবিধায় আপনি আগেই ব্যবস্থা নিতে পারেন। এর মানে এই নয় যে, আপনার বাচ্চারও অসুবিধা হবেই। তবে বাচ্চার কথা বলা সহজ করতে মাথায় রাখুন কিছু কথা (Tips to Encourage Speech Development in Babies and Kids):
- বাচ্চার সাথে প্রচুর কথা বলুন। হোক না তার বয়স ২ মাস; ও ঠিক আপনার গলা শুনবে।
- হাত দিয়ে জিনিস দেখাতে বলা, প্রিয় খেলনা ধরতে বলা বা একটু “টুকি” খেলা; ওকে উৎসাহ দেবে সবকিছুই।
- কথা বলবেন আপনি ও আপনারা। ওর মতো করেই বলবেন। মোবাইল বা টিভি চালিয়ে বাচ্চাকে বসিয়ে দিলে কিন্তু তার প্রভাব ভালো হবে না মোটে।
- সময় দিন। অস্থির হবেন না। কেউ শেখে ৩ মাসে তো কেউ ৬ মাসে। তাই বাচ্চাকে সময় দিন। শুধু নজরে রাখুন। (Speech Development in Babies; What’s Normal, What’s Not)
আরও পড়ুন: লক্ষণ ধরা দেবে ছেলেবেলাতেই; অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের যা করণীয়!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null