মাসিকের সময় তলপেট, কোমরে যন্ত্রণার অবসান হবে এবার। রইল সহজ, ঘরোয়া টোটকা!

মাসিকের সময় তলপেট, কোমরে যন্ত্রণার অবসান হবে এবার। রইল সহজ, ঘরোয়া টোটকা!

কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে বা কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানের ফাইনাল তারিখ ঠিক করা হচ্ছে। সবার আগে, আমরা মেয়েরা তখন কী করি বলুন দেখি? কী পোশাক পরবো ভাবি, কতরকম পোজ দিয়ে সেলফি তুলবো ভাবি না কবে থেকে প্যাকিং করবো সেটা ভাবি? বলি উত্তরটা? এর মধ্যে একটাও নয়। আমরা কোন আনন্দদায়ক আগামী প্ল্যানিং-এর দিনক্ষণ শুনলেই চট করে মোবাইল ফোনের ক্যালেন্ডারটা খুলে একবার দেখে নিই যে, আমাদের ওই চারটে দিন ওই বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে পড়লো কি না? যদি দেখি, নাহ কোনও রকম সংঘাত হচ্ছে না, তখন ডিগবাজি খেয়ে নাচতে বাকি থাকে। আর যদি দেখি, ওই চারদিনের মধ্যেই পড়ে গেছে বেড়াতে যাওয়ার বা অনুষ্ঠানের দিনটি, অমনি ভিতর ভিতর কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে যায়। তাই তো? (Painful menstruation: Causes, Symptoms and Diagnosis in Bangla. Period pain-er sohoj somadhan. Menstrual cramps in Bangla)
বুঝতেই পেরেছেন আমরা মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে কথা বলছি। বাজারে যতই উন্নতমানের আরামদায়ক স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যাক না কেন, সে শুধু সুরক্ষাই দিতে পারে, স্বস্তি দিতে পারে না। মাসিকের সময় তলপেটে ও কোমরে ব্যথা, গা ম্যাজম্যাজ ভাব, মাথা ধরা বা পায়ের পেশীতে টান এইসব বিরক্তিকর উপসর্গ কম বেশি সব মেয়েরই হয়ে থাকে। সারাদিন ধরে এই চিনচিনে ব্যথা আর অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুরতে হয় আমাদের। ধন্যি মেয়েদের সহ্যশক্তি! মাসিকের সময় কেন এবং কীভাবে হয় এই ব্যথা-বেদনার আগমন, কিছু ঘরোয়া টোটকায় চটজলদি আরাম পাবেন কীভাবে, দেখে নিন এক নজরে।

পিরিয়ড হওয়ার সময় ব্যথা কেন হয়? (Causes of painful menstruation)

মেয়েদের মাসিকের সময় জরায়ুগাত্র থেকে রক্ত ভরা নরম পর্দা নষ্ট হয়ে যাওয়া ওভামকে নিয়ে যোনিপথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই পর্দা ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসার সময় জরায়ু পেশীতে টান পড়ে বা ঘষা লাগে। এই কারণেই মাসিকের সময় তলপেটে পেশীতে টান ধরার অনুভূতি হয় বা কোমরেও ব্যথা হয়। বেশির ভাগ মহিলাদের এই ব্যথা তলপেটেই হয়ে থাকে। তবে, অনেকেরই কোমরে, হাঁটু বা থাইতেও ব্যথা হয়। সাধারণত, প্রত্যেক মাসে মাসিক শুরু হওয়ার ১-২ দিন আগে থেকে ব্যথা শুরু হয় এবং মাসিক শুরু হওয়ার ২ দিন পর আস্তে আস্তে কমে যায়। ব্যক্তিবিশেষে, এই ব্যথার ধরন বা প্রাবল্য কম বেশি হয়ে থাকে।

আরও পড়ুনপ্রসবের পরে কীভাবে জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন!

