কোল আলো করে ফুটফুটে এক মিষ্টি সন্তান এসেছে সদ্য সদ্য। ওই নিষ্পাপ, কুট্টুস মুখখানি দেখে, প্রসবের দীর্ঘ ধকল আর যন্ত্রণার কথা আর যেন মনেই আসছে না আপনার। বাড়ির সক্কলে ব্যস্ত নতুন অতিথিকে কীভাবে আপ্যায়ন করবে তাই ভেবেই। চারদিকে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ, আর আপনার মনে বসেছে ‘সব পেয়েছির আসর’। বাচ্চাকে কখন খাওয়াবো, কখন কোলে দোলাবো বা কখন স্নান করাবো, এইসব ভেবে আপনি এতই ব্যস্ত যে হয়তো ব্রেকফাস্টটা ভুলে গেলেন বা লাঞ্চ করতে বসলেন বিকেলবেলা। গোগ্রাসে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই আবার ছুটলেন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে। খুব ভুল করছেন কিন্তু! (Post-Pregnancy Diet: 12 Foods for New Moms in Bangla. Prosob poroborti diet chart. Post Pregnancy Diet chart in Bengali)
প্রসবের পরবর্তী কয়েকটা মাস নিজের শরীরের সঠিক যত্ন নেওয়া আর ঠিকমতো খাবার খাওয়া কিন্তু খুব প্রয়োজন। না হলে,খুব জলদি বিপদে পড়বেন আপনি আর আপনার সাথে ওই একরত্তি বাচ্চাটিও। নিজেকে অবহেলা হয়তো করছেন করুন, ভুলে যাবেন না আপনার বাচ্চাটিও আপনার শরীর থেকেই পুষ্টি পেয়ে বেড়ে উঠছে। নিজের শরীর সুস্থ করার জন্য তো বটেই, অন্তত বাচ্চার কথা ভেবেও মনোযোগ দিন কী খাচ্ছেন না খাচ্ছেন তার ওপরে। আপনার কাজ কিছুটা সহজ করে দিতেই হাজির আমরা। প্রসবের পরে কী কী খাবার খেতেই হবে নতুন মাকে, তারই হদিস দিচ্ছি আজ। যদি নিজে নতুন মা হোন, তা হলে অবশ্যই এগুলো মেনে চলুন বা যদি নিজের আত্মীয়া/বান্ধবী, কেউ সদ্য মা হয়েছেন, তাদেরও বিষয়টি জানান। দেখে নিন একনজরে।
প্রসবের পরে শারীরিক যা যা ক্ষতি হয়, সেগুলো পূরণের জন্য এবং সদ্যজাতর সার্বিক পুষ্টির জন্যও নতুন মায়ের সঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করা বিশেষ প্রয়োজন।
#1. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার (Protein)-> প্রোটিন জাতীয় বা আমিষ খাবার একজন নতুন মাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আবার যেহেতু শিশু মায়ের দুধ থেকেই তার পুষ্টি পায়, তাই শিশুর পুষ্টিতেও অন্যতম ভূমিকা নেয় এই প্রোটিন জাতীয় খাবার। একটি গোটা ডিমে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস। হজমে সমস্যা না হলে নতুন মা প্রত্যেকদিন ১টি করে সেদ্ধ ডিম খাবেন। এছাড়া মুগ, মুসুরি ইত্যাদি সব ধরনের ডাল, প্রাণীজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে মুরগীর মাংস, শিমের বীজ এগুলি অবশ্যই খাওয়া উচিত। প্রাণীজ প্রোটিন হিসেবে খেতে পারেন লিভার এবং কচি পাঁঠাও। তবে কচি পাঁঠা মাঝেসাঝে খান এবং সেটা তেল-ঘী দিয়ে গুরুপাক বানিয়ে একবারেই খাবেন না। নতুন মায়ের শরীরের জন্য জিওল মাছ খুব উপকারী। মাগুর,কই, শিঙি, গুলে ইত্যাদি জিওল মাছে চর্বি থাকে না এবং খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়। চারা পোনা, বাটা মাছ বা মাঝারি মাপের রুই মাছ, যে কোনও একরকম মাছ অবশ্যই রাখুন রোজের খাবারে। ছোট সামুদ্রিক মাছ, মাগুর মাছ বা মাছের তেলে আছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। স্বাদ বদলাতে দু-একদিন খেতে পারেন ভেটকি মাছ বা ৩/৪ টি গলদা চিংড়িও। চিংড়ি খেতে ইচ্ছে হলে ভালো করে রান্না করে তবেই খান। কয়েকটা মাস ইলিশ, আড়, চিতল, পাবদা বা বোয়ালের মতো মাছ থেকে দূরে থাকুন। এই মাছগুলিতে তেলের পরিমাণ ভালোই বেশি আর হজম হতেও অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নেয়।
