দ্বিতীয় ট্রাইমেসটার কাটবে কেমন? হবু মায়ের জন্য থাকল আশা-প্রত্যাশার চেকলিস্ট!

দ্বিতীয় ট্রাইমেসটার কাটবে কেমন? হবু মায়ের জন্য থাকল আশা-প্রত্যাশার চেকলিস্ট!

রোজ একটু একটু করে “মা” হওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন আপনি। ছোট্ট প্রাণটা শরীরের ভিতর তিন তিনটে মাস কাটিয়ে ফেলেছে। গর্ভাবস্থার প্রথম তিনটে মাস অতি সযত্নে, পরিবারের আদরে, মর্নিং সিকনেসের অত্যাচারে নাজেহাল হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। শরীর যেন একটু ধাতস্থ হতে শুরু করেছে হঠাৎ আসা পরিবর্তনগুলোর সাথে। মনও ছোট্ট সোনার কথা ভেবে বেশ আনন্দেই থাকে আজকাল (Second Trimester of Pregnancy)।

জানেন কি, গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় পর্যায়ের তিনটি মাস বা সেকেন্ড ট্রাইমেসটারই (The Second Trimester of Pregnancy) গর্ভাবস্থার সবচেয়ে উপভোগ্য সময়! প্রথম ট্রাইমেসটারে হরমোনগুলো দাপাদাপি করে বড্ড জ্বালিয়েছিল, এই ট্রাইমেসটারে কিন্তু মায়ের শরীর আস্তে আস্তে পরিবর্তনগুলো মানিয়ে নিতে শেখে। ভাবী সন্তানকে অনুভব করতে পেরে ভুলে যায় নিজের শারীরিক অসুবিধাগুলো।

গর্ভাবস্থার ১৪ থেকে ২৭ সপ্তাহ (When Does Second Trimester Officially Start) পর্যন্ত সময়কে সেকেন্ড ট্রাইমেসটার বলা হয়। এই পর্যায়ে মায়ের শরীরে “মা” হওয়ার সব লক্ষণগুলি ফুটে উঠতে থাকে। আপনার ভিতরে যে আরেকটি প্রাণ বেড়ে উঠছে মহানন্দে, তার প্রতিফলন দেখা দেয় আপনার শরীরেই। তবে, দ্বিতীয় ট্রাইমেসটারেও (Pregnancyr Second Trimester; Lokkhon Ebong Bacchar Bikash) কিন্তু অনেক কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হবে আপনার। পরিবর্তন ঘটবে শরীরের ভিতরে ও বাইরেও।

হবু মা কেমন কাটাবেন তার দ্বিতীয় ট্রাইমেসটার? এসময়ে সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলোই বা কেমন হবে? কখন মনে প্রজাপতি ওড়াবেন আর কখন ছুটে যাবেন ডাক্তারের কাছে? (What to Expect in 2nd Trimester) এসব কিছু নিয়েই আমাদের আজকের প্রতিবেদন। হবু মায়েরা, নিজের ও সন্তানের স্বাস্থ্যের খাতিরে পড়ে ফেলুন একনজরে!

 

 

গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিন মাসে কী কী পরিবর্তন দেখা দেয় মায়ের শরীরে? (Changes in Your Body During Pregnancy: Second Trimester)

 

#1. পেট স্ফীত হতে শুরু করে: গর্ভাবস্থার এই পর্যায়ে বাচ্চা আগের থেকে বড় হয়ে যায় এবং জরায়ু বাচ্চাকে থাকার জায়গা করে দেওয়ার জন্য বাড়তে শুরু করে। এর ফলে, পেট ফুলতে শুরু করে। এই ট্রাইমেসটার থেকেই হবু মায়ের পেটের স্ফীতি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় (Gorvabosthar Dwitiyo Tin Mase Mayer Sorire Poriborton)। শুধু পেট নয়, ওজনও বাড়বে আপনার।

#2. বাড়তে থাকে স্তনের আকার: স্তনযুগলও আকারে বড় হতে শুরু করে এবং কিছুটা স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে।

#3. পরিবর্তন আসে ত্বকে: গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে হরমোনের যে নাচানাচি চলে, তার প্রভাব পড়ে মায়ের ত্বকের ওপরেও। তলপেট, বুক, থাই এবং নিতম্বে উঁকি দিতে শুরু করে স্ট্রেচ মার্ক্স। আবার মেলানিন জমে মুখে ব্রাউন স্পটের আবির্ভাবও হতে পারে। শুধু মুখে নয়, তলপেটেও ডার্ক লাইন ফুটে ওঠে (Second trimester: Weeks 13 to 28)। চিন্তার কোনও কারণ নেই, বাচ্চা হওয়ার পরে সময়ের সাথে সাথে এই দাগগুলি মিলিয়ে যায়। আপনার খাতিরে দিয়ে দিলাম স্ট্রেচ মার্কস দূর করার কিছু ঘরোয়া টিপসও। ক্লিক করুন এখানে> স্ট্রেচ মার্কস? মুক্তির পাঁচটি উপায়

