“মা” হিসেবে সুনন্দিতার বয়স ১০ দিন। ছেলে কোলে হাসপাতাল থেকে সোজা বাপের বাড়ি এসেছে সে। ডেলিভারির ধকল কাটিয়ে ওঠা আর একদম ছোট্ট বাচ্চাকে একা সামলাতে হবে না, এই দুটো কারণ ছাড়াও বাপের বাড়ি আসার একটা বড় কারণ সুনন্দিতার বোন। (Myths and Facts about Breastfeeding)
তার বোন অনিন্দিতা একজন পেডিয়াট্রিশিয়ান বা শিশু বিশেষজ্ঞ; কাজেই সদ্যোজাত বোনপোর কোনও অসুবিধা হলেই মাসিকে পেয়ে যাবে সে।হইচই একটু থিতিয়ে যেতেই অনিন্দিতার চোখে পড়লো, তার দিদি বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় হলেই টুক করে বাথরুমে চলে যাচ্ছে। আবার ১ মিনিটের মাথাতেই ঘুরে আসছে, তারপর দুধ খাওয়াচ্ছে।
খটকা লাগতেই দিদিকে জিজ্ঞাসা করলো। সুনন্দিতার ঝটতি জবাব, “ আরে গরমে ঘেমে যাচ্ছি, বাতাসে কত ধুলো উড়ছে, তাই বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়ানোর আগে আমি নিপল ভালো করে ধুয়ে আসি সবসময়।”
বেচারি ভেবেছিলো তার ডাক্তার বোন উত্তরটা শুনে খুব খুশি হবে। আদৌ তা না করে অনিন্দিতা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। নতুন মা হওয়া একমাত্র দিদিটি কিছুই বুঝতে না পেরে কাঁচুমাচু মুখে তাকিয়ে আছে হেসে ফেললো অনিন্দিতা।
ব্রেস্টফিডিং নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আমাদের মনে গড়ে ওঠে, এবং তাকে ইন্ধন জোগায় আশেপাশের কম-জ্ঞানী মানুষজন। মাঝখান থেকে বিভ্রান্ত হয় সুনন্দিতার মতো মায়েরা।
ব্রেস্টফিডিং নিয়ে কতগুলো ভ্রান্ত ধারণা মনে পুষে রাখি আমরা, যার প্রত্যেকটাই ভিত্তিহীন (Breastfeeding Benefits)। ডাক্তার বোন দিদিকে বুঝিয়ে দিলো সব সত্যিগুলো। আর সেগুলো প্রতিবেদনের আকারে সাজিয়ে দিলাম আমরা। নতুন মায়েরা, দেখে নাও একনজরে।
আসল সত্যিটা কী? বাচ্চারা ল্যাচ করার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এই কথাটা সত্যি হলেও, ছোট্ট বাচ্চার কিন্তু সাহায্যের প্রয়োজন হয়। আর নতুন মায়ের জন্যও এই কথা প্রযোজ্য। মা বাচ্চার জন্ম দিয়েছে মানেই যে স্তন্যপান করাতে গিয়ে কোনও অসুবিধায় সে পড়বে না, এমনটা একেবারেই নয়।
অনেক শিশুই জন্মের পরে সুন্দর ল্যাচ করতে পারে, আবার অনেকেই পারে না। এটা একেবারেই মায়ের অক্ষমতা বা শিশুর রুগ্নতা নয়। ল্যাকটেশন বিশেষজ্ঞরা মা এবং শিশুকে এক্ষেত্রে মা ও শিশুকে সাহায্য করতে পারেন। বলাই বাহুল্য, ব্রেস্টফিডিং-এও কিন্তু অভ্যাসের প্রয়োজন। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায় মা ও শিশুর ক্ষেত্রে।