কয় ধরনের পিরিয়ডের ব্যথা হয়? (Types of menstrual pain)

ডাক্তারি ভাষায় মাসিকের এই ব্যথার নাম ডিসমেনোরিয়া (dysmenorrhea)

  • প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়া: মাসিকের সাথে জড়িত শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের কারণে এই ব্যথা হয়। মাসিকের সময় বেশি কাজ করলে, খুব দুশ্চিন্তা করলে বা মহিলা একটু রুগ্ন হলে এই ব্যথা বেশি হতে পারে।
  • সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া: মাসিকের প্রধান কারণ ছাড়া অন্য কোনও অসুস্থতার কারণে যদি মাসিকের সময় ব্যথা হয়। ব্যথার ধরন এবং প্রাবল্য এই ক্ষেত্রে আলাদা হয়।

সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়ার কারণ?( Causes of secondary dysmenorrhea)

  • মহিলার জন্মগত কোনও ত্রুটি থাকলে।
  • জরায়ুতে টিউমার বা সিস্ট থাকলে।
  • জরায়ুতে ফাইব্রয়েডস থাকলে।
  • Pelvic inflammatory disease হলে।
  • সারভিক্স খুব ছোট হলে ব্লাড ঠিক পরিমাণে বেরোতে পারে না ও ভিতরে চাপ সৃষ্টি হয়। এর থেকেও ব্যথা হয়।

মাসিকের ব্যথা হওয়ার আরও কিছু কারণ (Some more reasons of menstrual cramps)

  • যেসব মেয়েদের নির্দিষ্ট বয়সের আগেই মাসিক শুরু হয়েছে, তাদের ব্যথা বেশি হয়।
  • পরিবারের নিকটাত্মীয়ের যদি এইরকম ব্যথা হয়ে থাকে।
  • মাসিকের সময় বেশ ভালো রকম ব্লিডিং হয়।
  • মাসিক অনিয়মিত হলে।
  • ব্লিডিং-এর মধ্যে ব্লাড ক্লট বা জমাট রক্ত বেশি থাকলে।
  • যারা ধূমপান করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যথা বেশি হয়।
  • যারা এখনও মা হননি, তাদেরও ব্যথা বেশি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে বাচ্চা হওয়ার পর সাধারণত ব্যথা কমে যায়।
  • এছাড়াও কিছু মেয়েদের ক্ষেত্রে সঠিক কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

পিরিয়ডের সময় তলপেটে ব্যথা ছাড়া আর কী কী অসুবিধা হয়? (Symptoms other than abdominal pain)

প্রত্যেক মহিলার ক্ষেত্রে এই অসুবিধাগুলি আলাদা আলাদা হতে পারে, আমরা সাধারণভাবে কিছু পয়েন্ট করার চেষ্টা করলাম।

  • কোমরে, পিঠে, পায়ে ব্যথা।
  • ব্রেস্ট স্পর্শকাতর ও ভারী হয়ে যায়।
  • গা বমি ভাব।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • লুজ মোশন।
  • মাথা ব্যথা।
  • গা ম্যাজম্যাজ করা।
  • মাথা ঘোরা।

‘ট্যাবলেট’ ছাড়াই মাসিকের ব্যথা দূর করার ৮ উপায়/ Menstrual Cramps Home Remedies for Natural Relief

যেসব ঘরোয়া টোটকায় আরাম দেবে (Home remedies to soothe menstrual cramps)

#1. গরম সেঁক (Applying Heat)

বাড়িতে হট ওয়াটার ব্যাগ থাকলে ওতে গরম জল ভরে পেটে, কোমরে বা আর যেখানে ব্যথা হচ্ছে সেসব জায়গায় কিছুক্ষণ সেঁক দিন। অনেকটাই আরাম পাবেন। খুব বেশি গরম জল নেওয়ার দরকার নেই। সেঁক যেন আরামদায়ক হয়। বাড়িতে হট ওয়াটার ব্যাগ না থাকলে, টম্যাটো সসের খালি কাঁচের বোতলেও জল ভরে সেঁক নিতে পারেন। বা একটা তোয়ালে চার ভাঁজ করে নিন, এবার সেটা ইস্ত্রির গরমে চেপে চেপে গরম করে নিন এবং সেঁক নিন। তবে সাবধান, হট ওয়াটার ব্যাগের মুখ বা বোতলের ছিপি যেন আলগা রাখবেন না। আসতে পারে বিপদ।

#2. মেথি (Try Fenugreek)

এক চা-চামচ মেথি নিয়ে সেটা ভালো করে ধুয়ে নিন এবং কচমচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলুন। শুধু পেটে ব্যথা কেনো, মাথা ব্যথা, গা ম্যাজম্যাজানি অনেক কমে যাবে।

