গীতশ্রী আর কৌশিক মাত্র ক’দিন আগে এক কন্যাসন্তানের মা-বাবা হয়েছে। এখন তারা বসে আছে চিকিৎসকের চেম্বারে। সন্তান আসার পর গোড়াতেই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়াটা দরকার, তারা সেটা জানে। প্রথম সন্তান হওয়ার আনন্দ যেমন বাঁধভাঙা তেমনই চাপা চিন্তাও রয়েছে। কারণ অভিভাবক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জীবনে আসে নতুন দায়িত্ব, যা পালনের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। (Great Tips for Moms with Newborn Babies)
চিকিৎসক ওদের চাপা চিন্তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি প্রথমেই হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে দু’জনের মন একটু হালকা করলেন। এরপর দু’-একটি কথা মধ্যে দিয়ে শুরু করলেন ছোট্ট খুকুকে দেখাশোনার কথাবার্তা। শুরুতেই তিনি মূল বিষয়গুলো নিয়ে (Baby Care Tips for New Moms) বলা শুরু করলেন যেমন খাওয়ানো, ডায়পার পাল্টানো, ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি।
নবজাতকের পরিচর্যা করবেন যেভাবে (How to Take Care of Newborn Baby)
#1. খাওয়ানো: প্রথম একবছরে শিশুর বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়। জীবনের প্রথম পাঁচ-ছয় মাস দুধই খুদের একমাত্র খাদ্য। এই দুধ ওর হাড়ের গঠন শক্ত করে। ওকে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায়। চিকিৎসকের মতে, ছয় মাস বয়স পর্যন্ত জলও ওকে খাওয়ানো উচিত নয়। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া হলেও দুধ খাইয়েই ওর তেষ্টা মেটাতে হবে। কী খাওয়াবেন, তা নিয়ে এই কয়েক মাস মায়েদের চিন্তা থাকে না। তবে খাওয়ানোর কায়দাকানুন নিয়ে এই সময় সব মা-ই নাজেহাল হন। চিকিৎসক প্রথমে সে বিষয়েই আলোকপাত করলেন।
- মাথা উঁচু রাখুন: জন্মের পর সোনার খাদ্যতন্ত্র অপরিণত থাকে। তাই দুধই ওর একমাত্র খাদ্য। তবে দুধ খাওয়ানোর সময় সতর্ক না-থাকলে দুধ ওর গলায় আটকে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মতে, দুধ খাওয়ানোর সময় ছোট্ট খুকুর ঘাড় ও মাথা সামান্য উঁচু করে রাখা উচিত। এতে দুধ শ্বাসনালিতে ঢোকার সম্ভবনা থাকে না।
- দুই স্তন থেকেই খাওয়ান: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, খুদে একটানা একই ভাবে দুধ খেতে পছন্দ করে না। চিকিৎসক তাই জানালেন, দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের দুই স্তন থেকেই পাল্টে পাল্টে দুধ খাওয়ানো উচিত। এতে মায়ের দুই স্তনে যেমন দুধের ভারসাম্য বজায় থাকে, তেমনই পজিশন পরিবর্তনের কারণে খুদেও দুধ খাওয়া নিয়ে বিরক্ত হয় না।
- ওর সময় মেনে চলুন: সদ্যোজাত শিশু দিনে অন্তত ১৪ থেকে ১৭ ঘন্টা ঘুমিয়েই কাটায়। তাই যখনই ওর ঘুম ভাঙে, তখনই দুধ খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। সাধারণত এক্ষেত্রে দু’-তিন ঘণ্টা অন্তর ওকে দুধ খাওয়াতে হয়। তবে বোতলে যারা দুধ খায়, তারা চার ঘণ্টা অন্তর দুধ খায়। তাই প্রথম কয়েকমাস একরত্তির এই দুষ্টুমি আপনাকে সহ্য করতেই হবে। এমনকী মাঝরাতেও ঘুম থেকে উঠে দুধ খাওয়ানোর জন্য তৈরি থাকা ভালো (Newborn Baby Care 1st Month)।
