ঘরে-বাইরে নিশ্চিত করুন ফুটফুটে মেয়ের সুরক্ষা; শেখানো শুরু করুন শিশুবেলাতেই!

ঘরে-বাইরে নিশ্চিত করুন ফুটফুটে মেয়ের সুরক্ষা; শেখানো শুরু করুন শিশুবেলাতেই!

খবরের কাগজ হোক টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া হোক বা পাড়ায় ভাসা খবর; প্রায়দিনই শোনা যায় শিশু-নিগ্রহের ঘটনা। ফুলের মতো মেয়েরা তো বটেই, কচি ছেলেগুলোও বাদ যায় না মানুষরূপী জন্তুগুলোর দাঁত-নখের আঁচড় থেকে। প্রি স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েটির মায়ের রাতের ঘুম উড়েই যায় চিন্তায়। কারণ বিকৃত রুচির মানুষগুলো বয়সের ধার ধারে না। মেয়ে ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত মা-বাবা সহ পরিবারের সবাই কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তায়। মেয়ের মায়েদের এই আতঙ্ক বা দুশ্চিন্তাগুলো কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়! (Safety of the Girl Child: Tips for Parents, Safety Measures for the Girl Child)

ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটিকে বাইরে তো বটেই, ঘরেও চোখে চোখে রাখতে হয়। মেয়ের মা আমিও, তাই আপনাদের মনে কী ঝড় চলে সারাদিন, এ আন্দাজ আমি বেশ করতে পারি। তবে কি জানেন, ছোট থেকেই মেয়েকে বাস্তবের উপযোগী করে তৈরি করতে পারলে এই ভাবনা অনেকটাই হয়তো কমবে! একদম ছোট্ট বয়স থেকে মেয়েকে দিন সুরক্ষার শিক্ষা। কোন পরিস্থিতি খারাপ, কখন কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে বা কোন আচরণগুলো মানা একেবারেই ঠিক নয় (Safety Tips for Children); এইসবকিছু শিখিয়ে দিন মেয়েকে। আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন নিজের ফুটফুটে মেয়েটাকে। শিশুবেলা থেকেই কীভাবে সুরক্ষার পাঠ দেবেন মেয়েকে, প্রতিবেদনে রইল বিশেষ টিপস। জানতে হলে পড়ে ফেলুন! (Safety of the Girl Child: Tips for Parents)

 

৫-৯ বছর বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে (For Primary Schoolers (Ages 5–9))

এই বয়সের বাচ্চারা সবে হয়তো এক-দু’বছর হল, প্রি স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে প্রাইমারী স্কুলে ঢুকেছে। এত্ত কুচি বাচ্চাকে আর সুরক্ষার কী পাঠ দেবেন আপনি, এই ভেবেই আকুল হচ্ছেন তো? তাও, যতটুকু ওকে ওর মতো করে বোঝাতে পারবেন, বোঝান। সাহায্য করতে দিলাম টিপস (Parents’ Role in Child Protection);

#1. নিজের পরিচয় ঠোঁটস্থ করিয়ে দিন: মেয়েকে ওর নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম ও ফোন নাম্বার ভালো করে মুখস্থ করিয়ে দিন পাখিপড়ার মতো করে। সবসময় বিপদ যে মারাত্মক আক্রমণাত্মক হবে এমন তো নাও হতে পারে। কচি বয়সের কৌতূহলে হয়তো আপনার হাত ছাড়িয়ে হারিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে। তখন কিন্তু এই তথ্যগুলো দারুণ কাজে আসবে ওকে ফিরে পেতে। শুধু মেয়ে নয়, বাচ্চা ছেলের ক্ষেত্রেও এমনটাই করতে হবে।

#2. “না” বলতে শেখানঃ ওর যদি কোনও জিনিস ভালো না লাগে বা কারও সঙ্গ ওর ভালো না লাগে; ওকে “না” বলতে শেখান। শুধু কাউকে “না” বলা নয়; ও যেন আপনাকে এসে সেই কারণটাও বলে।

#3. অবিশ্বাস-ও কিন্তু ভালো জিনিস: অবিশ্বাস করতে শিখুক ছোট থেকেই। শুনতে উদ্ধত ও অসামাজিক মনে হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এই অবিশ্বাসটাই প্রয়োজন। কেউ কিছু কিনে দেবে বললো বা কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে বললো বা আপনি/ ওর বাবা ওকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন কেউ এমনও বললো, ও যেন বিশ্বাস না করে। বাবা, মা এবং পরিবারের গুটিকয় মানুষ ছাড়া ও যেন কাউকেই বিশ্বাস না করে। বড় হলে মানুষ যাচাই করার ক্ষমতা ওর মধ্যে এসে যাবে, কিন্তু ততদিন অবিশ্বাস করতেই শেখান। (Critical Safety Tips for Kids & Child Safety Tips for Parents)

