প্যাসিফায়ার হলো মায়েদের স্তনবৃন্তের আকারে তৈরি এমন একটি জিনিস যা শিশুদের আরাম দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মূলত এটি একটি কৃত্রিম স্তনবৃন্ত যাতে শিশুর সুবিধায় রিং-এর মতো হাতল লাগানো থাকে। অনেকে একে চুষিকাঠিও বলে থাকেন। এই প্যাসিফায়ার এমন আকারের হয় যাতে শিশু কখনই পুরোটা মুখে ঢুকিয়ে নিতে না পারে। এইগুলো সুদারস (soothers) নামেও পরিচিত। আমাদের, বাবা-মাদের মধ্যে সবসময় একটা উদ্বেগ কাজ করে, যে বাচ্চাদের জন্য প্যাসিফায়ার ব্যবহার করা উচিত, না উচিত নয়। নতুন বাবা-মা হিসেবে, আপনি প্রায়শই আপনার বাচ্চার যত্ন এবং আরাম নিয়ে চিন্তিত থাকেন এবং প্যাসিফায়ার আপনার কাছে খুবই কার্যকরী বলে মনে হতে পারে।
যেখানে কিছু বাচ্চা আদর করলে, দোল খাওয়ানো হলে বা স্তন্যপানের সময় বেশ আরাম পায়, অনেক বাচ্চা সেই আরাম নিতে পারে না। যদি আপনার সদ্যজাত বাচ্চা খাওয়ানোর পরে ঢেকুর তোলে, দোল খাওয়ানো বা আদর করার পরও ছটফট করতে থাকে, প্যাসিফায়ার এক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। এটা ব্যবহার করা খুবই সহজ এবং বাচ্চা সহজেই শান্ত হয়ে যায়; কিন্তু এটা শুধু যদি আপনি একদিক দিয়ে বিচার করেন, তা হলেই।
প্যাসিফায়ার ব্যবহার করানোর কোনও নির্দিষ্ট বয়স বাচ্চার ক্ষেত্রে থাকে না। আপনি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন না খাওয়াবেন না, তার ওপরও এটা নির্ভর করে। যদি আপনি বাচ্চাকে বোতলে করে দুধ খাওয়াতে চান, আপনি প্যাসিফায়ার ব্যবহার করানো শুরু করতে পারেন কারণ, কিছু বাচ্চার প্রবণতা থাকে স্তন্যপানের সময় বুকের দুধ না টেনে শুধুই স্তনবৃন্ত টেনে যাওয়া। বাচ্চা বোতলেও যদি এরকম করতে থাকে, তা হলে তাতে গ্যাস হতে পারে। কিছু শিশু বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অনুযায়ী, বাচ্চা একটি নির্দিষ্ট ওজনের না হওয়া পর্যন্ত প্যাসিফায়ার ব্যবহার করা উচিত নয়। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলে, তার ছয় সপ্তাহ বয়সের পরেই তাকে প্যাসিফায়ার দিন যাতে আসল আর নকল স্তনবৃন্তে শিশু তফাৎ না করতে পারে।
যখনই বাচ্চাকে প্যাসিফায়ার দেওয়ার মনস্থির করবেন, এই কথাগুলো মাথায় রাখবেনঃ
প্যাসিফায়ার বদলানোর জন্য এই বিষয়গুলোয় লক্ষ্য রাখুন:
বাচ্চার প্যাসিফায়ার পরিষ্কার করার সবথেকে ভালো উপায় একে গরম জলে ধুয়ে নেওয়া, যেমন আপনি ফিডিং বোতল এবং নিপলে করে থাকেন। বিশেষভাবে পরিষ্কার করার কোনও নির্দেশ আছে কি না জানতে, প্যাসিফায়ারের প্যাকেট দেখে নিন।
যদি আপনি ভেবে থাকেন প্যাসিফায়ার কেনার মধ্যে একেবারেই ঝামেলা নেই, তা হলে আপনি ভুল করছেন। বাচ্চার জন্য প্যাসিফায়ার কেনার সময় অবশ্যই এগুলো মনে রাখুনঃ
0-৬ মাস- ছোট (Small)
৬-১৮ মাস- মাঝারি (Medium)
18 মাস ও তার বেশি- বড় (Large)
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইজ বিভিন্ন হয়, সেই অনুযায়ী দেখে কিনুন।
যদিও একমুখ প্যাসিফায়ার সবচেয়ে নিরাপদ, অনেকক্ষেত্রে অনেক মুখওয়ালা প্যাসিফায়ারও ভালো হয়। শুধু ভালো করে দেখে নিন, যাতে সব মুখ শক্তভাবে লাগানো থাকে এবং মুখে আটকানোর ভয় না থাকে।