আসল সত্যিটা কী? চোখে দেখে এই কথাটা সত্যি বলে মনে হলেও এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বাচ্চার জন্মের পরে প্রথম ৩-৪ দিন যে দুধ তৈরি হয়, তা সাধারণ দুধের তুলনায় ঘন হয়। প্রচুর অ্যানটিবডি, এনজাইম, গ্রোথ ফ্যাক্টর আর ইমিউনোগ্লোবিনে ভরপুর থাকে এই “শালদুধ” বা “কোলোস্ট্রাম”। সদ্যোজাত বাচ্চার যতটা প্রয়োজন সেরকমই দুধ তৈরি করে মায়ের শরীর।
আসল সত্যিটা কী? বাচ্চা যদি সঠিকভাবে ল্যাচ করতে পারে, তা হলে কখনই দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের অস্বস্তি হয় না বা নিপলে ব্যথা হয় না। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় যদি নিপলে ব্যথা হয়, তার মানে বাচ্চার ল্যাচিং-এর পজিশন ঠিক নেই। বাচ্চা ঠিকমতো দুধ টানতে পারছে না বলেই নিপলে কামড়াচ্ছে বা আপনি ব্যথা পাচ্ছেন।
আসল সত্যিটা কী? ঘাম হচ্ছে, ময়লা বসছে, দুধ খাওয়ানোর আগে এই ভেবে প্রত্যেকবার নিপল ধুয়ে আসার কোনও প্রয়োজন নেই। নিয়মিত স্নান করার সময় পরিষ্কার করা আলাদা কিন্তু ব্রেস্টফিড করানোর আগে নিপল ধোওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বাচ্চারা মায়ের গন্ধ চেনে ওই নিপলের গন্ধ থেকেই। মায়ের নিপল একধরনের পদার্থ তৈরি করে যাতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, এরাই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। আবার এই পদার্থের বিশেষ গন্ধই ছোট্ট শিশুকে মায়ের উপস্থিতির অনুভব করায়।
আরও পড়ুন: কিছুতেই ল্যাচ করতে পারছে না সদ্যোজাত; ব্রেস্টফিডিং সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধানে রইল টিপস!
আসল সত্যিটা কী? শুধু ব্রেস্টফিড করানো মায়েদের নয়, সবাইকেই একটা সুস্থ এবং সুষম ডায়েট মেনে চলতে হয়। (Myths about Breastfeeding and Diet) বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন বলে সবসময় হালকা, সেদ্ধ ঘ্যাঁট খাবার খেতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। (Breastfeeding Myths and Facts)
একটা সুষম ডায়েট মেনে চলুন। অনেক খাবারে বুকের দুধের পরিমাণ বাড়ে, খেতে ভুলবেন না সেগুলোও। মিলিয়ে নিতে পারেন এখানে-> বড়দের পরামর্শে দুধ বাড়াতে অনেক কিছুই তো খাচ্ছেন। এই রেসিপিগুলো ট্রাই করেছেন কি?
