ঘনঘন সংক্রমণ? স্বাস্থ্যরক্ষায় খুদেকে খাওয়ান প্রোবায়োটিকস্ সমৃদ্ধ খাবার!

ঘনঘন সংক্রমণ? স্বাস্থ্যরক্ষায় খুদেকে খাওয়ান প্রোবায়োটিকস্ সমৃদ্ধ খাবার!

নমিতার একমাত্র সন্তান জিতুর বয়স সবে একবছর। জিতু প্রায়ই ডায়ারিয়ার সমস্যায় ভোগে। কীভাবে ওকে সারিয়ে তোলা সম্ভব সে ব্যাপারে পরামর্শ নিতেই নমিতা চিকিৎসকের কাছে এসেছে। সমস্তটা শুনে চিকিৎসক ওর খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিলেন। সেই কথাসূত্রেই এসে পড়লো প্রোবায়োটিকস্-এর কথা। (Probiotics For Babies; When to Introduce, How Do They Work)
শব্দটা শুনেই নমিতার ভুরু কুঁচকে গেল। সে এই নামটা আগে কখনও শোনেনি। নমিতার মুখ দেখে চিকিৎসক তা ধরতে পারলেন। তিনিই বুঝিয়ে বললেন প্রোবায়োটিকস্ কী জিনিস, কেন এটা খুদের জন্য প্রয়োজনীয়।

 

প্রোবায়োটিকস্ কী? (What are probiotics?)

চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রোবায়োটিকস্-কে বলা হয় বন্ধু ব্যাকটেরিয়া বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া। এরাই আমাদের শরীরকে নানা রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। শরীর বলতে বিশেষত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক বা খাদ্যনালী। খাদ্যনালীতে থাকে বহুসংখ্যক প্রোবায়োটিকস্। এদের উপস্থিতির কারণে আমাদের পেটে সহজে কোনও রোগ হয় না।

প্রোবায়োটিকস্ শরীরের জন্য ভালো হলেও শিশুর ছোট্ট শরীর সবরকম প্রোবায়োটিকস্-এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। একারণেই চিকিৎসকরা বেবি প্রোবায়োটিকস্-এর কথা বলেন। বেবি প্রোবায়োটিকস্ আসলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়া, যাদের উপস্থিতি শিশুর শরীর সহজে মানিয়ে নিতে পারে।

 

শিশুর প্রোবায়োটিকস্ প্রয়োজন কি? (Do Baby Need Probiotics?)

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর অবশ্যই প্রোবায়োটিকস্ প্রয়োজন। মায়ের গর্ভে থাকার সময়েই শিশুরা ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়। ভ্রুণের চারপাশে থাকে যে অ্যামনিওটিক তরল থাকে, তাতেই অজস্র ব্যাকটেরিয়া থাকে। তবে এতে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কম থাকে।

  • প্রোবায়োটিকস্ ছোট্ট শরীরকে খাবার থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।
  • পরিবেশের দূষণের কারণে খাবারের মধ্যে অনেকসময় আনুবীক্ষণিক জীবাণু থাকে। এই জীবাণুদের নাশ করতেও সাহায্য করে প্রোবায়োটিকস্।
  • শিশুর জন্মের সময় তাদের খাদ্যনালী সম্পূর্ণ ব্যাকটেরিয়াহীন হয়। যার ফলে খাবার হজমে তুলনায় বেশি সময় লাগে। তাই নির্দিষ্ট বয়সের পর চিকিৎসকরা খাবারের তালিকায় প্রোবায়োটিকস্ সমৃদ্ধ খাবার রাখার পরামর্শ দেন।

কখন শুরু করা উচিত? (When to introduce probiotics?)

খুদে যতদিন স্তন্যপান করছে, ততদিন তার প্রোবায়োটিকস্-এর প্রয়োজন হয় না। মায়ের বুকের দুধ সোনামণির খাদ্যনালী সহজেই হজম করতে পারে। বরং শক্ত খাবার খাওয়ার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রোবায়োটিকস্-এর প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। শক্ত খাবার খাদ্যনালীর পক্ষে হজম করা অপেক্ষাকৃত কঠিন। তা ছাড়া শক্ত খাবারের তালিকায় থাকে নানারকম সবজি, ফল ইত্যাদি। এগুলোর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে ছোট্ট খাদ্যতন্ত্রের প্রয়োজন প্রোবায়োটিকস্। মোটামুটি একবছরের মাথায় সব শিশুরাই শক্ত খাবার খেতে শুরু করে। তাই এই সময় থেকেই খুদেদের প্রোবায়োটিকস্ দেওয়া উচিত।

 

প্রোবায়োটিকস্ কীভাবে দেবেন? (How To introduce Probiotics For Babies?)

