ছোট্ট সোনা পৃথিবীর আলো দেখবেই। তাকে নিয়ে আসার আগেই জেনে নিন, গর্ভপাত আটকানোর উপায়গুলো!

ছোট্ট সোনা পৃথিবীর আলো দেখবেই। তাকে নিয়ে আসার আগেই জেনে নিন, গর্ভপাত আটকানোর উপায়গুলো!

ডাক্তারবাবুর রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর আজ আড়াই মাস কেটে গিয়েছে। আরও কিছু মাসের অপেক্ষার পর প্রিয়াঙ্কা আর রীতেশের জীবনে আসতে চলেছে তাদের ছোট্ট ভবিষ্যৎ। প্রথম মা হওয়ার দুর্দান্ত অনুভূতি প্রিয়াঙ্কা যেন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে। রীতেশ তো সুখবরটা পাওয়ার পর থেকে ওঁর যত্নে কোনও ত্রুটিই রাখছে না‌। প্রিয়াঙ্কার খাওয়াদাওয়া থেকে শোওয়া-বসা সবেতেই ওর কড়া নজর। (Signs, Symptoms, Treatment and Prevention of Miscarriage)

কিন্তু ভগবান সবার জীবনের গল্প একভাবে লেখেন না। প্রিয়াঙ্কা আর রীতেশের গল্পও তিনি হয়তো অন্যভাবে লিখেছিলেন। প্রিয়াঙ্কার গর্ভাবস্থার যখন ১২তম সপ্তাহ চলছে, হঠাৎই একদিন কোমর আর পিঠের দিকে প্রচন্ড ব্যথা (Miscarriage Keno Hoy) হতে লাগল। একই সঙ্গে পেটের পেশিতে টান, পিরিয়ডস্-এর সময় যেমনটা হয় তার থেকেও অনেক-অনেক বেশি। রীতেশ তখনই প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে ছুটল চিকিৎসকের কাছে। সেখানে পৌঁছতে না-পৌঁছতেই জানা গেল, প্রিয়াঙ্কার গর্ভপাত হয়ে গিয়েছে। ওদের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। চেম্বারের মধ্যেই কেঁদে ফেলল প্রিয়াঙ্কা।

এই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে প্রায় এক মাস। রীতেশ অনেক কষ্টে সত্যিটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা এই ধাক্কাটা এখনও সামলাতে পারেনি। ওর মনে অবসাদ চেপে বসেছে, এ জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং করাতে যেতে হয়। রাতের অন্ধকার নামলেই ছোট্ট বালিশ জড়িয়ে কাঁদতে থাকে প্রিয়াঙ্কা। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘোরে, কেন এমনটা হল ওর সঙ্গে (Miscarriage er Karon)? কোনও ভাবেই কি আটকানো যেত না এই দুর্ঘটনা?

এই প্রশ্ন শুধু প্রিয়াঙ্কার মনে এসেছে তা নয়। প্রিয়াঙ্কার মতো যাঁরা এমন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের মনেও একই প্রশ্ন বারবার এসেছে। বিশেষজ্ঞরা এই গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ (Miscarriage)-এর জন্য বেশ কিছু কারণের উল্লেখ করেন। কী কী সেগুলো, একে একে দেখে নেওয়া যাক। (Gorbhopater Lakkhon, Chikitsa o Kivabe Gorbhopat Atkaben)

 

 

মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের কিছু প্রচলিত কারণ (Common Causes of Miscarriage)

 

  • ক্রোমোজোমের সমস্যা: মানুষের দেহের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা নির্ভর করে ক্রোমোজোমের বিন্যাসের উপর। তাই ক্রোমোজোমের বিভাজন বা বিন্যাস ঠিক না হলে সমস্যা দেখা দেয় মানুষের দেহগঠনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্রুণগঠনের সময় ক্রোমোজোমের বিন্যাসে কোনও সমস্যা হলে ভ্রুণ ঠিক মতো বাড়তে পারে না। প্লাসেন্টার মধ্যে ভ্রুণের বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। আর তখনই গর্ভপাতের মতো দুর্ঘটনা ঘটে।

 

  • প্লাসেন্টার অস্বাভাবিক গঠন: জন্মের আগে পর্যন্ত প্লাসেন্টাই ভ্রুণের ঘর। তাই ঘর ঠিক মতো তৈরি হওয়া জরুরি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, মায়ের প্লাসেন্টা ভ্রুণের বেড়ে ওঠার জন্য সঠিক পরিবেশ দিতে পারছে না। সেক্ষেত্রে ভ্রুণের কিছুটা বৃদ্ধির পরেই গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

