একদিকে অস্ত্রোপচার, অন্যদিকে প্রসব যন্ত্রণা; জেনে নিন দুটোরই সুবিধা-অসুবিধা!

একদিকে অস্ত্রোপচার, অন্যদিকে প্রসব যন্ত্রণা; জেনে নিন দুটোরই সুবিধা-অসুবিধা!

শিখা আর অন্বেষা ক্লাস এইট থেকে বন্ধু। দু’জনেই একই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা শেষ করেছে। আজ তারা নামী প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। তবে শিখার বিয়ে হয় অন্বেষার বিয়ের আগেই। ও আটমাসের ফুটফুটে একটি মেয়েও আছে। অন্বেষার বিয়ে হয় ওর কলিগের সঙ্গে। দু’মাস হল ও গর্ভবতী। শিখা আগে মা হওয়ায় অন্বেষার একদিক থেকে সুবিধা হয়েছে। প্রয়োজন হলেই ও ফোন করে প্রিয় বন্ধুকে। নানা বিষয়ে ওর পরামর্শ নেয়। সেদিনও শিখাকে ফোন করেছিল পরামর্শ চাইতেই। ওর জানার ইচ্ছে ছিল নর্মালডেলিভারি না সি-সেকশন কোনটা মা ও সন্তানের জন্য বেশি ভালো। (Normal Delivery Vs Caesarean; Advantages & Disadvantages)

শিখার যদিও সি-সেকশন হয়েছিল। তবে বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর ও বিস্তারিতভাবে দিল। বললো, দুটো পদ্ধতিরই কিছু ভালো দিক যেমন রয়েছে তেমন সমস্যার দিকও আছে (Vaginal Birth vs. C-Section: Pros & Cons)।

 

সিজারিয়ান ডেলিভারি (Caesarean Delivery):

সিজারিয়ান ডেলিভারিতে মায়ের তলপেট ও জরায়ুকে কাটা হয়। এরপর শিশুকে জরায়ু থেকে বের করে অ্যাম্বিলিকাল কর্ড কেটে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে মায়ের প্লাসেন্টাও বের করে নেওয়া হয়। এরপর জরায়ু ও তলপেট উভয়ই স্টিচিং-এর মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া হয়।

 

#1. সিজারিয়ান ডেলিভারির সুবিধা (Advantages Of Caesarean Delivery):

  • রক্তচাপ বেশি: ডেলিভারির আগে অনেক মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ থাকা একটি সমস্যা। এইসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক সিজারিয়ান ডেলিভারির পরামর্শ দেন।
  • ডায়াবেটিস: ডায়বেটিস রয়েছে এমন মায়েদের ক্ষেত্রে ভ্রুণের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়। এই কারণে নর্মালডেলিভারির মাধ্যমে শিশু জন্ম নিতে পারে না। চিকিৎসকের মতে, নর্মালডেলিভারির তুলনায় এই সময় সিজারিয়ান ডেলিভারি বেশি নিরাপদ।
  • শিশুর ব্রিচ অবস্থা: ব্রিচ অবস্থায় শিশুর মাথার বদলে পা আগে নীচের দিকে থাকে। এই ক্ষেত্রে নর্মালডেলিভারিতে শিশুর ক্ষতি হতে পারে। ব্রিচ অবস্থায় থাকা শিশুকে গর্ভ থেকে বের করতে শল্যচিকিৎসকরা সিজারিয়ান ডেলিভারি বেছে নেন।
  • অ্যাম্বিলিকাল কর্ড ও প্লাসেন্টায় জটিলতা: মায়ের সঙ্গে ভ্রুণের যোগাযোগ বজায় থাকে আম্বিলিকাল কর্ডের মাধ্যমে। প্লাসেন্টা হল জরায়ুর ভিতরে থাকা অংশ যা আসলে ভ্রুণের বাড়ি। গর্ভাবস্থায় এই দুই অংশে কোনও জটিল সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসক নর্মালডেলিভারি এড়িয়ে যান। নর্মালডেলিভারিতে বাড়তে পারে সমস্যা। চিকিৎসকরা তাই সিজারিয়ান ডেলিভারিকেই প্রাধান্য দেন।
  • সংক্রমণ বা রোগ: গর্ভাবস্থায় মায়ের জরায়ুতে কোনও সংক্রমণ বা যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়লে নর্মালডেলিভারি শিশু ও মা উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। চিকিৎসক সেক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারিই বেছে নেন।
  • একাধিক সন্তান: চিকিৎসকের মতে, একের বেশি সন্তান মায়ের গর্ভে থাকলে প্রসবের সময় নর্মালডেলিভারি এড়িয়ে চলাই উচিত। এতে সন্তান ও মায়ের ক্ষতি হতে পারে। এক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারি একাধিক সন্তানের জন্য নিরাপদ।

 

#2. সিজারিয়ান ডেলিভারির অসুবিধা (Disadvantages Of Caesarean Delivery):