ছোট্ট সোনাকে যে কোনও নতুন কিছু খাওয়ানো রীতিমতো একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। নমিতার মনে এই প্রশ্নটা কিছুক্ষণ ধরেই উঁকি মারছিল। চিকিৎসক এবারে সেই প্রসঙ্গেই এলেন।

#1. স্তন্যদুগ্ধ: ছোট্ট সোনার শরীরে প্রথম প্রোবায়োটিকস্ আসে মায়ের দুধ থেকেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের দুধই একবছরের কমবয়সি শিশুদের শরীরে প্রোবায়োটিকস্ ও ইমিউনোগ্লোব্যুলিন সরবরসাহ করে। মায়ের দুধ থেকে পাওয়া প্রোবায়োটিকস্-এর কারণে খুদের খাদ্যাতন্ত্রে সহজে কোনও রোগ হয় না। বরং খাবারও সহজে হজম হয়ে যায়।

#2. ইয়োগার্ট: ছোট্ট সোনার মুখে শক্ত খাবার হিসেবে ইয়োগার্ট পড়লে তার হাসি দেখার মতো হয়। ইয়োগার্ট অনেক শিশুরই প্রিয় খাবার। পাশপাশি বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিকস্। দুধ থেকে সন্ধান প্রক্রিয়ায় (Fermentation) তৈরি এই খাদ্যে থাকে ল্যাক্টোব্যাসিলাস, বিফিডোব্যাকটেরিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রোবায়োটিকস্।

#3. কেফির: ছোট্ট সোনার উপযোগী খাবার হিসেবে বিশেষজ্ঞরা কেফিরের কথা বলে থাকেন। দুধ থেকে সন্ধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়। প্রোবায়োটিকস্‌ সমৃদ্ধ এই খাবার অন্যান্য খাবার থেকে শরীরকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চার ওজন বাড়াতে সহায়ক ঘী মেলানো ৫টি রেসিপি। ট্রাই করুন আজই!

 

#4. মিসো: সোয়াবিন তিন-চার বছর বয়সের অনেক খুদেরই প্রিয় খাবার। সোয়াবিন থেকেই সন্ধান প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় মিসো। এর সন্ধান প্রক্রিয়া ভালো ব্যাকটেরিয়ার কালচারের মাধ্যমে হয়। তাই মিসোও আগের দু’টির মতো প্রোবায়োটিকস্-এ ভরপুর।

#5. সউক্রট: সরু সরু করে কাটা বাঁধাকপিকে ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সন্ধান করে (Fermentation) তৈরি হয় সউক্রট। সউক্রটে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিকস্ ছাড়াও থাকে ভিটামিন সি, বি ও কে।

#6. প্রোবায়োটিকস্ সাপ্লিমেন্ট: উপরের কিছু পরিচিত খাবার থেকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোবায়োটিকস্ পাওয়া যায়। তবে অনেক চিকিৎসক বেশকিছু প্রোবায়োটিকস্ সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেগুলিও খাদ্যতন্ত্রে খাবার হজম করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি বাইরে থেকে আসা জীবাণুকে রোগ ছড়াতে বাধা দেয়। তবে আপনার খুদের জন্য এমন সাপ্লিমেন্ট কেনার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

খুদের ছোট্ট শরীরে প্রোবায়োটিকস্ কী কী কাজ করে? তা জেনে নিলেই প্রোবায়োটিকস্-এর উপকারিতাগুলো বোঝা যায়। নমিতাকে চিকিৎসক সেগুলোও বললেন।

 

খুদের শরীরে প্রোবায়োটিকসের কাজ (How Do They Work)

  • রিফ্লাক্স কমায়: শিশুদের খাদ্যনালী প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পরিণত হয় না। তাই যে কোনও খাবার খাওয়ার পর গ্যাস্ট্রোএসোফেগাল রিফ্লাক্স শিশুদের বড়রকমের সমস্যা। এতে বুকের নীচে খাদ্যনালী বরাবর প্রদাহ হতে থাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রোবায়োটিকস্ খাদ্যনালীর এই রিফ্লাক্স কমাতে সাহায্য করে।

 