প্যাসিফায়ারের নিপল বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে:
বাচ্চার আঙুল চোষার অভ্যেস ছাড়ানোর থেকে প্যাসিফায়ারের অভ্যেস ছাড়ানো সহজ।
কিছু পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব বাচ্চারা ঘুমনোর সময় প্যাসিফায়ার ব্যবহার করে, তাদের সিডস (sudden infant death syndrome) বা হঠাৎ মৃত্যুর সম্ভাবনা কম হয়। মনে করা হয়, প্যাসিফায়ার মুখে থাকার ফলে বাচ্চার মুখ ও নাকের মাঝখানে জায়গায় বাতাস চলাচল করে এবং অক্সিজেনের ঘাটতি হয় না কোনও ভাবেই। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (American Academy of Pediatrics) (AAP) এর মতানুসারে, ঘুমনোর সময় এক বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের প্যাসিফায়ার দেওয়া উচিত।
ভ্যাক্সিন বা টিকা নেওয়ার পরে প্যাসিফায়ার চুষলে বাচ্চার ব্যথা কম হয়।
প্রিম্যাচিওর বাচ্চারা হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তাদের প্যাসিফায়ার ব্যবহার করালে তারা পরবর্তীকালে সহজেই স্তন্যপানে অভ্যস্ত হতে পারে।
বাচ্চাদের সহজাত প্রবণতা থাকে কোনও কিছু চুষতে থাকার; তা সে বোতলই হোক বা মায়ের দুধ। মা দুধ খাইয়ে দেওয়ার পরেও কিছু বাচ্চার মুখে চোষার মতো কিছু থাকলে, তারা নিরাপদ বোধ করে এবং মা কাছে ভেবে আরাম পায়। এক্ষেত্রে প্যাসিফায়ার খুবই কাজে লাগে। উপরন্তু আঙুল খাওয়ার বাজে অভ্যেসও বাচ্চার হয় না।
একদম ছোট্ট বাচ্চাকে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে, বাচ্চা যদি খুব ছটফট করে, সেক্ষেত্রে প্যাসিফায়ার মুখে দিলে বাচ্চা ওইদিকেই মন দেয় এবং ছটফটানি কম করে। পোলিও ইঞ্জেকশান বা রক্তপরীক্ষা করানোর সময় বাচ্চাকে অন্যমনস্ক রাখতে সাহায্য করে এই প্যাসিফায়ার।
প্যাসিফায়ার মুখে থাকলে, প্লেনে যাতায়াতের সময় বাতাসের চাপের তারতম্যের জন্য কানে ব্যথা ও অস্বস্তি থেকে শিশু আরাম পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য় সংস্থা (World Health Organization) প্যাসিফায়ার ব্যবহারের বিরুদ্ধে। ইউনাইটেড নেশন্স চিলড্রেনস ফান্ড (United Nations Children’s Fund)/ ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (World Health Organization)-এর নবম পর্যায়ে “বাচ্চাদের উপযোগী হাসপাতাল উদ্যোগঃ সফলভাবে স্তন্যপান করানোর দশটি পদ্ধতি” অনুযায়ী, “ স্তন্যপান করা কোনও বাচ্চাকে কোনও কৃত্রিম প্যাসিফায়ার বা সুদার দেবেন না।” অনেক শিশু বিশেষজ্ঞই এর সাথে একমত। তার কিছু কারণ হল;
প্যাসিফায়ার চোষা আর স্তন্যপান করার মধ্যে পার্থক্য থাকে। আর অনেকসময় কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাচ্চা স্তন্যপান করতে চায় না। এই কারণে, বাচ্চা একটা নির্দিষ্ট ওজনে পৌঁছলে তবেই তাকে প্যাসিফায়ার অভ্যেস করানো উচিত।
দীর্ঘদিন ধরে প্যাসিফায়ার ব্যবহার করলে (দু’বছরের পরেও) বাচ্চার দাঁতের গঠন ও সুন্দর সারি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।দীর্ঘদিন প্যাসিফায়ার ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি দাঁতের সমস্যাও হতে পারে। ডাক্তাররা এও বলে থাকেন যে, ছয় মাসের পরে প্যাসিফায়ার না দিলে বাচ্চার দাঁতের সমস্যা হয় না।
