গ্রীষ্মে হবু মায়েরা নিজেদের খেয়াল রাখবেন কীভাবে? রইল তার সন্ধান

গ্রীষ্মে হবু মায়েরা নিজেদের খেয়াল রাখবেন কীভাবে? রইল তার সন্ধান

শাশ্বত আর মন্দিরা যাই করুক না কেন, অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক পরিকল্পনা করেই তা করে। সেই হিসেবে ওরা পরিচিত অনেক ‘কাপল’-দের চোখেই বেশ আদর্শ দম্পতি। দু’জনেই কর্পোরেট সংস্থার উপরতলার কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠিত। দু’জনেরই বয়স ৩৫ ছুঁই ছুই। এবার তা হলে সন্তানের জন্য এগোন যাক? পরিকল্পনামাফিক সেটাও করে ফেলেছে ওরা। কিন্তু এত পরিকল্পনা করে যারা সব কিছু করে, তাদেরও কখনও কখনও ভুল হয়ে যায়। সেটাই টের পেল শাশ্বত আর মন্দিরা। মন্দিরার প্রেগন্যান্সি (Pregnancy) বা গর্ভধারণের শেষ তিন মাসের মধ্যে যে এমন গরম পড়তে পারে, তা ওরা ভেবেও দেখেনি। তবে কি না, ভেবে না দেখার কোনও কারণ ছিল না। কারণ শিশুরাও জানে, মে মাসে দেশের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই দাবদাহ চলতে থাকে। তাই যারা কি না এত ভেবে সব কিছু করে, তাদের থেকে এটা একেবারেই আশা করা যায় না। (Pregnancy tips for summers in Bengali, Gorome gorbhoboti meyeder bishesh jatno, Goromkale gorbhobotider jatno, Pregnancy tips for summers in Bangla.Pregnancy Tips for Summers in Bengali.)

যাই হোক, আপাতত এই সময়ের অঙ্কের ভুলের জন্য মন্দিরা এবং শাশ্বত পরস্পরের প্রতি গুছিয়ে দোষারোপ করেছে। তবে তাতে কোনও লাভ হচ্ছে না। তাই অবশেষে দ্বারস্থ সেই চিকিৎসকেরই। উনিই বাতলে দিলেন গরমে মন্দিরার মতো যাঁরা, তাঁরা কী করে নিজের এবং হবু সন্তানের খেয়াল রাখবেন। যা এই গ্রীষ্মে যে কোনও অন্তঃসত্ত্বার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

চরম গ্রীষ্মে অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটা সমস্যার কেন? (Why being pregnant in summer is not a good idea)

 

  • ডিহাইড্রেশন (Dehydration): গ্রীষ্মে সবার শরীরেই জলের পরিমাণ কমে যায়। ঘাম বেরিয়ে যাওয়া যার প্রধান কারণ। কিন্তু বাকি সবার ক্ষেত্রে এই সমস্যা যতটা আশঙ্কার, হবু মায়েদের ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ শরীর যে শিশুটি বড় হয়ে উঠছে, তাকে সুস্থ, তরতাজা রাখতে এবং তার বৃদ্ধির হার বজায় রাখতে বহু মায়েদের সব সময় হাইড্রেটেড থাকতে হয়। গরমে শরীর শুকিয়ে গেলে তাই মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।

 

  • হাইপারথারমিয়া (Hyperthermia): শরীরে রক্তের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়াকে হাইপারথারমিয়া বলে। এই হাইপারথারমিয়া নানা কারণেই হতে পারে। জ্বরের কারণেও যেমন হতে পারে, তেমনই হতে পারে পরিবেশের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার কারণেও। এমনকী গ্রীষ্মকালে ট্যাংকের জল যখন খুব গরম হয়ে যায়, সেই জলে স্নান করলেও হাইপারথারমিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হবু মায়ের শরীরের রক্তের উষ্ণতা হঠাৎ করে বেড়ে গেল তাঁর শরীরে বড় হয়ে ওঠা সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তার মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুদণ্ড এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকরা তাই এই সময় মায়েদের শরীরের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্য রাখার পরামর্শ দেন।

 

