সন্তান আসার কত দিন পরে আবার স্বাভাবিক যৌনজীবনে ফিরবেন আপনি!

সন্তান আসার কত দিন পরে আবার স্বাভাবিক যৌনজীবনে ফিরবেন আপনি!

পূজা আর সুস্মিতার বন্ধুত্ব হয়েছিল হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে থাকাকালীন। একই চিকিৎসক দু’জনের ডেলিভারি করিয়েছিলেন। এখন ওরা দু’জনেই দুই ফুটফুটে মেয়ের মা। মেয়েদের বয়স তিন মাস। সরাসরি দেখা কম হলেও হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত দু’জন পরস্পরের পরামর্শ নেয়। (Things To Know About Sex After Delivery)

গতরাতে হঠাৎই সুস্মিতার টেক্সট পূজাকে। ওর জিজ্ঞাসা, আবার কবে স্বাভাবিক যৌনজীবনে ফেরা সম্ভব? প্রশ্নটা ওর মাথায় এসেছে টিভিতে একটি ধারাবাহিক দেখার সময়। পূজা এর উত্তর জানত না। সে বলল, এই ব্যাপারে তোর চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারিস।

পরের অ্যাপয়েনমেন্টেই সুস্মিতা চিকিৎসকের কাছে প্রশ্নটা রাখল। তিনি বললেন, মা হওয়ার পর যৌনসম্পর্কের বিষয়টা বেশ কিছু কারণে জটিল। এক্ষেত্রে আপনাকে এর সব ক’টা দিক ভালো করে জানতে হবে। এরপর চিকিৎসক সুস্মিতা আর ওর বরকে শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন (BachhaHowar Koto Din Por Sohobas Kora Jay)।

মা হওয়ার পর একজন নারীর শরীরে অনেক রকম পরিবর্তন আসে। এগুলোর জন্যই আগের মতো যৌনজীবনে ফিরে যেতে কিছুটা সময় লাগে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই এই পরিবর্তনগুলোই জেনে রাখা দরকার। যা বুঝিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসক।

 

প্রসবের পর মায়ের শরীরে বদলের খুঁটিনাটি (Post-Pregnancy Body Changes)

#1. যোনির দুর্বল টিস্যু (Thin Vaginal Tissue): প্রসবের সময় মায়ের যোনির টিস্যুগুলো প্রসারিত হয়ে শিশুর জন্ম নেওয়ার পথ করে দেয়। এই কারণে মা হওয়ার পর যোনির টিস্যুগুলো যথেষ্ট দুর্বল থাকে। এই টিস্যুগুলো আগের মতো স্বাভাবিক হতে বেশ কিছু মাস সময় লাগে। এর মধ্যে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত না-হওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

#2. শুষ্ক যোনিত্বক (Vaginal Dryness): ইস্ট্রোজেন যোনিপথকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল রাখে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে এই হরমোনের মাত্রা বেশি থাকে। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর এই হরমোনের পরিমাণ কমতে থাকে। শিশুকে স্তন্যপান করালে মায়ের শরীরে তা আরওই কমে যায়। ফলে যোনিপথ তার আর্দ্রতা হারিয়ে শুষ্ক হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আর্দ্রভাব না-ফেরার আগে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত (Sex After Birth) না-হওয়াই ভালো।

#3. পেরিনিয়াল টিয়ার বা এপিসিওটমি (Perineal Tear Or Episiotomy): সন্তানের জন্ম ভ্যাজাইনাল ডেলিভারির মাধ্যমে হলে মায়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি দেখা দেয়। পেরিনিয়াল টিয়ারের অর্থ হল পেরিনিয়াম ত্বকে ফাটল। পেরিনিয়াম নারীর যোনিপথ ও মলদ্বারের মধ্যবর্তী ত্বক। পেরিনিয়াম ত্বক এই দু’টি পথকে আলাদা করে রাখে।
জন্মের সময় সন্তানের ওজন বেশি হলে বা প্রসবের পদ্ধতি কোনও কারণে খুব কষ্টকর হলে এই ত্বকের উপর চাপ পড়ে। এতে ত্বকটিতে ফাটল দেখা যায়। সন্তান প্রসবের পর ওষুধের মাধ্যমে এই ফাটলটি ধীরে ধীরে সেরে ওঠে। পেরিনিয়াল টিয়ার সেরে ওঠার আগে যৌনতায় লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।