- ঢেকুর তোলানো: খাওয়ানোর পর খুদেকে ঢেকুর তোলানো অবশ্যই প্রয়োজন। দুধ খাওয়ার সময় ছোট্ট সোনা বাইরের হাওয়াও অনেকটা গিলে ফেলে। এই হাওয়া দুধের সঙ্গেই ওর পেটে যায়। তাই দুধ খাওয়ানোর পর খুদেকে ঘাড়ে শুইয়ে পিঠে আলতো করে মালিশ করুন। অথবা বিছানায় শুইয়ে ছোট্ট পা দুটো সাইক্লিং-এর মতো ঘোরান। এতে ওর পেটের বায়ু সহজেই বেরিয়ে আসবে।
#2. ডায়পার পাল্টানো (Diaper Changing): ডায়পার পাল্টানোও মা-বাবার কাছে রীতিমতো এক পরীক্ষা। ডায়পারেই যেহেতু খুদে হিসু ও পায়খানা করে তাই, এগুলো থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় থাকে। খুদের ত্বক সংবেদনশীল হওয়ায় ডায়পার থেকে সহজেই র্যাশ হতে পারে। এ নিয়েও চিকিৎসক ওদের সতর্ক করলেন।
- ডায়পার র্যাশ: ডায়পারের মলমূত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়া খুদের ত্বকে সহজেই প্রভাব ফেলে। ব্যাকটেরিয়ার কারণে খুদের ত্বকে র্যাশ ফুটে ওঠে। এই র্যাশ ঠিক সময়ে চোখে না-পড়লে অনেকটাই বেড়ে যায়। এর ফলে খুদের মেজাজও বিগড়ে যায়। এমনকী খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের পরিবর্তন আসে।
- নিয়মিত ডায়পার পরিবর্তন: হিসু বা পায়খানা কোনওটাই ত্বকের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়। তাই চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন, যে কোনও একটা হলেই ডায়পার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাল্টে দেওয়া উচিত। এতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সুযোগ পায় না (Newborn Baby Care Advice & Tips)।
- মসৃণ ওয়াইপার: ওয়াইপ করার সময় সবসময় মসৃণ ওয়াইপার ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও খুবই আলতো ভাবে ওয়াইপ করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। অসতর্কভাবে ওয়াইপ করলে ছড়ে যেতে পারে একরত্তির ত্বক।
#3. ঘুম পাড়ানো (Sending To Sleep): খুদেকে ঘুম পাড়ানোর জন্য সময় মেনে চলা খুবই প্রয়োজন। সদ্যোজাত শিশুরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা ঘুমিয়েই কাটায়। এই ঘুমই তাদের মস্তিষ্ককে পরিণত হতে সাহায্য করে। তবে এক্ষেত্রেও কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখা জরুরি।
- শোওয়ানোর ধরন: খুদেকে বিছানায় সবসময় চিৎ করে শোওয়ান। প্রথম কিছু মাস ওকে পাশ ফিরিয়ে বা পেটের উপর উপুড় করে শোওয়ানো মোটেই উচিত নয়। এতে নিঃশ্বাস নিতে যেমন সমস্যা হতে পারে, তেমনি ঘাড়ে চোটও পেতে পারে একরত্তি।
- প্যাসিফায়ার: খুদেকে ঘুম পাড়াতে ব্যবহার করতে পারেন প্যাসিফায়ার। এতে স্তন্যপানের অনুভূতি থাকায় খুদের ভালো ঘুম হয়।
- ঘরের তাপমাত্রা বজায় রাখুন: শোওয়ার সময় খুদেকে গরম জামাকাপড় পরাতে নিষেধ করেন চিকিৎসকরা। বরং ঘরের তাপমাত্রা অনুযায়ী ওকে পাতলা জামা পরিয়ে রাখা উচিত। এতে খুদের ঘুম ভালো হয়। ওর শরীরের তাপমাত্রা ঘরের তুলনায় বেশি হলে ওর অস্বস্তি বাড়বে। এর থেকে ওর মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে (How to Take Care of a Newborn Baby)।
- ধূমপান বন্ধ: ছোট্ট খুদে জেগে থাকা বা ঘুমনো কোনও অবস্থাতেই ওর সামনে ধূমপান করা উচিত নয়। এতে ওর নিশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। পাশাপাশি ফুসফুসেরও ক্ষতি হওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন: কিছুতেই ল্যাচ করতে পারছে না সদ্যোজাত; ব্রেস্টফিডিং সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধানে রইল টিপস!