গ্রীষ্মে হবু মায়েদের যা যা সমস্যা হতে পারে, তার পিছনে রয়েছে প্রধানত এই দু’টি কারণই। কিন্তু আপনি যদি অন্তঃসত্ত্বা হন, এছাড়াও এমন অনেকগুলো প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা রয়েছে, যার মুখোমুখি আপনাকে হতে হবে এই গ্রীষ্মকালে। একনজরে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো। (Unexpected things during summer pregnancy)

 

  • প্রচণ্ড ঘাম হবে (Heavy sweating): গরম কালে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য বহু মায়েদের প্রচণ্ড ঘাম হয়। পরিবেশের উষ্ণতার সামান্য পরিবর্তনেই এই ঘাম হতে থাকে। তার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।

 

  • অস্বস্তিকর পোশাক (Uncomfortable dress): এমনিতেই হবু মায়েদের একটু বড় পোশাক লাগে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থা যত এগোতে থাকে, তত ঢিলেঢালা পোশাকের প্রয়োজন হয়। এখানেই শেষ না। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগে যে পোশাকে ততটাও গরম লাগত না, গর্ভাবস্থায় সেই সব পোশাককেও প্রচণ্ড ভারী বলে মনে হবে। সবচেয়ে পাতলা পোশাকটা পরেও গরম লাগতে পারে তখন।

 

  • অতিরিক্ত ঘুম (Feel sleepy): ডিহাইড্রেশনের ফলে শরীর সারাক্ষণ ক্লান্ত থাকার আশঙ্কাও রয়েছে। সেই কারণে যতক্ষণ দিনের আলো রয়েছে, ততক্ষণ ঘুম-ঘুম ভাব থাকবে, ঝিমুনি লাগবে।

 

  • পায়ের পাতা ভারী (Swollen feet): একেই হবু মায়েদের শরীরে ফ্লুইডের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকে, তার উপর গ্রীষ্মকালে তার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। তাই তার প্রভাব গিয়ে পড়ে পায়ের পাতা এবং গোড়ালি বা অ্যাংকলের কাছে। এই জায়গাগুলো ভারী হয়ে যায়।

 

  • ত্বক সংবেদনশীল (very sensitive skin): হবু মায়েদের ত্বক খুব সংবেনশীল। গরমে তা আরও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। তাই এই সময় সামান্য রোদে গেলেও সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিতে হবে। না-হলে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।

 

  • মদ্যপান থেকে দূরে (avoid alchohol): এই সময় মদ্যপান থেকে একেবারে দূরে থাকতে বাধ্য হন হবু মায়েরা। বাড়িতে ছোটখাটো পার্টি বা বন্ধুবান্ধবের আনাগোনা হল, সেখানে সবাই হয়তো একটু ওয়াইন খেয়ে সেলিব্রেট করলেন, কিন্তু যিনি মা হতে চলেছেন, তিনিই তার আনন্দ নিতে পারলেন না। কারণ এই ধরনের পানীয় শরীরকে ডিহাইড্রেট করে দেয়। শরীরের উত্তাপও অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।

 

সমস্যার ধরনটা তো জানতে পারলেন। কিন্তু এর পাশাপাশি জেনে নেওয়া দরকার, গ্রীষ্মকালে আপনার হবু সন্তান এবং নিজের খেয়াল রাখবেন কীভাবে। রইল তার জন্য কয়েকটা খুব প্রাথমিক টিপস। এর বেশি পরামর্শ দেওয়ার জন্য তো চিকিৎসকরা রইলেন আপনার পাশে।

 

আরও পড়ুনঃগর্ভকালের প্রথম ৩ মাস এড়িয়ে চলুন এই ১০টি খাবার

 

গ্রীষ্মে হবু মায়েদের টিপস (Pregnancy Tips for Summers in Bengali):

 

#1. বাথটবে অনেকক্ষণ (Cool bathtub immersion): বাড়িতে বাথটাব থাকলে কিছুটা সময় বাথটাবে কাটাতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এই সময় ট্যাংকের জলও গরম হয়ে যায়। সেই জল বাথটাবে ভরবেন না। রাতে জল ভরে রাখুন। জল ঠান্ডা হয়ে গেলে সকালে তাতে কিছুটা সময় ডুবে থাকুন। সেই সময় হালকা করে গান চালিয়ে রাখতে পারেন। তাতে মন ভালো হবে।

