বাড়াবাড়ি না হলে ঘরেই সামলে নেওয়া যায় একজিমা; পথ্যগুলো জানেন তো?

বাড়াবাড়ি না হলে ঘরেই সামলে নেওয়া যায় একজিমা; পথ্যগুলো জানেন তো?

ছোট্ট টুসি আসার পর থেকে দীপালি আর অনিন্দ্যর জীবনে আনন্দের জোয়ার এসেছে। মাত্র তিন মাস হয়েছে ও এই পৃথিবীতে এসেছে। দীপালির মা হওয়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে দারুণ। বিপুল আনন্দের সঙ্গে অবশ্য অনেক নতুন দায়িত্বও এসেছে ওর জীবনে। ছোট্ট টুসিকে দুধ খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, ডায়পার পাল্টানো– সবই একা হাতে সামলাতে হচ্ছে। একদিন দুধ খাওয়ানোর সময়েই ওর চোখে পড়ল খুদের গালটা। গালের ত্বকটা কেমন লাল হয়ে গিয়েছে! অনিন্দ্যকে একথা জানাতেই ও বললো, এখনই টুসির চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসকের চেম্বারে পৌঁছাতেই উনি টুসিকে পরীক্ষা করে বললেন, ওর গালে একজিমা হয়েছে। (10 Best Natural Remedies for Eczema in Babies)

এতটুকু বাচ্চার একজিমা! ওরা দু’জনেই কথাটা শুনে অবাক! চিকিৎসক জানালেন, এটা এই বয়সের অনেক শিশুরই হয়। কারণটা বিস্তারিত বলা যাক।

 

একজিমার কারণ (Causes Of Eczema)

 আট মাস বয়সের আগে অনেক খুদেই একজিমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এর কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।

  • বংশগত কারণে: বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক সময় একজিমা উত্তরাধিকার সূত্রে শিশুর মধ্যে আসে। পরিবারের কারও এই অসুখ থাকলে ওরও তা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে আশেপাশের কারও হলে ওরও হবে, এমন কোনও কথা নেই। কারণ একজিমা ছোঁয়াচে নয়।‌
  • ত্বকের সমস্যা: ত্বকের উপরিভাগে থাকে রক্ষণাত্মক কোষের স্তর। এই কোষগুলোর মধ্যে থেকে আর্দ্রতা হারিয়ে গেলে নানা ধরনের জীবাণু ত্বকে প্রবেশের সুযোগ পায়। এ থেকেই খুদের ত্বকে একজিমার মতো চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
  • পরিবারে কারও অ্যালার্জি: বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পরিবারে কারও অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে খুদের শরীরে একজিমা হতে পারে। ফুলের পরাগরেণু, পোষ্যের লোম ইত্যাদি থেকে অনেক শিশুরই অ্যালার্জি হয়। এছাড়া পরিবারে কারও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা থাকলেও ছোট্ট সোনার একজিমা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
  • সেরামাইডের কম উৎপাদন: বিশেষজ্ঞদের কথায়, ত্বকের উপরে থাকে সেরামাইড নামক একধরনের ফ্যাটযুক্ত কোষ। ত্বকে এই কোষের পরিমাণ কমে গেলে ত্বকে জলের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে থাকে। এ থেকে একজিমা হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
  • অত্যাধিক গরম: ছোট্ট সোনার শরীরের উষ্ণতা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেলে একজিমার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকের মতে, গরমকালে অত্যাধিক উষ্ণতা, গরম জলে স্নান বা বেশি জামাকাপড় পরে থাকার ফলে খুদের শরীর বেশি উষ্ণ হয়ে যায়।
  • মানসিক চাপ: মানসিক চাপ অন্যতম গুরুতর কারণ। চিকিৎসকরা বলেন, মানসিক চাপ আর একজিমা একে অন্যকে গুরুতর করে তোলে। অর্থাৎ মানসিক চাপ থেকে একজিমা হলে তা থেকে আবার মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। এর ফলে একজিমা আরও গুরুতর হয়। ছোট্ট সোনার আশপাশের পরিবেশ যথেষ্ট শান্ত ও সুন্দর না-হলে ওর মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। এ থেকেই একজিমা হওয়া সম্ভব।

 