#4. পরিস্থিতির মোকাবিলা: নানারকম গল্প শুনিয়ে, ওকে ওর মতো করেই ভালো/খারাপ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দিন। খারাপ পরিস্থিতি কী বা সেরকম কিছু আশেপাশে দেখলে কী করা উচিত; গল্পের ছলে এগুলো ওকে বুঝিয়ে দিন। গল্প হলেও কচি মনে কিন্তু এইগুলো দাগ কাটবে এবং কখনও কোনও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই ওকে বাঁচাবে।

#5. গুড টাচ আর ব্যাড টাচ শিখিয়ে দিন এখনই: জানি, বড্ড ছোট্ট আপনার মেয়েটা। এত কিছু মনে রাখতে পারবে কী? পারবে, উপায় আমরাই বলে দেবো। খেলতে খেলতেই কঠিন বাস্তবের পাঠ শিখিয়ে দিতে পারবেন ওকে;

  • মা ছাড়া কারও কাছে স্নান করতে দেবেন না। যদি আপনি কর্মরতা হন, তা হলে ওর আয়ামাসি/ঠাম্মা/ দিদা/ দিদি বা পরিবারের যে মহিলা ওর এবং আপনার খুব কাছের; একমাত্র তাদের কাছেই ও স্নান করবে।
  • গুড টাচ এবং ব্যাড টাচের তফাৎ শেখান ওকে। মা বা খুব কাছের কোনও মহিলা পরিজন ছাড়া ওর ঠোঁট, বুক, নিতম্ব, গোপনাঙ্গ কোনও ভাবেই স্পর্শ করবে না।
  • গালে হাত দিয়ে আদর করা, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে কোনও অসুবিধা নেই। এবং, যে আদরে ওর মনে মনে ভালো লাগবে সেই আদর ওকে করতেই পারেন পরিজনরা। (How to Protect a Girl Child)
  • যে ধরনের আদরে ওর অস্বস্তি হবে বা ব্যথা লাগবে বা আপনার শেখানো ব্যাড টাচের আওতায় পড়ে যে আদর; সেরকম পরিস্থিতিতে পড়লে ওকে সেই জায়গা থেকে পালিয়ে আসতে শেখান।
  • প্রয়োজন হলে ওর প্রিয় পুতুলটাকে নিয়ে গুড টাচ, ব্যাড টাচের পাঠ দিন।

 

#6. অচেনা কারও কোলে চাপা আর নয়: শুধু অচেনা বললে মনেহয় ভুল হবে, একটা বয়সের পরে মেয়েকে বাড়ির পুরুষদের থেকেও নিরাপদ দূরত্ব রাখতে শেখান। শুনতে খুব কটু লাগছে জানি, কিন্তু এটাই বাস্তব। বহু বাচ্চা মেয়ে বাড়ির মধ্যেই নিগৃহীত হয়; সমাজের ভয় মুখ খুলতে পারে না। তাই, শয়তানি সহ্য করার থেকে সাবধানতা অবলম্বন করাই ভালো নয় কি? বাবা ছাড়া কারও কোলে বেশিক্ষণ বসতে বারণ করুন মেয়েকে। (How to Protect a Girl Child)

#7. কেউ বউ বলে ডাকলে প্রতিবাদ করুন: ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে কারও “বউ” না। এমনকি আপনার ৬৫ বছর বয়সি তুতো শ্বশুরমশাইয়েরও নয়। কেউ যদি আপনার মেয়েকে “বউ” সম্বোধন করেন, তার প্রতিবাদ করুন। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিন যে, আপনি একেবারেই এসব পছন্দ করছেন না।

#8. মেয়ের সাথে প্রচুর গল্প করুন: মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো মিশুন। সবথেকে কাছের বন্ধু হয়ে উঠুন। প্রত্যেকদিনের গল্প যাতে আপনাকে উজাড় করে বলে, সেই জায়গা তৈরি করুন।

 

আরও পড়ুন : বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় কোন কোন বই তুলে দেবেন আপনার সন্তানের হাতে!