#2. শর্করা জাতীয় খাবার (Carbohydrates)-> শর্করা জাতীয় খাবার নতুন মায়ের এনার্জি বাড়াতে এবং শারীরিক বল ফিরে পেতে বিশেষ সাহায্য করে। হাতি-ঘোড়া কিছু নয়, সাধারণ ভাত- রুটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলেই দেহে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে। আগে যা ভাত খেতেন, তার থেকে এক কাপ ভাত বেশি খান। চাল, আটা,ময়দা, চিনি, আলু ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা থাকে।
#3. তাজা ফলমূল ও বাদাম (Fruits and nuts)-> দিনের যে কোনও একটা সময় বরাদ্দ রাখুন ফল খাওয়ার জন্য। টাটকা মরসুমি ফল, সাইট্রাস ফলগুলি নতুন মায়ের পুষ্টির সাথে সাথে ব্রেস্ট মিল্ক-এর পরিমাণও বাড়ায়। বাতাবিলেবু, মিষ্টি মুসাম্বি ও কমলালেবু, আম, জাম, কলা দিয়ে বানিয়ে ফেলুন ফ্রুট স্যালাড। নিয়মিত খেতে পারেন নাসপাতি, পেয়ারা ও আপেল; এই ফলগুলি নতুন মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় বিশেষ কাজ দেয়। পেস্তা, আখরোট ও কাঠবাদাম খান রোজ এক মুঠো করে। কাঠবাদামে আছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যা শিশুর মস্তিস্ক গঠনে বিশেষ প্রয়োজন আবার মায়ের সুস্বাস্থ্যেও বিশেষ দরকার।
#4. সবুজ শাক-সব্জি (Green vegetables)-> সবুজ শাক-সবজি আয়রনের অন্যতম উৎস হওয়ায় রোজের খাবারে এদের রাখা মাস্ট। এছাড়াও, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন A ও C এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভরপুর মাত্রায় থাকে এতে। ক্যালোরি মাত্রা কম হওয়ায় ওজন বাড়ার হাত থেকেও রক্ষা করে নতুন মাকে। নানা ধরনের শাক এবং সমস্ত সবুজ সবজি খাবেন অবশ্যই। মাটির নীচে যে সব সবজি হয়, যেমন গাজর, আলু, বিট বা মূলা এগুলিও উপকারী কিন্তু খেতে হবে একটু বুঝে শুনে। ডেলিভারির সময় যদি ডায়াবেটিসের খপ্পরে পড়েন এবং সেটা এখনও না সারে, তা হলে এই মাটির নীচের সবজি খাওয়া চলবে না। লাউ খাওয়া এসময় বিশেষ ভালো কারণ এতে ব্রেস্ট মিল্ক-এর পরিমাণ বাড়ে। ডেলিভারির সময় বেশ রক্তপাত হয়, তার ক্ষতিপূরণ করতে ডায়েটে রাখুন কচু শাক ও পালং শাক; এতে থাকা ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন এ শরীরে নতুন রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। এসব সবজি ও শাকে আঁশ বেশি থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আসে না।
#5. দানা শস্য (Whole grains)-> সব রকমের দানা শস্য যেমন জোয়ার, বাজরা বা রাগি রাখুন নিজের খাদ্যতালিকায়। রান্নার রেসিপি যাই হোক না কেনো, শরীরে এনার্জি বাড়াতে এদের জুড়ি মেলা ভার।
