স্তন্যপানের পরেও কাঁদতে পারে শিশু, রইল কারণ-সমেত সমাধান!

স্তন্যপানের পরেও কাঁদতে পারে শিশু, রইল কারণ-সমেত সমাধান!

পেট পুরে সবে খেয়েছে একরত্তি। ভাবছেন, তাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও খানিক জিরিয়ে নেবেন এবার। কিন্তু এ কী! ঘুমানো তো দূর অস্ত, গলা ফাটিয়ে ফের কান্নাই জুড়ে দিল বাড়ির সবচেয়ে খুদে সদস্যটি। তবে কি পেট ভরল না তার? না কি অন্য কোনও কারণ? স্তন্যপানের পরেও বাচ্চার কান্না নিয়ে এ ভাবেই হয়রান হন নতুন মায়েরা। রেহাই মিলবে কী করে?
তা নিয়েই বিশদে আলোচনা করব আমরা। একরত্তি কি শুধুই ক্ষুধার্ত, নাকি আপনার ধারেপাশে থাকতে স্রেফ ভান করছে সে। অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা হচ্ছে, নাকি স্তন্যপানই নাপসন্দ তার! (Reasons why babies act hungry even after breastfeeding in bengali)

 

 দেখে নিন, ঠিক কী কী কারণে স্তন্যপানের পরেও কাঁদতে পারে বাচ্চারা। সঙ্গে সমাধানও (Why babies cry even after breastfeeding in bangla)

 

 #1.‘দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’ (Growth Spurt)

জন্মের পর প্রথম বছর নির্দিষ্ট কিছু সময়ে শিশুর বৃদ্ধি হয় লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে। ইংরেজিতে একেই বলে ‘গ্রোথ স্পার্ট’। সময়টা যদি চিহ্নিত করতে চান, তা হলে সেটা অনেকটা এরকম- জন্মের পর প্রথম ৭-১০ দিন, তারপর দ্বিতীয়-তৃতীয় সপ্তাহ, চতুর্থ-ষষ্ঠ সপ্তাহ, তারও পরে তৃতীয় মাস, ষষ্ঠ মাস ও নবম মাস। সাধারণত দিন দুই-তিন, কখনও সখনও এক সপ্তাহ পর্যন্তও বেড়ে ওঠার এই প্রক্রিয়ার রেশ থেকে যায় শিশুর শরীরে। আর এ কারণেই খিদে খিদে ভাব কিছুতেই কাটতে চায় না তার।
তো মায়েরা, যদি আপনার বাচ্চা হঠাৎই খিটখিটে হয়ে পড়ে, কিংবা সে খেতেই থাকে সারাদিন, চিন্তা না করে ক্যালেন্ডারটা খালি মিলিয়ে নিন একবার।

 

সমাধা (Solution)– বৃদ্ধির কারণেই এমন সমস্যা হলে বাচ্চাকে তার নিজের মতো থাকতে দেওয়াটাই শ্রেয়। ও যতটা খেতে চাইছে, যখন খেতে চাইছে, চাহিদাটা পূরণ করুন। স্তন্যপান যেহেতু পুরোটাই চাহিদা-জোগানের নিরিখে চলে, আপনার শরীরই আপনার বাচ্চার চাহিদা মতো দুধ তৈরি করে দেবে। আপনি শুধু যথেষ্ট জল আর স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে থাকুন।

 

 #2. মায়ের গন্ধ (Nursing for Comfort)

স্তন্যপানে যে শুধুই পুষ্টির জোগান হয় এমন নয়, মায়ের এতটা কাছে থাকার সুযোগ বাচ্চাকে আরাম দিতে আর নিরাপদ বোধ করতেও সাহায্য করে। বাচ্চা যে সবসময় দুধ খাওয়ার জন্যই কাঁদছে, এমনটা ভেবে নেওয়া তাই ভুল। মায়ের বুকের আড়ালে কাটানো এই সময়টায় বাচ্চা খানিক স্বস্তি পায়। নির্বিঘ্নে কিছু সময় ঘুমিয়েও নিতে পারে সে।
তবে হ্যাঁ, পেট ঠিকঠাক ভরেছে কি না অবশ্যই খেয়াল রাখুন। রোজ ক’টা ডায়াপার লাগছে খেয়াল রাখুন, ওজন বাড়ছে কি না, দেখতে থাকুন। নজর রাখুন ওর পটির রং আর ঘনত্বেও।

