যৌথ পরিবার প্রায় ইতিহাস। কয়েকশো স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটে এখন সব অণু-পরিবারের বাস। বাবা-মা আর এক সন্তান, বড় জোর দুই। সেখানে কারও জন্য কারও সময় নেই!
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মনের মধ্যে যে হাজার প্রজাপতি রং পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকে, তা ভাগ করে নিতে কচি মন উসখুস করলেও শোনার মতো কেউ থাকে না বাড়িতে। মনখারাপের পাল্লা ভারী হতে হতে তার মধ্যে ঘুণপোকার মতো মাথা গলায় একাকিত্ব, অবসাদ নামক দস্যু-দানবেরা। (Role of Family in Child Development in Bangla. Sishur bikashe poribarer bhumika. Role of family in child development in Bengali.)
মনোবিদেরা বলবেন, এ-রোগের একমাত্র দাওয়াই যৌথ পরিবার! দাদু-ঠাকুমা-কাকা-পিসি-দাদা-দিদি কারও না কারও কাছে শিশুর কচি মন ঠিকই আশ্রয় পেয়ে যাবে। উজাড় করে মেলে ধরতে পারবে নিজের চড়াই-উতরাই। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলবে, ইঁদুর দৌড়ের যুগে যৌথ পরিবারের ধারণাটাই অলীক! কর্মসূত্রেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র বাসা বাঁধতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক দম্পতিই। এবার তাঁদের যখন সন্তান হবে, শিশুর মনের চাহিদা মেটাতে কোথা থেকেই বা কাকা-পিসিতে ভরা বিশাল একটা পরিবার হাজির করবেন তাঁরা?
আমরা বলব, যৌথ হোক কিংবা অণু, শিশুর মনের চাহিদা মেটানোই শেষ কথা। সে দাদু-দিদা করুক, কিংবা আপনি বা আপনার সঙ্গীটি! নিশ্চিত করুন, কোনও ভাবেই বিষণ্ণতা যাতে বাসা না বাঁধতে পারে শিশু-মনে। কোনও ভাবেই যাতে একলা বা আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে যায় সে। বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় হাত বাড়ালেই যাতে একটা বন্ধুত্বের, ভরসার হাত পায় তারা। আর সে জন্যই প্রয়োজন তাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া! আমরা জানি, সংসারের হাল টানতে দু’জনেই দিনভর ছুটছেন আপনারা। তা-ও বলছি, যতটুকু সময় পাবেন ততটুকু ‘কোয়ালিটি টাইম’ শুধুমাত্র আপনার পুঁচকেটার জন্যই বরাদ্দ থাক। কেন? উত্তর রইল নীচে…
শিশু-মন খানিকটা, না খানিকটা কী বলছি পুরোটাই নরম স্পঞ্জের মতো! ও সেটাই আত্মস্থ করবে যেটা ও দেখছে, শুনছে। আপনি যাঁকে সম্মান করছেন, আপনি যাঁর কদর করছেন, শিশুর মনেও অজান্তে তাঁরই প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তৈরি হবে। আপনি যাঁকে অপছন্দ করবেন, তাঁর প্রতি অবজ্ঞা জন্মাবে শিশু-মনেও। তাই বলছি, শিশুর সামনে ভেবেচিন্তে কথা বলুন, দরকারে নিজের রাগ-অভিমান একটু দমিয়ে রাখুন। বাড়িরই কারও উপর হয়তো রাগ হলো আপনার, কিছু না ভেবেই কথা শুনিয়ে দিলেন! আপনার ছানাটিও সঙ্গে সঙ্গে সেই আচরণই রপ্ত করবে। রাগ দেখাবে নির্দিষ্ট সেই মানুষটির উপর। এরই পাশাপাশি কচি বয়স থেকেই মূল্যবোধের শিক্ষা দিন ওকে। মুখে বলার চেয়ে সবচেয়ে ভালো হয় কোনও কিছু যদি নিজে করে দেখান আপনি। কিছু ভুল করলে চড়-চাপাটি না দিয়ে ধৈর্য ধরে বোঝান ওকে। কোনও কিছু খারাপ করলে তার ফল যে খারাপই হবে, এ কথা উদাহরণ দিয়ে বলুন। আপনি/ আপনারাই পারেন, মূল্যবোধের ভিতের উপর ওর জীবনটা তৈরি করে দিতে…
ছোট্ট শিশুর কাছে সমাজ বলতে তো ওই আপনিই, আপনার সঙ্গীটি আর খুব বেশি হলে পরিবারের বাকিরা। শিশুর ভিতর তাই সামাজিক বোধের বিকাশ মানে সে-সব আচার-আচরণেরই বিকাশ যেটা আপনি/ আপনারা করেন বা মানেন! আপনার ও আপনার পরিবারের মধ্যে হাসিখুশি-সরল-পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্ক থাকলে আপনার শিশুর ভিতরও পজিটিভ এনার্জি তৈরি হবে। গোটা সমাজকেই ও পজিটিভ (ইতিবাচক) নজর দিয়েই দেখবে। রাতের খাবারটা অন্তত এক-টেবিলে, একসঙ্গে খান, একসঙ্গে টিভি দেখুন, বা স্রেফ আড্ডা দিন, দেখবেন আপনার শিশুর মনেও মিলেমিশে, একসঙ্গে বাঁচার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। আপনি বা আপনার পরিবার ওর সঙ্গে যেভাবে মিশবেন, যেভাবে কথা বলবেন বড় হয়ে বাইরের জগতে সেই একই আচরণ ফিরিয়ে দেবে ও। বলাই বাহুল্য এভাবেই নতুন নতুন বন্ধু হবে ওর, সম্পর্কের মূল্য বুঝবে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে শিখবে, অবলীলায় মানিয়ে নিতে পারবে যে কোনও পরিবেশে।