  • সেরে উঠতে সময় লাগে: সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রধান সমস্যা হল সেরে ওঠার সময়। শিশুর জন্মের পর মায়ের পেট ও জরায়ু সেলাই করে জোড়া দিলেও ঘা শুকোতে অনেকটা সময় লাগে। এর তুলনায় নর্মালডেলিভারিতে মায়ের শরীর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে।
  • সংক্রমণ: কাটা স্থান না শুকনো পর্যন্ত মাকে অত্যন্ত যত্নে রাখতে হয়। তা না-হলে বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে এসে কাটা স্থানে যে কোনও সংক্রমণ হতে পারে। এই সংক্রমণ জরায়ু পর্যন্ত ছড়িয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
  • পেটের পেশি দুর্বল: সিজারিয়ান ডেলিভারির সময় প্রথমেই পেটের ত্বক কাটা হয়। শিশুর জন্মের পরে সেলাই করে জোড়া দিলেও পেটের পেশি আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। বরং পেশিগুলো দুর্বল থেকে যায়।
  • রক্তক্ষরণ: সিজারিয়ান ডেলিভারির সময় কাটাছেঁড়ার কারণে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়। উচ্চরক্তচাপ বা মায়ের অন্য শারীরিক সমস্যার কারণে রক্তক্ষরণ বাড়তে পারে। অত্যাদিক রক্তক্ষরণে মায়ের প্রাণ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
  • সন্তানের সমস্যা: অনেক সময় সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রভাব শিশুর উপর পড়ে‌। সিজারিয়ান অপারেশনের পর কিছু ক্ষেত্রে শিশুকে নিওন্যাটাল কেয়ার ইউনিটে রাখতে হয়। আবার কিছুক্ষেত্রে শিশুর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা যায়। চিকিৎসার মাধ্যমে এগুলো সারিয়ে তোলা হয়।

 

আরও পড়ুন: এই ৮টি খাবার খেতে থাকুন। নরমাল ডেলিভারির পথে হাঁটলে যাত্রা সহজ হবে অনেকটাই

 

#3. নর্মালডেলিভারির সুবিধা (Advantages Of Normal Delivery):

  • তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা: নর্মালডেলিভারির মূল সুবিধাই হল তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা। নর্মালডেলিভারিতে কাটাছেঁড়ার ব্যাপার না-থাকায় মায়ের জরায়ুতে কোনও আঘাত লাগে না। ফলে দু’-তিন দিনের মাথায় সহজেই বাড়ি ফেরা সম্ভব হয়।
  • অপারেশনের ঝুঁকি এড়ানো যায়: অপারেশনের মাধ্যমে হওয়ায় সিজারিয়ান ডেলিভারিতে বেশ কিছু বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। অত্যাধিক রক্তক্ষরণ, ঘা না-শুকনো, অ্যানেস্থেসিয়ার নেগেটিভ প্রভাব ইত্যাদি এই আশঙ্কাগুলোর মধ্যে অন্যতম। নর্মালডেলিভারির ক্ষেত্রে তেমন কোনও বিপদের আশঙ্কা থাকে না।
  • ভ্রুণের স্বাভাবিক ফুসফুস: মায়ের গর্ভে থাকাকালীন ভ্রুণের ফুসফুসে তরল জমে থাকে। যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় চাপের ফলে সেই তরল বেরিয়ে যায়। ফলে জন্মের পর শিশুর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হয় না।
  • বেশি প্রতিরোধক্ষমতা: মায়ের যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় শিশু এমন কিছু পদার্থের সংস্পর্শে আসে যা ওর প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।‌ ওর বিশেষভাবে যত্ন নিয়ে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলার প্রয়োজন হয় না।

 

#4. নর্মালডেলিভারির অসুবিধা (Disadvantages Of Normal Delivery):

  • যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়া: একটি পাতলা ত্বকের মাধ্যমে মায়ের যোনিপথের থেকে পায়ুর পথ আলাদা করা থাকে। নর্মালডেলিভারির সময় যোনিপথ যথেষ্ট চওড়া হওয়া প্রয়োজন। নয়তো শিশু বেরিয়ে আসার সময় যোনিপথের ত্বক ছিঁড়ে যেতে পারে। ত্বকের অনেকটা ক্ষতি হলে চিকিৎসক সেলাইয়ের মাধ্যমে সারিয়ে তোলেন।
  • দুর্বল পেলভিক পেশি: নর্মালডেলিভারিতে প্রচণ্ড লেবার প্রয়োগের ফলে মায়ের পেলভিক পেশি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের কথায়, কতটা লেবার প্রয়োগ করতে হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে পেলভিক পেশির অবস্থা।
  • মলমূত্র ত্যাগে সমস্যা: নর্মাল ডেলিভারির পরে মলমূত্র ত্যাগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে বায়ুত্যাগেও নিয়ন্ত্রণ থাকে না, পায়খানা তরল হয়, মূত্রত্যাগের ক্ষেত্রেও প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। এমনকি হাঁচি কাশির সময়েও ইউরিন লিক হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নর্মাল ডেলিভারির সময় পেলভিক অঙ্গগুলিতে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি হয়। এই কারণে এরা এদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলে।
  • পেরেনিয়ামে ব্যথা: পেরিনিয়াম হল যোনিপথ ও পায়ুর মধ্যবর্তী পর্দা। নর্মালডেলিভারির সময় শিশু যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে। এতে মায়ের পেরিনিয়াম পর্দায় চাপ সৃষ্টি হয়‌। অত্যাদিক চাপে এই পর্লা ছিঁড়েও যেতে পারে। চাপ সৃষ্টি হয় বলেই ডেলিভারির পর কয়েকদিন পেরিনিয়ামে ব্যথা থাকে।

 

অন্বেষা এই দুই ডেলিভারি সম্পর্কে কিছুই জানত না। শিখার কাছ থেকে জানার পর ও যথেষ্ট উপকৃত হয়। পরে ডেলিভারির আগে ওর চিকিৎসকও ওকে এই একই কথা বলেন। যেহেতু ও আগে থেকেই এগুলো জানত, তাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। নর্মাল ডেলিভারির পর ওর তেমন সমস্যা হয়নি। শুধু মলমূত্রের সমস্যা বেশ কিছুদিন‌ ছিল। তবে প্রথম সন্তানের জন্য এইটুকু তো সহ্য করাই যায়! (Normal Delivery Vs Caesarean; Advantages & Disadvantages)

 

আরও পড়ুন: গর্ভকালীন দিনগুলোয় আপনার গোপনাঙ্গের যত্ন নেওয়ার গোপন কথা

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null