পামেলার ছোট্ট মেয়েটার বয়স এক বছর। ওর ডাকনাম মিছরি। বাবা আর মা দু’জনের কাউকে ছাড়াই ওর এক মুহূর্ত চলে না। সারাদিন মাকে ওর সঙ্গে খেলতে হবে। না-খেললেই প্রচণ্ড কান্নাকাটি! আবার রাতে অফিস থেকে ফিরে বাবাকেও পুতুল খেলায় যোগ দিতে হবে। সেই হাসিখুশি মিছরিই ক’দিন ধরে সব সময় কান্নাকাটি করেই চলেছে। খেতে চাইছে না, এমনকী ঘুমোচ্ছেও না ঠিক মতো। এর কারণ, ওর বাবা অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছে। ফেরার কথা একমাস পরে। যাওয়ার আগে থেকেই মিছরি কান্নাকাটি করছে, যাওয়ার পরেও থামছে না। পামেলা রীতিমতো দিশাহীন কী করে ছোট্ট সোনাকে স্বাভাবিক করে তুলবে। উপায় না-পেয়ে শেষপর্যন্ত ও মনোবিদের পরামর্শ নেবে বলেই ঠিক করে। (Separation Anxiety Disorder in babies: Causes, Symptoms & Cure)
পরিচিত এক মনোবিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তাঁকে সব জানাতেই, তিনি বললেন মিছরি ‘সেপারেশন অ্যাংজাইটি’ বা আলাদা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় (Separation Anxiety Disorder in Children) ভুগছে। পামেলা এই কথাটা প্রথম শুনলো। এই বিষয়ে জানতে চাইতেই, মনোবিদ বিষয়টা ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন।
ছোট্ট খুদেকে যে সবচেয়ে বেশি যত্ন করে, তাকেই ও প্রচণ্ড ভরসা করে। এছাড়াও ও যার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় থাকে, তার কাছেই ও নিরাপদ বোধ করে। এই মানুষটিই ওর চোখের আড়ালে চলে গেলে ওর মধ্যে প্রচণ্ড ভয়ের সৃষ্টি হয়। তাকে দেখতে না-পেয়ে ও নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। এর ফলেই ওর মধ্যে দুশ্চিন্তা জন্মায়, ভয় হয়। এই ভয় থেকেই ওর মাথাব্যথা, পেট ব্যথার মতো সমস্যাও তৈরি হয়। একেই বলা হয় সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা আলাদা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা ‘স্যাড’-এর সমস্যা ৮ থেকে ১৪ মাসের মধ্যে শিশুদের মধ্যে তৈরি হয় (Separation Anxiety in Toddlers)। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে। অনেক সময় ছয় বছরের বেশি বয়সের বাচ্চা, এমনকী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও এই অ্যাংজাইটি দেখা যায়।
চিকিৎসককে এই প্রশ্নই করেছিল পামেলা। শুধু কী এই বন্ডিংটাই এর কারণ? চিকিৎসক তখন বেশ কয়েকটি পরিস্থিতির কথা বললেন।
ছোট্ট সোনার মধ্যে এই আশঙ্কা জন্মাচ্ছে তা কী দেখে বোঝা সম্ভব? (Separation Anxiety Disorder Symptoms) পামেলা এই প্রশ্নই করে মনোবিদকে। তিনি এর উত্তরে বেশ কিছু লক্ষণের কথা জানালেন, যেগুলো খুদের মধ্যে ফুটে উঠতে পারে। শুধু ছোট্ট সোনার মধ্যেই নয়, পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চার ক্ষেত্রেও এই একই লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
#1. অবাস্তব চিন্তা: প্রিয় মানুষটি চোখের আড়াল হলে বা কাছে না-থাকলে অনেক রকম অবাস্তব চিন্তা ওদের কল্পনায় ভিড় করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের এমন অবাস্তব চিন্তা বাড়তে থাকে। তাঁদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে।
#2. অবাধ্য হওয়া: একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এমন লক্ষণ দেখা যায়। প্রিয় মানুষটি ওর কাছে না-থাকলে ছোট্ট সোনা অবাধ্য হয়ে ওঠে। সহজে স্কুল যেতে চায় না বা পড়াশোনা করতে চায় না। এই অবাধ্যতা সেপারেশন অ্যাংজাইটির প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
#3. ঘুমোতে না চাওয়া: প্রিয় মানুষ কাছে না-থাকলে কোনও কাজেই ওর মন বসে না। এমনকী ঘুমের ক্ষেত্রেও খুদের সমস্যা তৈরি হয়। মনের মধ্যে আশঙ্কা জন্মালে কিছুতেই ও দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না।
#4. বিছানায় হিসু: ছোট্ট সোনা কোনও কারণে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে থাকলে সহজেই বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। যার উপর ও সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে তাকে কাছে না পেলেও ওর মনে প্রচণ্ড ভয় তৈরি হয়। এর থেকেই খুদে ঘুমের মধ্যে হিসু করে ফেলে। বিছানা ভিজিয়ে ফেলার এই লক্ষণ পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চাদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে।
আরও পড়ুন: বিছানায় বাচ্চার প্রস্রাব করা একরকমের ব্যাধি; জেনে নিন কারণ ও প্রতিকার!