 

সমাধা (Solution)– বাচ্চাকে আরও বেশি করে নিজের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করুন। যাতে স্পর্শ না পেলেও ও আপনার গন্ধটুকু পায়। এতেই সে শান্ত, এতেই সে নিরাপদ।

 

 #3. ঘন দুধের কমতি (Inadequate milk Supply)

বাচ্চারা যখন স্তন্যপান করে, মায়ের থেকে দু’রকমের দুধ পায় তারা। প্রথমে আসে অপেক্ষাকৃত পাতলা দুধ। ল্যাকটোজের মাত্রা খানিক বেশিই থাকে এতে। ঘন, থকথকে দুধ মেলে স্তন্যপানের শেষের দিকে। আর এটা পুরোপুরি প্রোটিন সমৃদ্ধ। ঘন এই দুধটা খাওয়ার পরই সত্যি বলতে পেটের চেয়েও মন ভরে বাচ্চার।
যদি আপনার শরীরে এমনিতেই অনেক বেশি দুধ তৈরি হয়, তা হলে আশঙ্কা থাকে বাচ্চা হয়তো প্রথম দিকের পাতলা দুধ খেয়েই পেট ভরিয়ে ফেলছে। প্রোটিন আর পেটেই যাচ্ছে না তার। মন না ভরায় তাই পেট পুরে খেয়েও কেঁদে উঠছে সে, আরও খেতে চাইছে।

 

সমাধা (Solution)– বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। শরীরে দু’ধরনের দুধের মধ্যে ভারসাম্য এলে কান্না থেকে রেহাই পাবে বাচ্চাও। এ ছাড়াও স্তন্যপানের সময় বাড়িয়ে অথবা পাতলা দুধ এমনিই খানিক বের করে দিয়ে ঘরোয়া ভাবে সমস্যা সামাল দিতে পারেন।

 আরও পড়ুনঃ আঠারো মাস হতেই মায়ের দুধ খাওয়ার ইতি!

 

 #4. দুধের জোগানেই ঘাটতি (Inadequate Milk Supply)

মায়ের শরীর কখনও সখনও যথেষ্ট দুধই তৈরি করতে পারে না। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে। হয়তো আপনার থাইরয়েড আছে, কিংবা হরমোনঘটিত কোনও সমস্যা, অথবা নির্দিষ্ট কোনও ওষুধের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে। বাচ্চার প্রস্রাব যদি গাঢ় রঙের হয় আর তার ওজন বৃদ্ধিতে খামতি দেখা যায়, বুঝে নিন যথেষ্ট খাবার পাচ্ছে না সে।

 

সমাধা (Solution)– দুধের জোগান বাড়াতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এখনই। নতুবা ‘ফর্মুলা ফিডিং’এর ব্যবস্থা করুন। ঘরোয়া কিছু টোটকাও কাজে আসতে পারে। যেমন, অনেক সময় হয় স্তনে যথেষ্ট রক্ত চলাচল না হওয়ায় দুধের জোগান কমে যায়। সে ক্ষেত্রে স্তন্যপান করানোর আগে ‘ওয়ার্ম কমপ্রেস’এর সাহায্য নিন। গরম কিছু নিয়ে সেঁক দিন, উপকার মিলবে। এ ছাড়াও রোজের খাবারে অবশ্যই শাক-সবজির পরিমাণ বাড়ান। সঙ্গে চাই মেথি, মৌরি, রসুন আর অনেকটা জল।

 

 #5. কোষ্ঠকাঠিন্য হয়তো! (Baby has to pass Gas or Stool)