  • ডায়াবেটিস ও উচ্চ-রক্তচাপ: ডায়াবেটিস ও উচ্চ-রক্তচাপের মতো রোগও গর্ভপাতের জন্য দায়ী হতে পারে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা ইনসুলিনের জন্য যে ডায়াবেটিস হয়, তার কথাই বলে থাকেন। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস আর রক্তচাপের মতো ক্রনিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। তা না-হলে গর্ভপাতের আশঙ্কা অনেকটাই বেড়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

 

  • লাইফস্টাইল: প্রেগন্যান্সির সময় মায়ের জীবনযাত্রা বা লাইফস্টাইলের উপরেই নির্ভর করে ভ্রুণের স্বাস্থ্য। তাই মদ্যপান, ধূমপান— এসব গর্ভাবস্থায় একেবারেই বন্ধ থাকা উচিত। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এসবের ফলে গর্ভপাতের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। এমনকী সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিংয়ও গর্ভপাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।

গর্ভপাতের মতো দুর্ঘটনা কী কী কারণে ঘটতে পারে তা তো জানা গেল। কিন্তু কীভাবে বোঝা সম্ভব গর্ভপাতের আশঙ্কা রয়েছে? এমন প্রশ্নও শোনা যায় অনেক মায়ের মুখে। যদি কোনওভাবে তা আটকানো যায়, সেই আশায়। বিশেষজ্ঞরা গর্ভপাতের বেশ কিছু লক্ষণের কথা বলেন। এবারে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।

 

 

আরও পড়ুনঃ কৎবেল মানেই জিভে জল! গর্ভাবস্থায় খাওয়া কি নিরাপদ?

 

 

মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের লক্ষণ, সতর্ক হবে কখন (Signs and symptoms of miscarriage)

 

#1. পিঠে ব্যথা বা ব্যাক পেন: প্রেগন্যান্সির সময় প্রথম দু’-তিন মাসের মধ্যে ব্যাক পেন হলে তা গর্ভপাতের একটি অন্যতম লক্ষণ, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। এই ব্যথা সাধারণত পিরিয়ডস্-এর সময়ের ব্যাক পেনের থেকেও মাত্রায় অনেক বেশি হয়। তাই প্রেগন্যান্সির শুরুর দিকে প্রচন্ড ব্যাক পেন হলে বুঝতে হবে গতিক ভালো নয়।

 

#2. ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং বা রক্তক্ষরণ: বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থার সময় ২০-২৫ শতাংশ মায়েদের ক্ষেত্রে প্রথম ট্রাইমেস্টারে ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং বা যোনি থেকে অল্প পরিমাণে রক্তপাত হয়। কিন্তু এটি মোটেই নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারও ক্ষেত্রে যেমন এই রক্তপাত স্বাভাবিক, তেমনই কারও ক্ষেত্রে তা গর্ভপাতের লক্ষণও হতে পারে। এক্ষেত্রে রক্তের রং গোলাপি, বাদামি বা লাল হতে পারে। ব্লিডিংয়ের সময় অনেকের মাসল ক্র্যাম্পও হয়। তবে তার ব্যতিক্রমও রয়েছে।

 

#3. প্রচন্ড পেশির টান: অনেকেরই পিরিয়ডস-এর সময় পেটের পেশিতে টান ধরে। এতে তাঁরা প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এমনটা ঘন ঘন হলে তা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেগন্যান্সির প্রথম তিনমাসের মধ্যে ঘন ঘন এরকম পেশিতে টান ও মাসল ক্র্যাম্প বিপদের পূর্বাভাস। এই ব্যথা পিরিয়ডের ব্যথার থেকেও অনেক বেশি। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় পাঁচ-দশ মিনিট অন্তর এরকম প্রচন্ড ব্যথা (Miscarriage Pain) হতে থাকলে, এটি গর্ভপাতের লক্ষণ হতেও পারে।

 

#4. মাথা ঘোরা: প্রেগন্যান্সির সুখবর পেয়েছেন দু’-তিন মাস হল। তাকে পৃথিবীতে আনতে এখনও কয়েক মাসের অপেক্ষা। ইতিমধ্যে হঠাৎ করেই মাথা ঝিমঝিম করছে, মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরছে বলে মনে হচ্ছে। এমন লক্ষণ ভালো নয় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের কথায়, গর্ভপাতের প্রাথমিক চিহ্নগুলোর মধ্যে মাথা ঘোরা বা মাথা ঝিমঝিম করাও অন্যতম লক্ষণ।

