সবে মা হয়েছেন? এখন কী কী সমস্যায় পড়তে পারেন আপনি, রইল তারই সমাধান-সমেত হদিস

সবে মা হয়েছেন? এখন কী কী সমস্যায় পড়তে পারেন আপনি, রইল তারই সমাধান-সমেত হদিস

দু’দিন হল, ৮ দিনের কুট্টুস আর স্ত্রী সৃজাকে নার্সিংহোম থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছে দীপ। সারা বাড়িতে যেন উৎসব শুরু হয়েছে ওরা আসার পর থেকেই। সকালে যদি মামা-পিসি-মাসির দল কুট্টুসকে দেখতে আসছে, তো বিকেলে আসছে সৃজার শ্বশুরমশাইয়ের পাড়াতুতো বন্ধু-বান্ধব। চারদিকে শুধু “কই নাতিসাহেব কই?” বা “আমার ভাগ্নে/ভাইপো/ভাই কী করছে, কেমন আছে?” সদ্য ছেলের বাবা হওয়ার আনন্দে দীপ সারাদিন মিষ্টির দোকানে যাচ্ছে আর আসছে। খুশি যেন উপচে পড়ছে সেন বাড়ির সব জানলা-দরজা দিয়ে।(Postpartum Problems and Solutions.)

এতসব হইচই-এর মাঝে সৃজার খবর খুব একটা নেওয়া হয়নি কারও। (After Pregnancy Common Problems and Solutions) ওই “কেমন আছো?” এইটুকু জিজ্ঞাসা করেই সবাই মেতে উঠেছিলো বাড়ির নবীন অতিথিকে নিয়ে। আর সৃজার নর্মাল ডেলিভারি হওয়ার কারণে, সবাই যেন একটু বেশিই চিন্তামুক্ত ছিল সৃজার ব্যাপারে। আজ প্রায় ১০ দিন পরে, ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন সৃজার শাশুড়ি-মা। সৃজা যেন কেমন মিইয়ে আছে। ছটফটে মেয়েটা আর জোরে জোরে কথা বলে না, প্রাণ খুলে হাসে না, চলা-ফেরায় কেমন যেন আড়ষ্টতা। ছেলের যত্নে কোনও ত্রুটি না রাখলেও কীসের যেন চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে মেয়েটাকে।

কন্যাসমা পুত্রবধূকে অনেক বুঝিয়ে, ভালোবেসে কারণটা বার করলেন দীপের মা। ডেলিভারির পর থেকে সৃজা নিজের ইউরিন কন্ট্রোল করতে পারছে না। একটু জোরে হেসে ফেললেও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে তাকে। জোরে হাঁটার তো প্রশ্নই নেই। এমনিতেই ডেলিভারির পর থেকে নাগাড়ে চলছে পিরিয়ডস, তার ওপর ইউরিন কন্ট্রোল করতে না পারার কারণে চরম বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় পড়ছে সৃজা। বাচ্চার জন্ম দেওয়ার ধকল শরীর এখনও কাটিয়ে ওঠেনি, তার ওপরে এই সমস্যা জেরবার করে দিচ্ছে সৃজাকে।

লজ্জাজনক পরিস্থিতি আটকাতে মেয়েটা সারাদিন দুটো করে ন্যাপকিন, প্যানটি লাইনারস সব একসাথে পরে বসে আছে। (Post Pregnancy Issues) বলতে বলতে হাউ-হাউ করে কেঁদেই ফেললো সৃজা। গুরুত্ব বুঝে দীপের মা পরদিনই সৃজাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন।

মা হওয়া সত্যি মুখের কথা নয়। শুধু গর্ভধারণ এবং শিশুর জন্মের সময় কষ্ট পাওয়া নয়, শিশুর জন্মের পরেও মায়েদের শরীরে অনেক সমস্যা আসে। তাতে বাচ্চা নর্মাল ডেলিভারিতেই হোক বা সিজারিয়ান। বেশিরভাগ মাকেই কিছু কিছু অস্বস্তিকর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সৃজার ডাক্তারও বললেন তেমনটাই। বহুদিনের পরিচিতা স্নেহের পাত্রী সৃজাকে তিনি খুঁটিয়ে বললেন সবকিছু।

বাচ্চার জন্মের পর, নানা রকম সমস্যা হতে পারে মেয়েদের। (After Pregnancy Issues) এই সমস্যা কিন্তু অস্বাভাবিক নয় এবং কম-বেশি সব মায়েরই হয়ে থাকে। তাই মন খারাপ না করে কয়েকটা দিন সহ্য করতে হবে বা অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ডাক্তার দেখাতে হবে। প্রেগন্যান্সির পরে মেয়েদের কী কী সমস্যা হতে পারে আর তার সমাধানই বা কী? (Prosob Poroborti Samasya o Samadhan) দেখে নিন একনজরে।