#4. নাক বন্ধ ভাব: গর্ভাবস্থায় হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই শরীরে রক্তের পরিমাণও বেড়ে যায়। এর প্রভাবেই মিউকাস মেম্ব্রেন ফুলে যায় এবং এর ফলে নাক থেকে রক্তপাত হওয়াও অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। নাক বন্ধ ভাব থাকায় শ্বাস নিতেও অসুবিধা হয়। স্যালাইন ড্রপ এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে হবু মাকে (Pregnancy Complications Second Trimester)। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে জল খান এবং নাকের ফুটোর পাশে সামান্য ভেসলিন জাতীয় কিছু লাগিয়ে রাখুন। এতে ওই জায়গায় ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকবে।

#5. ব্র্যাক্সটন হিক্স কনট্রাকশন: মাঝে মাঝে তলপেটে হাল্কা খিঁচের মতো (Braxton Hicks contractions) ধরতে পারে। সামান্য শরীরচর্চা করলে বা যৌন মিলনের পরে এই ধরনের খিঁচুনি বা টান লাগতে পারে। পোশাকি ভাষায় একেই ব্র্যাক্সটন হিক্স কনট্রাকশন বলে। যদিও মাঝে মাঝে তলপেটে এরকম টান অস্বাভাবিক কিছু নয়; তবে বার বার হতে থাকলে এবং এতে আপনি কষ্ট পেলে ডাক্তার দেখানোই শ্রেয়। বারবার যন্ত্রণাদায়ক টান সময়ের আগেই প্রসব হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলে। তাই, অবস্থা বুঝে ডাক্তার দেখান।

#6. ক্লান্তি ও মাথা ঘুরে যাওয়া: এই উপসর্গগুলির সাথে আপনি আগেই পরিচিত হতে শুরু করেছেন বটে, এবং এরা সহজে আপনার পিছু ছাড়বে না। এসময়েও ক্লান্তিভাব আসবে। মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে যেতেও পারে। তাই, সতর্ক থাকুন। সুস্থ ডায়েট মেনে চলুন (What to Eat During Second Trimester of Pregnancy)। বেশি পরিমাণে জল ও তরল জাতীয় খাবার খান। আপনার সুবিধার্থে সাধারণ একটি ডায়েট চার্টও ছকে দিলাম আমরা>
Pregnancy diet chart in Bengali

এরই সাথে বলব, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি ভাব কাটাতে নিজেও খানিক সচেতন থাকুন। শোওয়া অবস্থা থেকে আচমকা উঠতে যাবেন না। বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠুন। আস্তে আস্তে এপাশ অপাশ করুন।

#7. দাঁতের সমস্যা: এসময় দাঁতের মাড়ি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে যায়। সামান্য আঘাতেই মাড়ি লাল হয়ে যায় ও রক্ত পড়তে পারে। বারবার বমি হওয়ার জন্য দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও এনামেল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দু’বেলা ভালো মানের পেস্ট ব্যবহার করে ব্রাশ করুন (Second Trimester Complications)। আর বমি হলেই ভালো করে জল দিয়ে কুল্কুছি করে নিন।

#8. যোনিস্রাবের পরিবর্তন: এসময় ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা যোনিস্রাবের পরিমাণ বেশি হয়। একটু চ্যাটচেটে ধরনের সাদা বা স্বছ স্রাব একেবারেই স্বাভাবিক (Changes in Your Body During Pregnancy: Second Trimester)। তবে যদি এই ডিসচার্জ অস্বাভাবিক রং ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান। ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতাও এসময় বেড়ে যায়। তাই কোনও পাবলিক টয়লেট যথাসাধ্য এড়িয়ে চলুন। সেই সাথে দেখে নিন গর্ভকালীন দিনগুলোয় গোপনাঙ্গের যত্ন নেওয়ার টিপসও>গর্ভকালীন দিনগুলোয় আপনার গোপনাঙ্গের যত্ন নেওয়ার গোপন কথা

#9. পা, কোমরে ব্যথা: এই সব ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা পুরো প্রেগন্যান্সি জুড়েই (2nd Trimester Pregnancy Pains) আপনার সঙ্গী রইল। সেকেন্ড ট্রাইমেসটারেও তার অন্যথা হবে না। রাতের দিকে ব্যথা বাড়তে পারে। পায়ে জল জলে পা ফুলে যেতে পারে। বেশি করে জল খান, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে হাল্কা শরীরচর্চা করুন, অয়েল ম্যাসাজ করুন ও উষ্ণ জলে স্নান করুন (Tips for Second Trimester)। আরাম পাবেন।