#4. স্নান করানো (Baby Bathing): নবজাতককে স্নান করানোর ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ এই সময় খুদেকে বাথটাবে স্নান করানো উচিত নয়।
- ঈষদুষ্ণ জল ও স্পঞ্জিং: একরত্তির জন্য ব্যবহৃত স্নানের জল সামান্য গরম হওয়া উচিত। এতে জলের সংস্পর্শে এলেও খুদের শরীর তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা হারায় না। চিকিৎসকদের মতে, জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস বাথটাবে স্নান না করানোই উচিত। এর পরিবর্তে ঈষদুষ্ণ জলের সাহায্যে খুদের শরীর স্পঞ্জ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওকে পরিষ্কার রাখতে নিয়মিত ডায়পার পরিবর্তন, বিছানার কাপড় উষ্ণ জলে ধোয়া, ওর জামাকাপড় নিয়মিত ধোয়া ইত্যাদিই বেশি কার্যকর।
এগুলো তো গেল ছোট্ট খুকুর প্রধান প্রধান দিক যা নিয়ে কৌশিক আর গীতশ্রী দু’জনেই চিন্তিত ছিল। চিকিৎসকের কাছ থেকে এই ব্যাপারে জেনে নেওয়ায় তারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত হল। তবে এছাড়াও আরও দুয়েকটি ব্যাপারে চিকিৎসক আলোচনা করলেন (Most Effective Newborn Baby Care Tips)।
- খেলনা নির্বাচন: সদ্যোজাত শিশুর জন্য খেলনা হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে রংবেরঙের সাধারণ পশুপাখি জাতীয় খেলনা। কারণ এই সময় খুদের মস্তিষ্ক আশেপাশের রঙের সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। বয়স একটু বাড়লে খুদে হাত দিয়ে পছন্দের খেলনা ধরতে পারে। খেলনা কেনার সময় মাথায় রাখা উচিত যাতে খেলনা আকারে যথেষ্ট বড় হয়। নয়তো কোনওভাবে খুদের মুখে গেলে তা থেকে বড়সড় বিপদ হতে পারে। এছাড়া সুরেলা খেলনাও কেনা যেতে পারে ছোট্ট সোনার জন্য। সুর ওর মস্তিষ্ককে আরাম দেয়।
- মানসিক স্বাস্থ্য: বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যে নজর রাখা বাবা-মায়ের প্রথম দায়িত্ব। কারণ ওর আশেপাশের পরিবেশে কোনও উত্তেজনা তৈরি হলে ওর মধ্যে সেটা খুব সহজেই ছড়িয়ে যায়। বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি, বা আচমকা তীব্র আওয়াজ ওকে ভয় পাইয়ে দেয়। খুদে তখন কাঁদতে থাকে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন মায়েরা কোনও ভাবেই যেন শিশুর সামনে অবসাদে না ভোগেন। কারণ এই ডিপ্রেশন সহজেই শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যা ভবিষ্যতেও বিপদে ফেলতে পারে ছোট্ট সোনাকে (Newborn Baby Care Tips)।
চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর দু’জনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে, মন থেকে সরে যায় চিন্তার মেঘ। যে যে ব্যাপারে ওদের দুশ্চিন্তা ছিল, চিকিৎসক তার সব ক’টিরই সমাধান করে দিয়েছেন। এবার শুধু পরীক্ষা দেওয়ার পালা। তবে গীতশ্রী ও কৌশিক দুজনেই এখন কনফিডেন্ট। ছোট্ট খুকুর বেড়ে ওঠাতে দু’জনেই যে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবে, এই ব্যাপারে তারা কনফিডেন্ট (Great Tips for Moms with Newborn Babies)।
আরও পড়ুন: শিশুর প্রয়োজন বাড়তি যত্নর। ওর দেখভালে কেনাকাটির চেকলিস্ট থাকল এখানে!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null