 

#5. ওজন কমে যাওয়া: প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর সাধারণত মায়ের শরীরের ওজন একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বাড়তে থাকে। কিন্তু কোনও কারণে গর্ভপাতের মতো পরিস্থিতি যদি মায়ের শরীরে তৈরি হয়, তবে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে শরীরের ওজনে। এক্ষেত্রে মায়ের ওজন হঠাৎ করেই কমতে থাকে (Gorvopat er Karon, Lokkhon)। ওজনের কমতি গর্ভপাতের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।

 

 

গর্ভপাত কী কোনওভাবেই আটকানো সম্ভব নয়? এমন প্রশ্ন কত মায়ের বুকেই তো চাপা পড়ে থাকে‌। বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছেন‌। প্রেগন্যান্সির আগে ও প্রেগন্যান্সির সময় যদি কিছু নিয়ম মেনে চলা যায় তবে গর্ভপাত সহজেই আটকানো যায়। (Prevention of Miscarriage)

 

 

মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের আশঙ্কা প্রতিরোধের উপায় (Prevention of miscarriage)

 

  • ধূমপান, মদ্যপান বন্ধ: সন্তান বেড়ে উঠছে শরীরের ভিতর, আর কয়েকদিন পরেই মা হতে চলেছেন। এই অবস্থায় মদ্যপান বা ধূমপান একেবারেই চলবে না। এতে গর্ভপাতের দিকে গড়াতে পারে পরিস্থিতি। তাই অ্যালকোহল, সিগারেট এসবের থেকে নিজেকে সব সময় দূরে রাখুন। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিংয়েও গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। তাই বাড়িতে কেউ ধূমপান করলে, তাঁর থেকে দূরে থাকুন।

 

  • স্বাস্থ্যকর ডায়েট বাছুন: সন্তানের পরিকল্পনা যেদিন থেকে শুরু করছেন, সেদিন থেকেই পাল্টে ফেলুন নিজের ডায়েট। খাবারদাবার থেকে তেল-মশলা একেবারেই বাদ রাখুন। বরং ভিটামিন ও প্রোটিনজাতীয় খাবার বেশি করে রাখুন ডায়েটে। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নিতে পারেন।

 

  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন: গর্ভাবস্থার আগে ও গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। নয়তো গর্ভপাতের বিপদ ঘটতেই পারে। তাই ইনসুলিন বেসড ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে সন্তান পরিকল্পনার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে ডায়েটেও কিছু পরিবর্তন আনতে হতে পারে।

 

  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: ডায়াবেটিসের মতো ব্লাড প্রেশারও প্রেগন্যান্সির সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি। উত্ত রক্তচাপের ফলে বাড়তে পারে গর্ভপাতের আশঙ্কা। তা ছাড়াও এই উচ্চ রক্তচাপের কারণে গর্ভাবস্থায় নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রেও সন্তান পরিকল্পনার আগে ডাক্তরের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলে, কী করণীয় জেনে নিন।

 

  • গর্ভপাতের চিকিৎসা: গর্ভপাতের সময় বা এর পরে ইনফেকশন আর রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে। তাই ইনফেকশন আর ব্লিডিং আটকাতেই মূলত চিকিৎসার দরকার পড়ে। গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে গর্ভপাত হলে জরায়ু থেকে টিস্যু নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে গর্ভপাত হলে চিকিৎসক অপারেশনের মাধ্যমে প্লাসেন্টা থেকে টিস্যু বের করে দেন। পুরোটাই নির্ভর করে গর্ভপাতের সময় (Gorbher Sontan Nosto Howa) ভ্রুণের আকার কতটা, তার উপরেই।

 

বিশ্বের বেশকিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০-২৫ শতাংশ মায়েদের ক্ষেত্রেই গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক মা চান, তাঁর সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে। তাই সন্তান পরিকল্পনার আগে সব কিছুর পাশাপাশি চোখ রাখুন ,গর্ভপাতের বিভিন্ন দিকগুলোয়। আর এই প্রতিবেদনটি তো রইলই আপনার স্ক্রিনে।

 

আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় আনারস খাওয়া; কিছু সত্যি, কিছু রটনা

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null