 

আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় খাদ্যতালিকায় রাখতেই হবে যেসব খাবার

 

 

সেকেন্ড ট্রাইমেসটার চলাকালীন কী করবেন ও কী করবেন না? (Second Trimester- The Most Comprehensive Guide of Dos and Don’ts)

  • সুষম ডায়েট মেনে চলুন। এসময় মায়ের শরীরে দৈনিক প্রায় ২১০০-২২০০ ক্যালোরি এনার্জির প্রয়োজন হয়। নিজের শরীর ও বাচ্চার বাড়বৃদ্ধি ঠিক রাখতে মেনে চলুন নির্দিষ্ট ডায়েট।
  • প্রচুর পরিমাণে জল খান (2nd Trimester of Pregnancy Precautions)। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, ওমেগা ৩, ক্যালসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদির মতো প্রয়োজনীয় পরিপোষকগুলি যাতে আপনার রোজের খাবারে ভরপুর মাত্রায় থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  • আরামদায়ক জামাকাপড় পড়ুন। ভালো মানের আরামদায়ক ব্রা ব্যবহার করুন।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
  • প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম করবেন না (Dos and Don’ts for a Safer Pregnancy)। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে হালকা শরীরচর্চা করুন।
  • ভারী ওজন তুলবেন না এবং নিচু হয়ে কোনও কিছু তুলবেন না।
  • ঘুমনোর সময় একপাশ ফিরে পায়ের তলায়, পিঠে, কোমরে বালিশের সাপোর্ট দিন, অনেক আরাম পাবেন।
  • কেউ ধূমপান করলে সেই জায়গা থেকে সরে আসুন।
  • কোনও কেমিক্যাল দিয়ে বাথরুম বা রান্নাঘর পরিষ্কার করার মতো কাজ করবেন না।
  • মুখে যদি ব্রণর আগমন হয়, তা হলে ডাক্তারের অনুমতি না নিয়ে কোনও ওষুধ মুখে লাগাবেন না বা খাবেন না।
  • ডাক্তারের অনুমতি না নিয়ে ভিটামিন, সাপ্লিমেনট একেবারেই খাবেন না।
  • কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে কোনও জড়ি বুটি বা ভেষজ ওষুধ খাবেন না। এর থেকে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়।
  • আধসেদ্ধ ডিম, অর্ধেক রান্না হওয়া সামুদ্রিক মাছ বা চিংড়ি খাবেন না (Second Trimester Diet: Foods to Eat and Avoid)।
  • হিল তোলা উঁচু জুতো পরবেন না। ফ্ল্যাট আরামদায়ক জুতো ব্যবহার করুন।
  • অকারণে সাতপাঁচ ভাববেন না। উদ্বেগ কিন্তু আপনার ও সন্তানের ক্ষতি করতে পারে।
  • ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চেক আপ করান এবং তাঁর সব নির্দেশ মেনে চলুন।

 

 

গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিন মাস সুখেরই সময়। তবু সতর্ক হবেন কখন? (Reasons to Call the Doctor during Second Trimester)

  • আচমকা ব্লিডিং হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।
  • তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা ও তার সাথে জ্বর হলে।
  • নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা করান কারণ এসময়েই অনেকেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
  • চোখে ঝাপসা দেখলে বা মুখ-হাত-পা বেশি ফুলে গেলে বা হঠাৎ ওজন খুব বেড়ে গেলে ডাক্তারকে জানান (Pregnancy: When To Call Your Doctor )। অনেকক্ষেত্রেই এগুলি প্রি এক্ল্যাম্পসিয়ার পূর্ব লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।
  • যদি একেবারেই ঘুম না আসতে চায়, খাবারে অরুচি চলে আসে, তা হলেও ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

 

খুব সতর্ক থাকুন নিজেকে নিয়ে। সামান্যতম অসুবিধা হলেও বাড়ির বড়দের ও ডাক্তারকে জানান। জরুরি অবস্থায় কীভাবে এগোতে হবে, তার পরামর্শ করে রাখুন ডাক্তারের সাথে (Things You Need to Know About the Second Trimester)। খাওয়া-দাওয়া করুন, অফিসেও যান তবে সাবধানে। আর ভালো করে বিশ্রাম নিন। আনন্দে থাকুন, উপভোগ করুন মাতৃত্বের জার্নিটা (Second Trimester of Pregnancy)।

 

আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম- উপকারিতা আর সাবধানতা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null