 

#2. দুপুরে ঘুমান (Take an afternoon nap): দুপুরে ঘুমানোটা এই সময় খুব দরকারি। গরমে এমনিই শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। তার উপর শরীর থেকে জল বেরিয়ে গিয়ে আরও ক্লান্তি ডেকে আনে। এই সময় একটু বেশি বিশ্রাম নিলে শরীর ভালো থাকে। বিশেষ করে দিনের যে সময়টা গরম সবচেয়ে বেশি, সেই দুপুরের দিকটা একটু ঘুমিয়ে নিন। ঘুম থেকে উঠে ফলের রস খান। তারপর ঘরের তাপমাত্রার জলে স্নান করে নিন।

 

#3. বেশি জল খান (Stay hydrated): গর্ভাবস্থায় সব সময় লক্ষ্য রাখতে হয়, যেন শরীর শুকিয়ে না যায়। সেখানে গ্রীষ্মে তো এই খেয়াল আরও বেশি করে রাখতে হবে। চিকিৎসকরা বলেন, দিনের মাথায় অন্তত চার লিটার জল এই সময় পান করতেই হবে। প্রয়োজনে সেটা আরও বাড়াতেও হতে পারে। জলের মাধ্যমেই আপনার শরীরের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা খুকি বা খোকার শরীরের পুষ্টি যায়। তাই শরীরে জল কমে যাওয়াটা খুব খারাপ।

 

#4. পা উঁচুতে রাখুন (Keep feet elevated): গ্রীষ্মে শরীরে ফ্লুইডের পরিমাণ বেড়ে যায় বলে, পায়ের পাতা এবং গোড়ালির কাছটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে যায়, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। তাই এই সময় সোফায় বা বিছানায় শুয়ে পা দুটো একটু উপরের দিকে তুলে রাখতে পারেন। আরও ভালো হয়, যদি এই সময় পায়ের পাতার উপর ভিজে বা ঠান্ডা তোয়ালে চাপিয়ে রাখেন।

 

#5. কুল র‍্যাপ ব্যবহার করুন (Use cool wrap): হবু মায়েদের জন্য এক ধরনের র‍্যাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে থাকা বিশেষ ধরনের জেল শরীরকে ঠান্ডা রাখে। তবে এই র‍্যাপ ব্যবহার করার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়াই ভালো।

 

#6. মাসাজ করান (Get a massage): প্রি-ন্যাটাল মাসাজ হবু মায়াদের জন্য খুব ভালো। তবে একেবারেই পেশাদার এবং অভিজ্ঞ কারও থেকে এইধরনের মাসাজ নেওয়া উচিত। এই মাসাজ শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়। তাতে ক্লান্তি দূর হয়।

 

#7. এয়ার কন্ডিশনারের কাছে (Stay near to air conditioner): বাড়িতে এসি থাকলে চরম গ্রীষ্মের সময়টায় তার কাছাকাছি থাকুন। তবে হঠাৎ করে গরমে গেলেন, হঠাৎ করে ঠান্ডায় চলে এলেন— এমন করবেন না। তাতে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আস্তে আস্তে এসি-তে ঠান্ডার মাপটা বাড়ান। এবং যতটা বেশি সময় পারুন, সেই ঠান্ডায় থাকুন।

 

#8. সাঁতার কাটুন (Take swim exercise): সাঁতার হবু মায়েদের জন্য খুব ভালো। কিন্তু এই ধরনের এক্সারসাইজের আগে বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকারি।

 

গরমটা সত্যিই হবু মায়েদের জন্য খুব কষ্টের। এমনকী লাগাম ছাড়া গরমে ক্ষতি হতে পারে আপনার খোকা বা খুকিরও। তা সে যতই আপনার শরীরের মধ্যে থাকুক না কেন। কিন্তু যে ক’টা সহজ পদ্ধতি বলা হল, সেগুলো মাথায় রাখলে, আপনি এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন সহজেই। আর অভিজ্ঞ ডাক্তার-রা তো রইলেনই আপনার পাশে।

 

আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় সহবাসের বিষয়ে যা কেউ আপনাকে বলেনি!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null