শিশু-মনে নিরাপত্তা নিয়ে আবছা একটা ধারণা জন্মে যায় একেবারে কচি বয়সেই। আর সেটা হয় পরিবারের হাত ধরেই। বেঁচে থাকার এক্কেবারে গোড়ার চাহিদা, অর্থাৎ রোজের খাবার-মাথা গোঁজার ঠাঁই-আর পরনের কাপড়, এসবের জোগান দেয় পরিবার। আর তাই নিজের পরিবারটাই সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে আস্থার আস্তানা হয়ে ওঠে শিশুর কাছে। পরিবারই হয়ে যায় ভালো লাগার, মন্দ লাগার সঙ্গী। বাইরে তাই খানিক লাজুক, চুপচাপ থাকলেও ঘরে-পরিবারে এক্কেবারে ছন্নছাড়া থাকে কচিকাঁচারা। আর এই ছন্নছাড়া থাকার পরিবেশটাও তৈরি করে দিতে হবে আপনাকেই। বাড়িতে যাতে মন খুলে থাকতে পারে ও, মন খুলে নিজের অনভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে! মনের চাহিদা যদি বাড়িতেই মিটে যায়, তা হলে বাইরের ‘নিষিদ্ধ’ কোনও কিছুই আর হাতছানি দেয় না বাড়ন্ত মনকে। সুরক্ষা আর নিরাপত্তার আশ্বাসই মনে-শরীরে আরও সবল করে তোলে ওকে!
উপরের পয়েন্টের রেশ ধরেই বলছি, হ্যাঁ পরিবারই শিশুর মন-শরীরের সার্বিক বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ছোট-থেকেই নানান খেলাধূলায় আগ্রহী করে তুলুন ওকে। এতে ওর হাত-পা শক্ত, পোক্ত তো হবেই, পাশাপাশি তৈরি হবে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। খেলাধূলাই উন্মুক্ত মনের মানুষ করে তুলবে ওকে। তাই বলছি, শিশু যখন হামা দিতে শুরু করবে তখন থেকেই নানান রঙিন খেলনা নিয়ে ওর সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। রঙিন খেলনা তাক করেই হামা দিয়ে এগোবে ও। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানো, টলমল পায়ে হাঁটা, চমকে দিয়ে হঠাৎই একছুটে খেলনাটা পাকড়ে ফেলা! এ-তো গেল খেলাধূলার পার্ট, এবার বলি ভাষা-বিকাশের কথা। শিশু যাতে ঠিক সময় কথা বলতে পারে, গুণগুণ করতে পারে, ছড়া কাটতে পারে, তার বন্দোবস্ত করতে হবে আপনাকেই। যখনই সময় পাবেন, ওর সাথে কথা বলুন, গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ান, খাবার খাওয়ান। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাদার তালটা হঠাৎই হয়তো বলে উঠল মা!
এরই পাশাপাশি শিশুর নানা অনভূতি-বিকাশেও কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে আপনার/ আপনার পরিবারের। ভালোবাসা, সমবেদনা, সহানভূতি, অভিমান, রাগ, জেদ- শিশু-মনে এই সব অনুভূতির আস্তে আস্তে বিকাশ হয় পরিবারের হাত ধরেই। পরিবার পাশে না থাকলে অনুভূতির বিভিন্ন দিকগুলোই তো পরিষ্কার হবে না ওর কাছে। আর সেটা না হলে নিজের মনের ভাব ঠিকঠাক প্রকাশও করতে পারবে না সে। পরবর্তীতে নিজেকে ব্যক্ত করার এই অক্ষমতাই হয়তো কোনও বিপদ ডেকে আনল ওর!
তাই বলব, শিশু-মনকে শিশুর মনের মতো করেই বোঝার চেষ্টা করুন। ছোট্ট একটা প্রাণকে তিলে তিলে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। দূরে থাকা কারণে হোক বা অন্য কিছু, বাড়ির বড়দের সাহায্য না হয় নাই বা পেলেন, মা-বাবা হিসেবে আপনারাও তো কম পারদর্শী নন! এ কথা মানছি যে, দিনের বেশিটা সময়ই কাজের প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে থাকতে হয় আপনাদের। বাড়ির পরিচারিকার সাহচর্যে শিশুটিকে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে রেখে যেতে বাধ্য হন। তিনি হয়তো শিশুটির খাওয়া-ঘুমের প্রয়োজনগুলোকে যত্ন নিয়েই মেটান। কিন্তু মনের খোরাক?
সেটা মেটাক পরিবারই। তা সে যৌথ হোক, অণু হোক কিংবা পরমাণু! (Role of Family in Child Development in Bangla.)
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null