একজিমার কারণগুলো জানানোর পর চিকিৎসক একে একে একজিমা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তথ্যও জানালেন‌।‌

  • স্বাভাবিক সমস্যা: সদ্যোজাত শিশুর ত্বক খুবই কোমল ও সংবেদনশীল হয়। তাই একজিমার মতো ত্বকের সমস্যা খুবই স্বাভাবিক। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ সদ্যোজাত শিশুর ক্ষেত্রেই একজিমার মতো সমস্যা হয়।
  • অ্যাটপিক: অ্যাটপিক শব্দের অর্থ হল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অতি-সংবেদনশীলতা। বেশিরভাগ ছোট শিশুর ক্ষেত্রেই অ্যাটপিক গোত্রের একজিমাই হয়। খুদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা কমতে থাকে।
  • সদ্যোজাত শিশুর ক্ষেত্রে: একজিমা সদ্যোজাত শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি লক্ষ করা যায়। ছোট্ট সোনার বয়স আট মাস হওয়ার আগে এই সমস্যা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।
  • চুলকানি: ছোট্ট সোনার ত্বকে একজিমা হলে ত্বক লাল হয়ে যায়। একজিমা বাড়তে থাকলে ত্বকে চুলকানি দেখা দিতে থাকে‌। ছোট্ট সোনা চুলকাতে পারে না বলে ওর মেজাজ বিগড়ে যায়।
  • সম্ভাব্য স্থান: একজিমা খুদের ছোট্ট শরীরে যে কোনও স্থানেই হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় একজিমা বেশি দেখা যায়। সদ্যোজাত শিশুর দুই গাল, মাথার ত্বক, এছাড়াও হাঁটুর পিছনে, কনুই ইত্যাদি স্থানে একজিমা বেশি দেখা যায়‌।

 

আরও পড়ুন: ঘরোয়া ভাবেই সামাল দিন ছোট্ট সোনার অ্যালার্জির সমস্যা; উপায় এখানে!

 

দীপালি চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলো, একজিমা কী বাড়িতেই সারিয়ে তোলা যায়, নাকি এর জন্য ওষুধ প্রয়োজন? চিকিৎসক জানালেন, সব ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হয় না। বরং কিছু ঘরোয়া উপায়েই একজিমা সারিয়ে তোলা সম্ভব। (Natural Eczema Treatments and Prevention Tactics)

#1. ঈষদুষ্ণ জলে স্নান (Lukewarm Bath): একজিমার সমস্যার একটি ঘরোয়া সমাধান হল, ঈষদুষ্ণ জলে ছোট্ট সোনাকে স্নান করানো। নিয়মিত পাঁচ থেকে দশ মিনিট খুদেকে ঈষৎ গরম জলে স্নান করালে ত্বকের আর্দ্রতা সহজে হারায় না। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই স্নান ১০ মিনিটের বেশি কখনই করানো উচিত নয়। এছাড়াও স্নানের পরে সদ্যোজাতের গা মুছিয়ে দিতে হবে। মুছিয়ে দেওয়ার সময় গা সামান্য ভিজে থাকলে সমস্যা নেই। এতে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকে। (Natural Remedies for Baby Eczema)

#2. ময়শ্চারাইজার (Moisturizer): শুষ্ক আবহাওয়ায় খুদের ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ে। এ থেকেও একজিমা হতে পারে। তাই ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে ত্বকে ময়শ্চারাইজার মাখানো প্রয়োজন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওর জন্য ভালো মানের ময়শ্চারাইজার বাছুন। স্নানের পরে এটি ছোট্ট সোনার গায়ে ভালোভাবে মাখিয়ে দিলে ত্বক অনেকক্ষণের জন্য আর্দ্র থাকবে।

#3. মলম ব্যবহার করুন (Use An Ointment): ময়শ্চারাইজারের তুলনায় মলম বেশি ঘন হয়। তাই অনেক চিকিৎসকই মলমের কথা বলেন। একজিমা হওয়া স্থানে মলম লাগালেও তাড়াতাড়ি উপকার পাওয়া যায়। তবে কোন মলম সদ্যোজাতের জন্য ঠিকঠাক, সে ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মলম যেহেতু চটচটে তাই ছোট্ট খুদের এতে অস্বস্তি হতে পারে। সেক্ষেত্রে মলমের বদলে বেশি ঘন ক্রিম-লোশনও ব্যবহার করা যেতে পারে। (Eczema Treatment for Children)