 

 

প্রেগন্যান্সির পরে কী কী সমস্যা হতে পারে এবং তার সমাধান (After Pregnancy Common Issues and Solutions)

 

#1. মূত্রত্যাগের বেগ কন্ট্রোল করতে না পারা: সৃজা যে অস্বস্তিতে ভুগছে, তাই দিয়েই শুরু করলাম। মূত্রত্যাগের বেগ কন্ট্রোলের সময় যে পেশীগুলির ব্যবহার সবথেকে বেশি হয়, তাদের একটা অংশই প্রসবের সময় বাচ্চাকে জরায়ুপথ দিয়ে যোনি মুখের দিকে ঠেলতে সাহায্য করে। বাচ্চার জন্মের পরে বেশ কিছুদিন এই পেলভিক মাসলগুলি সংবেদনশীল হয়ে থাকে এবং শরীর মূত্রের বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।(Postpartum Problems) তাই জোরে হাসলে বা জোরে জোরে হাঁটলে সামান্য হলেও ইউরিন বেরিয়ে আসতে পারে।

 

সমাধান: পেলভিক পেশীগুলিকে আগের মতো শক্তসমর্থ করে তুলতে বা ব্লাডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। পেলভিক মাসলের ওপর নিয়ন্ত্রণ জলদি ফিরে পেতে কিগেল এক্সারসাইজ করতে পারেন। বাইরে গেলে ব্যবহার করুন ভালো মানের প্যানটি লাইনার।

 

 

#2. বেশি মাত্রায় যোনিস্রাব: বাচ্চার জন্মের পরে ১-২ সপ্তাহ পর্যন্ত এক ধরনের ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ হয়, যার পোশাকি নাম লোচিয়া (Lochia)। জরায়ুর ছেঁড়া টিস্যু এবং রক্তই যোনিপথের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে আসে। আমরা একে সাধারণভাবে প্রসব পরবর্তী পিরিয়ডসই বলে থাকি।

 

সমাধান: অস্বস্তিকর হলেও এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং শরীরের সেরে ওঠার নিজস্ব পদ্ধতি। খুব বেশি পরিশ্রমের কাজ করবেন না এসময়। যতটা পারেন বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করুন।

 

 

 

#3. কিডনি ইনফেকশন: ইউরিনারি ব্লাডার থেকে যদি প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া সারভিক্সে ঢুকে যায়, সেক্ষেত্রে এই ইনফেকশনের শিকার  হতে পারেন নতুন মা। বারবার প্রস্রাবের বেগ আসা, ইউরিন করার সময় জ্বালা হওয়া ও অস্বস্তি, জ্বর, কোমরে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি এই ইনফেকশনের লক্ষণ।

 

সমাধান: প্রচুর পরিমাণে জল ও তরল জাতীয় খাবার খান। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করান ও ওষুধ নিন। চেপে রেখে জটিলতা বাড়াবেন না।

 

 

 

#4. সিজার হওয়ার কারণে ব্যথা: তলপেট সংলগ্ন জরায়ুর দেওয়াল কেটে বাচ্চাকে বার করে আনা হয় বলে, সি সেকশন ডেলিভারি -র পরে মায়ের ব্যথা হবেই।ওঠা-বসা করলে বা ওই স্থানের আশেপাশে হাত দিলেও মায়ের ব্যথা লাগবে।

 

সমাধান: পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা অবশ্য প্রয়োজন। এই ব্যথার সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য বা হজমের সমস্যা যোগ হলে কষ্ট আরও বাড়বে। তাই চেষ্টা করুন হাল্কা খাবার খাওয়ার ও প্রচুর পরিমাণে জল খান।

 

 

#5.স্পর্শকাতর ও ভারী ব্রেস্ট: এসময় ব্রেস্ট-এ দুধের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। ব্রেস্ট বড় ও ভারী হয়ে যায়। স্পর্শকাতরও হয়ে পড়ে। বাচ্চাকে কিছুক্ষণ পরপর খাওয়ানোর ফলে নিপল অনেকসময় ছড়ে যায় বা লাল হয়ে ফুলে যায়। হতে পারে ম্যাসটাইটিসের মতো ইনফেকশনের সমস্যাও। নিপলের মুখে দুধ জমে গিয়ে ব্যথাও হতে পারে।

 

সমাধান: দুধের পরিমাণ বেশি লাগলে পাম্প বা হাতের সাহায্যে প্রেস করে ফেলে দিন। বুকের চারপাশে সেঁক এসময় আরামদায়ক হয়। এছাড়াও ম্যাসাজ করতে পারেন। নিপলের চারপাশে লাল হয়ে গেলে বা র‍্যাশ হয়ে গেলে সেখানে একটু বুকের দুধ লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে আবার লাগান। এরকম বার কয়েক করুন। কয়েকদিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।

 

আরও পড়ুনঃ মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে অফিস; কীভাবে তৈরি করবেন নিজেকে?