#5. দুঃস্বপ্ন: ভালোবাসার মানুষ খুদের দু’চোখের আড়াল হলে ওর মধ্যে নানা রকম অবাস্তব চিন্তা জন্মায়। এই চিন্তাগুলো ওর মনে অত্যন্ত কুপ্রভাব তৈরি করে। এই অবাস্তব চিন্তাগুলোই ওর স্বপ্নের মধ্যে ফুটে ওঠে। এমন দুঃস্বপ্ন ওর মনে আশঙ্কার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
#6. মাথাব্যথা: ছোট্ট সোনার মন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ হয়। অত্যাধিক ভয়ের ফলে ওর মনে যে অবাস্তব চিন্তা জন্মায়, সেগুলোই ওর নার্ভাস সিস্টেমে প্রভাব ফেলে। এর থেকে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
#7. পেটে ব্যথা হওয়া: অনেক মায়ের মনেই প্রশ্ন তৈরি হয় পেটে ব্যথা না-হলেও খুদে পেটে ব্যথার কথা বারবার বলে কেন? এর আসল কারণ প্রচণ্ড ভয় বা দুশ্চিন্তা। এর কোনও একটি ওর মনে বাসা বাঁধলে ওর হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর থেকেই পেটে ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
#8. ঘ্যানঘ্যান করা: ছোট্ট সোনামণিকে ছেড়ে যখন ওর প্রিয় মানুষ চোখের আড়ালে যেতে চান, তখন ওকে ঘ্যানঘ্যান করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে মানুষটিকে ওর সঙ্গে থাকার জন্য বারবার অনুরোধ করে। এমনকী অনুনয়ের সঙ্গে প্রচন্ড কান্নাকাটিও করতে থাকে।
মনোবিদ জানালেন এই সমস্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমন গুরুতর হয় না। কিছু দিন এই সমস্যাটা থাকার পর নিজে থেকেই মিটে যায়। তবে কিছুক্ষেত্রে সমস্যা অনেকটা সময় ধরে চলতে থাকে। সেক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের কিছু রাস্তা (Separation Anxiety Disorder Treatment) তিনিই বলে দিলেন।
মনোবিদের পরামর্শ জানতে পেরে অনেকটাই উপকৃত হয় পামেলা। কিছুদিন পরে দেখা যায়, তাঁর কথাই সত্যি। মিছরির কান্নাকাটি কমে গিয়েছে। পামেলাও ছোট্ট মিছরির খুব কাছের মানুষ। ফলে বড় কোনও সমস্যায় মিছরিকে পড়তে হয়নি। এতে পামেলাও অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছে। (Separation Anxiety Disorder in Babies Causes, Symptoms & Cure)
আরও পড়ুন: শুধু শেখানো নয়, শিশুর খাতিরে বদলাতে হবে আপনাদেরও। শৃঙ্খলা শিখতে হবে শিশুর সাথেই!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null