কিছু পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্যাসিফায়ার বেশি ব্যবহার করলে বাচ্চাদের কানে সংক্রমণের প্রবণতা বেড়ে যায়।
প্যাসিফায়ারের অত্যধিক ব্যবহারে বাচ্চার কথা বলা শিখতে বা সঠিক উচ্চারণে অনেকসময় অসুবিধা হয়।
প্যাসিফায়ার মুখ থেকে পড়ে গেলে বাচ্চা ঘুমের মধ্যে বারবার কেঁদে ওঠে।
বাচ্চা প্যাসিফায়ারের দিকেই মনোযোগ দিয়ে থাকলে, অন্য খেলনা নিয়ে খেলা বা অন্য কিছু শেখার আকর্ষণ কমে যায়।
বাচ্চার কান্না যেহেতু তার সাথে তার মা-বাবার যোগাযোগের একটা মাধ্যম, তাই বাচ্চা কাঁদলেই প্যাসিফায়ার দিয়ে দিলে বাচ্চা অমিশুকে হয়ে যেতে পারে এবং একলা থাকতে পছন্দ করে।
প্যাসিফায়ার নোংরা থাকলে বা ঠিকমতো পরিষ্কার না করা হলে, বাচ্চার শরীরের ক্ষতি হয় এবং ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
এইসমস্ত কিছু পড়ার পরে, যদি আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে আপনার ছটফটে বাচ্চাকে শান্ত রাখতে আপনি প্যাসিফায়ার ব্যবহার করবেন, তা হলে অবশ্যই এই বিষয়গুলি মনে রাখুন।
স্তন্যপানের সাথে প্যাসিফায়ার দেওয়াকে কখনই গুলিয়ে ফেলবেন না। বাচ্চা ছটফট করলে বা কাঁদলে আগে দেখে নিন, তার খিদে পেয়েছে কি না বা ডায়াপার পাল্টাতে হবে কি না। বাচ্চার পেট ভর্তি আছে এরকম অবস্থাতেই প্যাসিফায়ার দিন। সবথেকে ভালো, একবার খাওয়ানোর পর, আরেকবার খাওয়ানোর মাঝামাঝি সময়ে বাচ্চা ছটফট করলে প্যাসিফায়ার দিন।
বাচ্চাকে প্যাসিফায়ার তখনই দিন, যখন সে নিতে চাইবে। জোর করে মুখে প্যাসিফায়ার গুঁজে দেবেন না।
বাচ্চা যদি ঘুমোতে না চায়, তাকে আদর করুন, দোল খাওয়ান, গান গেয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করুন। তারপরেও যদি বাচ্চা ছটফট করে, তবেই তাকে প্যাসিফায়ার দিন।বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়লে তার মুখে আর প্যাসিফায়ার দেবেন না।
গরম জলে প্যাসিফায়ার ভালো করে পরিষ্কার করুন এবং শুকনো জায়গায় রাখুন। আপনার মুখে নিয়ে প্যাসিফায়ার পরিষ্কার করতে যাবেন না, কারণ এতে ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। মিষ্টিজাতীয় কোনও দ্রবণে এটা পরিষ্কার করবেন না, এতে শিশুর ক্যাভিটি হতে পারে। বিপিএ (BPA bisphenol-A) নেই, এমন প্যাসিফায়ার কেনাই যুক্তিসঙ্গত।
বাচ্চার গলায় বা খাটে কখনই প্যাসিফায়ার বেঁধে রাখবেন না। এতে অসাবধানবশত বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্রয়োজনে বাচ্চার জামায় প্যাসিফায়ার ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখুন।
বাচ্চা স্তন্যপান করতে না চাইলে এবং প্রয়োজনমতো তার ওজন না বাড়লে তাকে প্যাসিফায়ার দেবেন না। বাচ্চার যদি বারবার কানে ইনফেকশন হতে থাকে, তা হলেও তাকে প্যাসিফায়ার দেবেন না।
এই অভ্যেস ছাড়তে বাচ্চার কিছু সময় অবশ্যই লাগে। কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সপ্তাহ লেগে যায় এই অভ্যেস ছাড়ানোর জন্য। এ বিষয়ে বাবা-মায়ের জন্য এখানে কিছু পরামর্শ রইলঃ
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null