#3. পুদিনা পাতা (Try Mint Leaves)

কয়েকটি তাজা পুদিনা পাতা নিয়ে হামান দিস্তায় থেঁতো করে নিন। এবার সেটা চিপে এক চা-চামচ মতো রস বের করুন। ওই পুদিনার রসের সাথে সমপরিমাণ অলিভ অয়েল মিশিয়ে যেখানে যেখানে পেশী টানছে বা ব্যথা হচ্ছে, সেখানে আলতো হাতে ম্যাসাজ করুন।ব্যথা কমে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এছাড়া যদি গা বমি ভাব হয় বা মাথা ধরে থাকে; তা হলে দু-তিনটে পুদিনা পাতা নিয়ে আঙুলে কচলে নিয়ে নাকের কাছে ধরুন ও নিশ্বাস নিন। মাথা ধরা ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।

#4. আদা (Go for Ginger)

বানিয়ে ফেলুন আদা চা। একটা সসপ্যানে জল ফুটতে দিন। জল ফুটে এলে তাতে কিছুটা গ্রেট করা আদা দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ফোটান। এরপর গ্যাস বন্ধ করে এর মধ্যে মধু আর লেবুর রস মিশিয়ে খান। দিনে একাধিকবার খেতে পারেন এই আদা চা।

আরও পড়ুনগোড়াতেই নির্মূল করা সম্ভব স্তন ক্যান্সার!

#5. তুলসী (Basil Leaves)

এক কাপ ঈষদুষ্ণ জলে ২-৩ চা চামচ তুলসী পাতার রস মিশিয়ে খেয়ে নিন। ব্যথা অনেকটাই কমবে কিন্তু।

#6. দারচিনি (Try Cinnamon)

খেতে পারেন দারচিনি চা। গরম জলে মধু আর দারচিনি গুঁড়ো মিশিয়ে চায়ের মতো খান।

#7. বিশেষ ভাবে স্নান (Baths Soothe Pain)

যাদের বাড়িতে বাথ টাব আছে, এই টোটকা তাদের জন্য। বাথ টাবে আরামদায়ক উষ্ণতায় গরম জল ভরে নিন এবং পিঠ পর্যন্ত ডুবিয়ে ৪-৫ মিনিট বসে থাকুন। এরপর, বাথ টাবে ঠান্ডা জল ভরে নিন এবং ওইভাবেই ৪-৫ মিনিট বসুন।এরকম কিছুক্ষণ করুন।

#8. বিশেষ ভাবে বিশ্রাম (Practice Good Sleep Hygiene)

আরামদায়ক ভাবে শোওয়ার চেষ্টা করুন। যেভাবে শুলে আরাম লাগছে বা ব্যথা কম লাগছে, সেরকম ভাবেই রাতে শোবেন। তলপেটে ব্যথা হলে একদিকে কাত হয়ে হাঁটু ভাঁজ করে শুলে ব্যথা একটু কম লাগে। এছাড়াও চিত হয়ে শোওয়ার সময় পায়ের নীচে দুটো বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিন।খুবই আরাম পাবেন।

সতর্ক থাকুন এই বিষয়গুলি নিয়ে (Things to keep in mind):

  • এই সময় ভিটামিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও মিনারেলস সমৃদ্ধ খাবার খান।
  • প্রচুর পরিমাণে জল খান।
  • খাবারে অতিরিক্ত নুন, চিনি খাবেন না।
  • বেশি ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় খাবেন না।
  • অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকুন।
  • ধূমপান করবেন না।
  • টক জাতীয় আচার এসময় না খাওয়াই ভালো।
  • ব্যথা কমাতে পেন কিলার খাবেন না।
  • ইনফেকশন এড়াতে ৬ ঘণ্টা পরপর স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলে ফেলুন।
  • মাসিক অনিয়মিত হলে, প্রচণ্ড ব্লিডিং-এর ফলে মাথা ঘুরলে বা ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।
  • নিজে কোনও শারীরিক অসুবিধা টের পেলে চেপে না রেখে ডাক্তারকে বলুন। লজ্জা করলে কিন্তু কষ্ট বাড়বে আপনারই।

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null