#4. আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক (Humidifier): ছোট্ট সোনার ঘরে একটি আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক বা হিউমিডিফায়ার থাকা খুবই জরুরি। হিউমিডিফায়ার ঘরের আর্দ্রতা সহজে হারাতে দেয় না। (How to Stop Eczema Itching in Babies) এতে সদ্যোজাত সোনামণির ত্বকও আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে না। যা একজিমার মতো চর্মরোগকে দূরে রাখে।

#5. পোষ্যের থেকে দূরে রাখুন (Keep Away From Pet): অ্যালার্জির কারণেও একজিমা ছড়াতে পারে। তাই ছোট্ট সোনার থেকে আপনার পোষ্যকে দূরে রাখাই ভালো। পোষ্যের লোম খুদের বিছানায় বা জামাকাপড়ে লেগে থাকলে তা থেকে ওর একজিমা হতে পারে। এছাড়াও পোষ্যের লালা থেকেও ছোট্ট সোনার সমস্যা হতে পারে।

#6. নারকেল তেল (Coconut Oil): একজিমা হওয়া জায়গাগুলোয় নারকেল তেল লাগাতে পারেন। নারকেল তেল খুদের কোমল ত্বককে আর্দ্র করে। অন্যদিকে এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা একজিমার জীবাণুকে বিনষ্ট করতে সাহায্য করে। (Baby Eczema Treatment Coconut Oil)

#7. ওটস ভেজানো জলে স্নান (Oatmeal Bath): খুদেকে খানিক আরাম দিতে ওকে স্নান করান ওটস ভেজানো জলে। এতে চুলকানি ভাব কমবে অনেকখানি। ২/৩ কাপ ওটস ব্লেন্ডারে গুঁড়ো করে নিন। কুসুম গরম জলে এবার এই গুঁড়ো ছড়িয়ে নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। বাচ্চাকে এই জলে স্নান করান প্রথমে, তারপর পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে নিন। (Useful Home Remedies for Baby Eczema)

#8. টাটকা রোদ (Sunlight): কিছু সময় খুদেকে কোলে নিয়ে রোদে ঘুরলেও দারুণ উপকার পেতে পারেন। এতে ওর জখম ত্বকের আরাম হবে। তবে খেয়াল রাখবেন, রোদ যেন ভীষণ কড়া না হয়। তা হলে আরামের বদলে কষ্টই বাড়বে সোনার। টাটকা, সকালের রোদে মিনিট ১৫ ওকে রাখলেই কাজ হবে।

#9. ঢিলেঢালা সুতির জামা (Loose Clothes): নিশ্চিত করুন, সদ্য়োজাতকে যে জামাকাপড় পরাচ্ছেন তা যেন সুতির হয়, এবং হাওয়া খেলার জায়গাও থাকে যথেষ্ট। (Baby Eczema Relief) আঁটোসাঁটো জামা থেকেই ঘাম হয়, আর তা থেকেই ছড়িয়ে যায় জীবাণু।

#10. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন (Consult Your Doctor): ঘরোয়া সমাধানগুলো প্রয়োগ করেও সমস্যা মিটছে না? ছোট্ট সোনার একজিমা বাড়ছে বই কমছে না? এমনকী চুলকানিও হচ্ছে একজিমার অংশে? এসব ক্ষেত্রে খুদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। চিকিৎসকের ওষুধে সহজেই মিটতে পারে খুদের সমস্যা।

চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়ে সেদিন খুবই উপকৃত হয় দীপালি। চিকিৎসকের কথা মতোই ও টুসিকে হালকা গরম জলে স্নান করাতো। স্নানের পরে নিয়মিত ময়শ্চারাইজারও লাগিয়ে দিত। এতে পাঁচ-ছ’দিনের যধ্যেই একজিমা একেবারে উধাও! তখন টুসির নরম গালের হাসি আর দেখে কে! (10 Best Natural Remedies for Eczema in Babies)

 

আরও পড়ুন: ওর ক্র্যাডল ক্যাপ হয়নি তো? এটি সারিয়ে তোলার ঘরোয়া পদ্ধতিই বা কী কী?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। 

null

null