  • ডায়পার র‍্যাশ কমায়: সোনামণির ডায়পার র‍্যাশের অন্যতম কারণ হল ইস্ট নামক ফাঙ্গাস। প্রোবায়োটিকস্-এর পরিবারে থাকা ল্যাক্টোব্যাসিলাস ও বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম খুদের ডায়পার রাশ কমাতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, এই দুই ব্যাকটেরিয়া ভবিষ্যতেও ডায়পার র‍্যাশ হওয়া আটকায়।

 

  • মুখের সংক্রমণ: অনেকসময় জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত স্তনবৃন্তের কারণে ছোট্ট সোনার মুখে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের সংক্রমণ। একেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইনফ্যান্ট থ্রাশ বলা হয়। এতে খুদের মুখের ভিতরে ও চারপাশে রাশ হয়। অ্যাসিডোফিলাস নামক প্রোবায়োটিক এই সংক্রমণকে প্রতিরোধ করে। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট‌‌‌ নেওয়া উচিত।

 

  • ডায়ারিয়া: ডায়ারিয়ার কারণে ছোট্ট সোনার বারবার তরলের মতো পায়খানা হচ্ছে। এই অবস্থায় চিকিৎসকরা শুধুমাত্র প্রোবায়োটিকস্ খাওয়ার পরামর্শ দেন (Probiotics for Babies With Diarrhea)। প্রোবায়োটিকস্ খাদ্যনালীকে আগের মতো স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে। ফলে খাবার ঠিকমতো হজম হওয়ার সুযোগ পায়। ডায়ারিয়াও অল্প সময়ের মধ্যেই কমে যায়।

 

  • কোষ্ঠকাঠিন্য: ডায়ারিয়া যেমন শরীরের জন্য খারাপ তেমনই কোষ্ঠকাঠিন্যও। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুদের খাদ্যতন্ত্রে কোনও কারণে প্রোবায়োটিকস্-এর ভারসাম্য নষ্ট হলে এমন সমস্যা দেখা দেয়। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রেও প্রোবায়োটিকস্ই ভরসা।

 

  • বায়ু কমায়: বাচ্চাদের খাদ্যনালী অপরিণত হওয়ায় গ্যাসের সমস্যা প্রায়শই দেখা যায়। যে কারণে শিশুর কান্নাকাটি লেগেই থাকে‌। ল্যাক্টোব্যাসিলাস রিউটেরি (reuteri) নামক প্রোবায়োটিক ওর খাদ্যতন্ত্রকে সঠিকভাবে খাবার হজম করতে সাহায্য করে (Probiotics for Babies With Gas)। এতে ছোট্ট সোনার অ্যাসিডজনিত ব্যথা কম হয়।

 

  • ভিটামিন উৎপাদন: খুদের দেহে প্রোবায়োটিকস্ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন উৎপাদন করে। ফলে ভিটামিনের ঘাটতিজনিত রোগে ও সহজে আক্রান্ত হয় না।

 

  • অনাক্রম্যতা: কিছু অনাক্রম্যতা (Immunization) শরীরের ভিতরে নিজে থেকেই গড়ে ওঠে। এই অনাক্রম্যতাগুলো গড়ে তুলতে প্রোবায়োটিকস্ই মুখ্য ভূমিকা নেয়।

 

  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: প্রথমবার প্রোবায়োটিক খাবার খেলে শিশুদের শরীরে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো বেশি দিন স্থায়ী হয় না। প্রোবায়োটিক গ্রহণ করার পর সামান্য পেটে ব্যথার লক্ষণ দেখা যায়। প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথম দু-এক দিন পুঁচকের অ্যাসিডিটি হতে পারে। এই সময় পেট সামান্য ফুলে যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ছোট্ট সোনার ডায়রিয়া হতে পারে।

চিকিৎসকের কথামতো নমিতা জিতুকে প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো শুরু করে। প্রথম দু’একদিন খাওয়ার পর ওর পেটে ব্যথা হত। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে পেটে ব্যথা গায়েব। শুধু তাই নয়, এরপর থেকে খাওয়াদাওয়ার ফলে ডায়ারিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য কোনওটাই তেমন হত না। জিতু সুস্থ হয়ে ওঠায় নমিতার মুখেও হাসি ফুটলো। (Probiotics For Babies; When to Introduce, How Do They Work)

 

আরও পড়ুন: অপুষ্টিই ঘটাতে পারে শিশু-মৃত্যু! সচেতন হোন আজই!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null