পেটে গ্যাস হয়েছে হয়তো, কিংবা পটি হচ্ছে না। স্তন্যপান করেই এমন জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায় আপনার ছানা। অদ্ভূত শোনাচ্ছে তাই তো? বিদঘুটে মনে হলেও বিষয়টা অনেক সময় এরকমই। স্তন্যপান করার সময়ই বাচ্চার অন্ত্রে নড়াচড়া হতে থাকে। যাতে সহজেই পেটে জমে থাকা গ্যাস কিংবা পটি বেরিয়ে আসে। পেটভারের সমস্যা থেকে রেহাই পায় খুদে মানুষটি।

 

সমাধা (Solution)– স্তন্যপান করার পরই বাচ্চা যদি পটি করে, বুঝে নিন স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই পেটের বর্জ্য সহজে বের করতে বায়না করছিল সে। এ ছাড়া আপনি নিজেও ওকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন-
গরম তেল মালিশ করুন ওর পেটে, সাইক্লিং করান, হিংয়ের জল বুলিয়ে দিন নাভির আশপাশে। নিমেষে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পাবে একরত্তি।

 

 #6. ক্লান্তি আর বিরক্তি (Tiredness)

কী ভাবেন? বাচ্চা বলে কি বোর হতে নেই? সারাদিন একঘেয়ে কাজ। হয় ঘুমাও, নয় খাও, নতুবা হাত-পা নাড়াও। এর বাইরে আর কীই বা পারে সে। একঘেয়েমি তো আসবেই। আর এই একঘেয়েমি থেকেই খেয়াল করে দেখবেন, মাঝে সাঝেই হাত মুঠি করে ছুড়ছে সে, কিংবা মুখে অঙ্গভঙ্গি করছে, অথবা রাগ দেখাচ্ছে। বাচ্চা যে বিরক্ত বা ক্লান্ত, এগুলো তারই প্রমাণ। অনেক সময় এই একঘেয়েমি কাটাতেই বাচ্চা স্তন্যপান করতে চায়। কেননা সে জানে, মায়ের কাছে এলেই ঘুম পাবে তার, আর ঘুমালেই একঘেয়েমির সময়টা পেরিয়ে যাবে অনেকটা।

 

সমাধা (Solution)– এর একটাই উপায়, বাচ্চাকে স্তন্যপান করতে দিন, যতক্ষণ না ও ঘুমিয়ে পড়ছে।

 

 #7. শেষপাতে (Yummy Dessert)

শেষপাতে সুড়সুড়ি, আদর, আর মায়ের বুকে মুখ রেখে ঘাপটি মেরে থাকাটাই বাচ্চার কাছে রসগোল্লার মতো মিষ্টি হয়ে ওঠে। হয়তো স্তন্যপান করে তার পেট ভরেছে, কিন্তু মন ভরেনি। তাই সে বায়না করতেই থাকবে। এতে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে তার খিদে পাচ্ছে, এই আব্দারটা হয়তো স্রেফ তার অভ্যাস।

 

সমাধা (Solution)– খাওয়ার পর আমরা যেমন শেষপাতে মিষ্টি খাই, পেট ভরলে পর একরত্তিরকেও স্রেফ বুকে মুখ ঠেকিয়ে শুয়ে থাকতে দিন। বুকে মুখ গুঁজে খানিক বিরাম নিক সে। ছানা ঘুমালে তবেই না মায়ের ঘুমের ফুরসৎ! কে বলতে পারে, ফের হয়তো জেগে উঠল এখনই!

 

সব শেষে এটাই বলব, মায়ের মানসিক অবস্থার সাথে শিশুর ভালো থাকা, মন্দ থাকা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিশুকে হাসিখুশি, চনমনে রাখতে গেলে মায়ের মুখেও তাই সবসময় একগাল হাসি প্রয়োজন! শিশুর ভালো থাকার কথা ভেবে, তার ভালো থাকাটা নিশ্চিত করতে গেলে ভালো থাকতে হবে মাকে নিজেকেও। আর যদি একান্তই সেটা নিজে থেকে করা সম্ভব না হয়, তা হলে অবিলম্বে পরামর্শ নিতে হবে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের।

 আরও পড়ুনঃ কীভাবে বুঝবেন বাচ্চার কান্নার ভাষা?

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null