#4. যৌনতার আকাঙ্খা কম (Low Libido): গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন দুই-ই অনেক বেশি মাত্রায় থাকে। মা হওয়ার পর এই হরমোনগুলোর মাত্রা একদম কমে যায়। হরমোনের পরিমাণে তারতম্যের ফলে এই সময় নারীর যৌনতার আকাঙ্খা কম থাকে। এছাড়াও চিকিৎসকরা জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস শিশুকে স্তন্যপান করানোর পরামর্শ দেন। স্তন্যপান করালে মিলনের ইচ্ছে এমনিই কমে যায়।

#5. ক্লান্তি (Fatigue): সন্তান জন্ম দেওয়ার পদ্ধতিটি নিঃসন্দেহে সব মায়ের কাছেই স্ট্রেসফুল। সন্তানের জন্মের পর মায়ের দায়িত্বও অনেক বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই বেড়ে যাওয়া দায়িত্ব ও স্ট্রেস থেকে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে মায়ের শরীর। এই অবস্থায় যৌনতা মায়ের শরীরের পক্ষে ভালো নয়।

#6. রক্তপাত (Bleeding): মা হওয়ার পর প্রথম কিছু সপ্তাহে যোনি দিয়ে নিয়মিত রক্তপাত হয়। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময় মায়ের জরায়ু, যোনিপথ ধীরে ধীরে আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে। এই কারণে রক্তপাত স্বাভাবিক। এই সময় যৌনমিলন হলে রক্তপাত আরও বেড়ে যেতে পারে যা শরীরের পক্ষে ভালো নয়।

 

আরও পড়ুন: প্রসবের পরে কীভাবে জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন!

 

#7. মানসিক অবসাদ (Depression): সন্তানের জন্মের পর মায়ের শরীরে যেমন হরমোনের তারতম্য হয়, তেমনই সন্তানের নানা রকম দায়িত্ব এসে পড়ে। এই সব কিছু একসঙ্গে সামলাতে না-পেরে অনেক মায়েরাই ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেন। এই সময় মায়েদের যৌনতায় অংশগ্ৰহণ করার ইচ্ছে থাকে না (Things to Know About Postpartum Sex)। অনেকসময় যৌনতা নিয়ে ভয়ও জন্মাতে থাকে‌।

উপরের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে মায়ের শরীরের কয়েক মাস সময় লাগে। কারও ক্ষেত্রে তিন মাস, কারও ক্ষেত্রে ছ’-সাত মাস। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠার আগে যৌনমিলন হলে মায়ের বিপদের আশঙ্কা থাকে। কী কী বিপদ হতে পারে সেগুলোও একে একে বুঝিয়ে দেন সুস্মিতার চিকিৎসক।

 

প্রসবের পর পরই সহবাসে কী কী ক্ষতি হতে পারে মায়ের (Common Sex-After-Pregnancy Problems)

  • মায়ের পক্ষে কষ্টকর: যোনির দুর্বল টিস্যুগুলি সেরে ওঠার আগেই যৌনতায় অংশ নিলে তা মায়ের পক্ষে কষ্টকর হতে পারে।
  • শুষ্কতাজনিত সংক্রমণ: ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় যোনি আগের মতো আর্দ্র ও পিচ্ছিল হতে বেশ কিছু সপ্তাহ সময় নেয়। এরই মধ্যে যৌনতায় লিপ্ত হলে যোনি আরও শুষ্ক হয়ে যায় । এর ফলে যোনিতে সংক্রমণ হয়। এমনকী প্রচুর রক্তপাতও হতে পারে।
  • পেরিনিয়াল টিয়ারে সংক্রমণ: পেরিনিয়াম পর্দা সম্পূর্ণ সেরে ওঠার আগে যৌনতায় লিপ্ত হলে পেরিনিয়াম ত্বকের ফাটলে ক্ষতিকারক সংক্রমণ হয়। ওই ত্বকে নতুন করে ক্ষতও সৃষ্টি হতে পারে, যা সারিয়ে তোলা কষ্টকর।
  • সন্তানের কাজেও ক্লান্তি: মা হওয়ার পর শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত থাকে। এই স্ট্রেস ঠিকঠাক কাটিয়ে ওঠার আগেই যৌনমিলন হলে মায়ের শরীর আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সময় সন্তানকে স্তন্যপান করাতেও ক্লান্তিবোধ হতে পারে।