তবে আপনি কোনও নতুন খাবার খেলে বাচ্চার যদি কোনও অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয়, ডাক্তারবাবুর সাথে পরামর্শ করুন।
আসল সত্যিটা কী? স্তনের আকার ছোট না বড় এর ওপর দুধ তৈরির পরিমাণ যেমন নির্ভর করে না। প্রেগন্যান্সির সময়ে মায়ের ব্রেস্টে কিছু বিশেষ টিস্যু তৈরি হয়, এরাই দুধ তৈরিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। মায়ের শরীরে দুধ তৈরি নির্ভর করে ম্যামারি গ্ল্যানডের স্টিমুলেশন ওপরে এবং বাচ্চা সঠিক ল্যাচ করে দুধ খাচ্ছে কি না তার ওপরে।
আসল সত্যিটা কী? সাধারণ জ্বর, সর্দি ইত্যাদির মতো শরীর খারাপ বা সাধারণ ইনফেকশন মা বুঝতে পারার আগেই বাচ্চার শরীরে চলে যায়। আবার বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্রেস্টমিল্কের ওপর নির্ভর করে। মায়ের শরীরের ইনফেকশন যেরকম বাচ্চার শরীরে যায়, মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া সবল অ্যানটিবডিরাও কিন্তু মায়ের দুধের মাধ্যমেই শিশুর শরীরে যায়।
আর মায়ের দুধ থেকে পাওয়া এই অ্যানটিবডিরাই শিশুকে রোগজ্বালার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। তা সে মায়ের শরীর থেকে আসা ইনফেকশনই হোক বা বাইরের কোনও জীবাণু।
আসল সত্যিটা কী? আধুনিক উন্নত মানের সব ফরমুলাই মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয় এবং উপায়ান্তর না থাকলে বাচ্চাকে ফরমুলাই খাওয়াতে বলেন ডাক্তারবাবুরা। কিন্তু মায়ের দুধ আর ফরমুলা মোটেই এক নয়।
ফরমুলায় কোনও জীবিত কোষ, হরমোন, এনজাইম বা অ্যানটিবডি থাকে না, যা মায়ের দুধে আছে ভরপুর মাত্রায়। আবার শিশুর শরীর অনুযায়ী মায়ের শরীর পরিবর্তন আনে দুধের গঠনেও। বাচ্চার যখন যেমন প্রয়োজন সেভাবেই কাজ করে মায়ের দুধ। বলা বাহুল্য, ফরমুলা এই কাজ করতে অক্ষম। বাচ্চার প্রয়োজন অনুযায়ী মায়ের দুধ বদলে ফেলে তার গঠনও।
আসল সত্যিটা কী? বাচ্চার বয়স যদি তিনমাসের ছোট হয়, তা হলে একথা প্রযোজ্য হবে না ওর ক্ষেত্রে। একদম ছোট্ট বাচ্চারা প্রায় সারাক্ষণই ঘুমিয়ে থাকে। বাচ্চা মানুষ, না বোঝে খাওয়ার সময়, না বোঝে নিজের প্রয়োজন। একটা সময় ধরে তাকে খাওয়ানোর অভ্যেস তৈরি করে দিতে হয় মাকেই। নির্দিষ্ট সময় পরপর বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে এবং প্রয়োজনে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়েই সেটা করতে হবে।
আসল সত্যিটা কী? ব্লকড মিল্ক ডাকট-এর মতো সমস্যায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোই কিন্তু তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার উপায়। বাচ্চা যতটা খায়, তার থেকে দুধ বেশি হলে এই সমস্যা দেখা দেয়। একে সারিয়ে না তুললে পরবর্তীতে ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এছাড়াও নিপলে হালকা ইনফেকশন হলে এতে বাচ্চার কোনও ক্ষতি হয় না, তবে আপনার একটু কষ্ট হবেই। ইনফেকশনের মাত্রা তীব্র হলে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান বা লাগান এবং বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান।
আসল সত্যিটা কী? বাচ্চা যে প্রত্যেকবার খাওয়ার সময় সমান খাবে বা একই সময় ধরে খাবে, এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। বাচ্চার যখন খিদে পাবে সে বেশি খাবে, যখন পাবে না সে খাবে না। একবার একদিকের ব্রেস্ট থেকে খেয়ে পরের বার অন্য দিক থেকে বাচ্চাকে খাওয়ান। কোনও অসুবিধে নেই। আর যদি বাচ্চা যে কোনও একদিকের ব্রেস্ট থেকেই খেতে স্বচ্ছন্দ হয়, তা হলে অন্যদিকে ব্রেস্ট-এর দুধ আপনি পাম্পের সাহায্যে বার করে দিন বা এক্সপ্রেস করে ফেলে দিন। (Myths and Facts about Breastfeeding)
আরও পড়ুন: কী কী কৌশলে সহজে ছাড়াবেন সোনার স্তন্যপানের অভ্যাস? দেখে নিন একনজরে!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null