 

#6.পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন: শুধু শরীরেই নয়, মনেও হতে পারে অসুখ। হরমোনের লাগামছাড়া অত্যাচার,নতুন আসা দায়িত্ব এবং শারীরিক পরিবর্তনের ঝড় সামলে উঠতে পারেন না অনেক মা-ই। ফলস্বরূপ, ডিপ্রেশন গ্রাস করে তাকে ।যাকে আনতে এতো কষ্ট, সেই বাচ্চাকেও যেন বিরক্ত লাগতে শুরু করে।

 

সমাধান: মেডিটেশন করুন, ব্যায়াম করুন, নিজের মনের কথা খুলে বলতে শিখুন। আর কোনও অবস্থায় বা কারও জন্য নিজেকে দোষী ঠাউরাবেন না। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিন।

 

 

#7.জরায়ু ইনফেকশন: নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে  বাচ্চার জন্মের আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্লাসেন্টা বেরিয়ে আসে। যদি কোনও কারণবশত প্লাসেন্টার একটুও অংশ জরায়ুতে থেকে যায়,তার থেকে জরায়ুর টিস্যুগুলিতে সংক্রমণ হওয়ার আশংকা থাকে। অনেক সময়, ডেলিভারির সময়েও এই জাতীয় ইনফেকশন ছড়াতে পারে। খুব জ্বর,স্পর্শকাতর তলপেট, দুর্গন্ধময় যোনিস্রাব, অস্থিরভাব ইত্যাদি এর উপসর্গ।

 

সমাধান: সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিন ও চিকিৎসা করান।

 

 

#8.যৌনমিলনে অস্বস্তি: ভ্যাজাইনাল ও সারভিকাল টিস্যুগুলি সম্পূর্ণ সেরে না ওঠা পর্যন্ত যৌনমিলনের সময় ব্যথা বা হাল্কা রক্তপাত হতে পারে। হরমোনের মাত্রার ওঠাপড়ার জন্য অনেকসময়ই মানসিক দিক থেকেও যৌনমিলনে অনিচ্ছা দেখা যায়।

 

সমাধান: নিজেকে ও নিজের শরীরকে একটু সময় দিন।সময়ের সাথে সাথে এই অস্বস্তি একেবারেই সেরে যাবে।

 

প্রেগন্যান্সির পরে কী কী সমস্যা হতে পারে এবং তার সমাধান (Postpartum Common Issues and Solutions)

 

বিশেষ কিছু কথা:

  • এইসব সমস্যা ছাড়াও আসতে পারে স্ট্রেচ মার্ক্স ও চুল ওঠার সমস্যা। ত্বকের প্রাণবন্ত ভাবও যেন হারিয়ে যায়। অস্থির না হয়ে নিজেকে সেরে উঠতে সময় দিন। ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ফেরাতে সাহায্য করবে সঠিক ডায়েট ও কিছু ঘরোয়া টোটকাই।

 

  • সবার শরীর সমান নয়। তাই সবার যে এই সমস্যাগুলিই হবে, এমন কোনও কথা নেই। এখানে সাধারণ সমস্যার কথা বলা হয়েছে।

 

  • ডেলিভারির পরে (Delivery Por Somosya) বাচ্চাকে নিয়ে থাকলেও নিজেকে একদম ভুলে যাবেন না। মন ভালো রাখুন, যতটা পারেন বিশ্রাম নিন ও প্রচুর পরিমাণে জল খান।

 

  • নিয়মিত ডাক্তারের চেক আপে থাকুন ও ওনার পরামর্শ মেনে চলুন।

 

  • শরীরে বা মনে কোনও অসুবিধা বুঝলে তা চেপে না রেখে ডাক্তার দেখান। লুকিয়ে রাখলে রোগ বাড়বে বই কমবে না।

 

  • সতর্ক থাকুন, আনন্দে থাকুন।

 

আরও পড়ুনঃ প্রসবের পরে কীভাবে জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null