 

প্রসবের কতদিন পর সহবাস সম্ভব? (When Do Couples Start Having Sex again After Their Baby is Born )

মা হওয়ার পর কয়েক মাস যৌনমিলন করা উচিত নয়, তা তো বোঝা গেল। তবে কখন থেকে আগের মতোই স্বাভাবিক যৌনমিলন করা যায়, তাও অনেক অনেকে জানতে চান। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসক কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা করে তবেই যৌনমিলনে অনুমতি দেন।

  • হরমোনে ভারসাম্য: গর্ভাবস্থায় ও মা হওয়ার পর মায়ের শরীরে হরমোনের পরিমাণে যথেষ্ট হেরফের ঘটে। হরমোনের ভারসাম্য আনতে মায়ের শরীর কমপক্ষে ছয় থেকে আট সপ্তাহ সময় নেয়। হরমোনে ভারসাম্য এলে চিকিৎসকরা নিশ্চিন্ত হন।
  • যোনির স্বাভাবিক হওয়া: হরমোনে ভারসাম্য এলে যোনির টিস্যুগুলো ধীরে ধীরে সেরে ওঠে। ইস্ট্রোজেনের মাত্রাও যোনিকে ধীরে ধীরে আর্দ্র করে। তবে এক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে তিন-চার মাস। মা শিশুকে স্তন্যপান করালে সেক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে আরও বেশি।
  • পেরিনিয়াম ত্বকের সেরে ওঠা: পেরিনিয়াল ত্বকে ছোট থেকে বড় যে কোনও রকম ফাটল হতে পারে। এক একজনের ক্ষেত্রে সেরে ওঠার সময় এক এক রকম। তবে ক্ষত সম্পূর্ণ সেরে ওঠার পর যৌনমিলনে আর বাধা নেই‌।

 

যৌনমিলনের বিষয়টা স্পষ্ট হলেও সুস্মিতার বর দীপের কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল না দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে চিকিৎসকের মতামত। সুস্মিতা আর দীপ দু’জনেই চায়, তাদের খুকুমণির একজন খেলার সঙ্গী থাক। চিকিৎসককে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে তিনি প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে সতর্ক করলেন (Sex After Birth: What to Expect and How Long to Wait)।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে মা হওয়ার ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যেই নারী শরীরে ওভিউলেশন পদ্ধতি শুরু হতে পারে। মা যদি স্তন্যপান না-করান, তবে যৌনমিলনের ফলে প্রেগন্যান্সি আসা অস্বাভাবিক নয়। এত তাড়াতাড়ি প্রেগন্যান্সি এলে মায়ের শরীরে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা‌।

  • হরমোনের তারতম্য: মা হওয়ার দুই-তিন মাসের মধ্যে প্রেগন্যান্সি এলে প্রথম প্রভাব পড়ে হরমোনের ভারসাম্যে। ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরন তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকে। যা মায়ের পক্ষে ভালো নয়।
    মানসিক সমস্যা: হরমোনের তারতম্যের ফলে মায়ের মানসিক অবস্থায় প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে মা অবসাদগ্ৰস্ত হয়ে পড়তে পারেন। অন্য মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
  • প্রিম্যাচিউর বার্থ: দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম সময়ের অনেক আগে হতে পারে, যা শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়।
    বিশেষজ্ঞদের মত, এক সন্তানের জন্মের পর পরবর্তী প্রেগন্যান্সির আগে অন্তত ১০ থেকে ১২ মাস অপেক্ষা করা উচিত। এতে মা ও তার দুই সন্তানের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাই সন্তানের জন্মের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যৌনতায় অংশ নিলেও জন্মনিরোধক পদ্ধতি অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত।

চিকিৎসক বুঝিয়ে বলার পরে পুরো ব্যাপারটাই ওদের কাছে স্পষ্ট। বাড়ি ফিরে দীপই সুস্মিতাকে দেখভাল করা শুরু হলো। যাতে তাড়াতাড়ি ও আবার আগের সুস্মিতা হয়ে ওঠে। তারপরেই নিরাপদে আরেক স্বপ্ন দেখা শুরু হবে। (Things To Know About Sex After Delivery)

 

আরও পড়ুন: প্রসবের পরে কী কী বা কী ধরনের খাবার খেতেই হবে নতুন মাকে, হদিস থাকল এখানে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null