#6. দুধ ও ডেয়ারি প্রোডাক্ট (Dairy)-> একদম ছোট্ট বাচ্চা যেহেতু ব্রেস্ট মিল্ক-এর ওপরই নির্ভরশীল, তাই মায়েদেরও উচিত পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ব্যবহার করা। ডেয়ারি প্রোডাক্টগুলি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন B-তে ভরপুর থাকে বলে বাচ্চার সুস্বাস্থ্যেও এরা বিশেষ ভূমিকা নেয়। মায়ের শরীরের ক্যালসিয়াম ব্রেস্ট মিল্ক-এর মাধ্যমে শিশুর শরীরে শোষিত হয় ও তার হাড় গঠনে সাহায্য করে। নিয়মিত এক-দুই গ্লাস করে দুধ খান। দুধ খেতে ভালো না লাগলে বেছে নিন দই, পনীর বা ছানা। ওজন বাড়াতে না চাইলে আপনি লো ফ্যাট মিল্ক কিনতেই পারেন কিন্তু।
#7. ওমেগা ৩ যুক্ত খাবার (Eat Omega 3)-> মায়ের শরীরের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে এবং শিশুর মস্তিস্ক বিকাশে ওমেগা ৩ ফ্যাট জাতীয় খাবারের কোনও বিকল্প নেই। এছাড়া শিশুর দাঁত ও হাড় গঠনেও এর ভূমিকা রয়েছে। কাঠবাদাম, ছোট সামুদ্রিক মাছ, মাগুর মাছ, মাছের তেল থেকে প্রচুর পরিমাণে উপকারী এই ফ্যাট পাওয়া যায় যা প্রেগন্য়ান্সির ধকল কাটিয়ে উঠতে নতুন মাকে সাহায্য করে। কাঠবাদাম তো নতুন মায়েদের নিয়ম করে খাওয়া উচিত। কারণ কাঠবাদামে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ছাড়াও ভিটামিন ই ও প্রয়োজনীয় এসেন্সিয়াল অয়েল আছে।
#8. মেথি ও তিল (Fenugreek and sesame seeds)-> মেথি দানা ব্রেস্ট মিল্ক বাড়াতে সাহায্য করে। অন্য তরি-তরকারিতে মিশিয়েও এই মেথি দানা খেতে পারেন আবার স্প্রাউট বানিয়ে অল্প রসুন- পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে বিকেলে টিফিনের মতো খেতে পারেন। তিলের মধ্যে আছে তামা, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। মায়ের শারীরিক শক্তি ও এনার্জি বাড়াতে বিশেষ সাহায্য করে এই তিল।পাচনক্রিয়াও নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে।বানিয়ে রাখুন তিলের নাড়ু। মিষ্টিমুখও হল আবার পুষ্টিও গেলো।
#9. শুকনো আদার গুঁড়ো ও জোয়ান (Dry ginger powder and ajwain)-> শুকনো আদার গুঁড়ো নতুন মায়ের জন্য খুবই ভালো। ভিটামিন B6, ভিটামিন E, ফাইবার,ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের উৎস এই আদার গুঁড়ো শরীরে ইনফ্লামেশন কমাতে সাহায্য করে। চাটনি বা লাড্ডু করে খাওয়া যায় এই শুকনো আদার গুঁড়ো। জোয়ান যে শুধু গ্যাসের ব্যথা এবং হজমের সমস্যা দূর করে তাই নয়, জোয়ান ব্রেস্ট মিল্ক-এর পরিমাণ বাড়াতে ও প্রসবের পরে জরায়ুকে স্থিতিশীল হতে সাহায্য করে। এছাড়া জোয়ান খুব ভালো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবেও কাজ করে। জোয়ান ভিজিয়ে জল খান, মুখশুদ্ধি খান বা পরোটায় ছড়িয়ে দিন, স্বাদ ও পুষ্টি দুই পাবেন।
#10. রসুন ও জিরা (Garlic and cumin)-> রসুন নরম শরীরকে ভিতর থেকে সুস্থ করতে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। জিরা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়াও রক্তচলাচল নিয়মিত রাখে ও হজমশক্তি বাড়ায়। নতুন মায়ের ডায়েটে এইগুলি থাকলে শরীরের সার্বিক উন্নতিতে সাহায্য হয়। (Post-Pregnancy Diet: 12 Foods for New Moms in Bangla.)
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null