১০-১২ বছর বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে (For Preteens (Ages 10–12))

কন্যারত্নটি আপনার অনেকটাই বড় এখন। খারাপ, ভালো বোধ এসেছে ওর মধ্যে বা মায়ের কাছে মন খুলতে শিখেছে ও। এতদিন ওর সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য আশ্রয় ছিলেন, এবার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠুন।

#1. সতর্ক থাকতে শেখান: সতর্ক থাকলে এবং চোখ-কান খোলা রাখলে অনেক বিপদ এড়ানো যায়; সেটাই শিখিয়ে দিন ওকে। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বলে দিই?
খেলার গ্রুপের কোনও দাদা আলাদা ডাকলে যাবে না।
ফাঁকা রাস্তা, অন্ধকার গলি এড়িয়ে চলবে, তা সে যতই শর্টকাট হোক।
আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠো। কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না বা আমি যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা বুদ্ধি খাটিয়ে করতে পারি; এই আত্মবিশ্বাস নিজের মধ্যে তৈরি হলে ঘরে-বাইরে চলতে অনেক সুবিধা হবে ওর।

#2. নিজের নিরাপত্তা করুক নিজেই: মেয়ে মানেই নরমসরম, সেজেগুজে ঝুমঝুমিয়ে ঘুরে বেড়ানো বাড়ির পুতুলটি নয়। এই সংজ্ঞা বদলে গেছে বহুদিন। শুধু শিক্ষায় নয়, নিরাপত্তার মাপকাঠিতেও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলুন মেয়েটাকে। শুধু নাচ, গান, বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে নয়; মেয়ে দাপিয়ে বেড়াক ক্যারাটে-কুংফুর ক্লাসেও। নিজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারবে নিজেই।

#3. ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ থাকুকঃ কেউ মানুক আর না মানুক; আপনি নিজেও তো একটা মেয়ে, নিশ্চয় মানবেন যে মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটু বেশি সজাগ। আশেপাশে বিপদ ঘুরলে মেয়েরা ঠিক আঁচ পায়। আপনার মেয়েকেও শিখিয়ে দিন নিজের ইন্দ্রিয়ের কথা শোনা। বিপদ আঁচ করলে বা পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই যেন যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

 

১৩-১৮ বছর বয়সি টিনএজার মেয়ের জন্য (For Teens (Ages 13–18))

মেয়ে আপনার অনেকটাই বড় হয়ে উঠেছে, শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মনের পরিবর্তনও ঘটছে তার। বড় হওয়ার ধাপগুলো গল্পের ছলে বুঝিয়ে দিন মেয়েকে। কোনও কিছুই সরাসরি “না” বলে কেন “না” বলছেন বুঝিয়ে দিন সেটাও। মা-মেয়ের সম্পর্কের রসায়ন আরও জোরালো হবে। (How to Protect a Girl Child)

  • সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো খারাপ দিকগুলো তুলে ধরুন মেয়ের কাছে।
  • অত্যধিক শাসনের ঘেরাটোপ নয়, সতর্ক নজরে জড়িয়ে রাখুন মেয়েকে।
  • এই বয়সি মেয়েরা খারাপ ব্যবহার বা বিপদ বুঝে যায় সহজেই, কাজেই ওকে আর কিছু আলাদা করে বোঝাতে হয় না। শুধু দেখুন, ও যেন সবকিছু আপনাকে মন খুলে বলে, ওর অপছন্দের কিছু যেন আপনার থেকে চেপে না যায়। (How to Protect a Girl Child)

 

এবার, প্রতিবেদনের শেষে একটা কথা না বলে পারছি না; পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে কারও যদি মনে হয় আমরা সম্পূর্ণভাবে পুরুষবিরোধী কথা বলেছি, তারা কিন্তু খুব ভুল ভাবছেন। বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে “মা” বা “মহিলা স্বজনে”র কথা বারবার উঠে এসেছে জানি, সেটা কিন্তু শুধুমাত্র সতর্কীকরণের খাতিরে। (How to Protect a Girl Child)

আমরা জানি, পরিবারে “বাবা” ছাড়াও এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা আপনার মেয়েটিকে নিষ্পাপ ভাবে ভালোবাসেন এবং যত্ন করেন। আমাদের চারপাশেও এমন অনেক পুরুষ আছেন, যাদের ওপর আমরা নিজেদের থেকে বেশি বিশ্বাস করি। কাজেই পুরুষ মানেই আতঙ্ক, এমন ভাবাটা ভীষণ ভুল।
মেয়েকে বাচ্চা বয়স থেকেই ঠিক-ভুলের পাঠ দিন, নিজেকে সুরক্ষিত রাখার পাঠ দিন, পুরুষ বা মহিলা নয়; ওকে সঠিক মানুষ চিনতে শেখান। (Safety of the Girl Child: Tips for Parents)

 

আরও পড়ুন: যৌথ বা অণু পরিবার, কচি-মনের চাহিদা মেটানোই শেষ কথা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। 

 

null

null