আপনার ছোট্ট সন্তানটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। আপনারাও ওর সাথেই বড় হচ্ছেন, মা-বাবা হিসেবে। বাচ্চা শিখছে ‘কীভাবে মানুষ হতে হয়’ আর আপনারা শিখছেন ‘কীভাবে মানুষ করতে হয়’। দু’পক্ষের শিক্ষাই কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং একে ওপরের পরিপূরক। এর ওপরেই অনেকাংশে নির্ভর করে বাচ্চার ভবিষ্যৎ ও বাচ্চার সাথে মা-বাবার সম্পর্কের রসায়ন। (Mentally Strong Kids Have Parents Who Do These Things)
যাকগে, ভণিতা না করে আসল কথায় আসি। প্রায় দিনই আমরা কথা বলি, বাচ্চা কী খাবে? বাড়ন্ত শরীর কীভাবে পুষ্টি পাবে বা বাচ্চার শরীর খারাপ হলে কী হবে এসব নিয়েই! ওর মনটা নিয়ে সেভাবে আর ভাবা হল কই বলুন তো! এখানেই মস্ত বড় ভুল করে ফেলি আমরা।
বাচ্চার শরীরের ওপর সবসময় সজাগ দৃষ্টি আমাদের, কিন্তু ওই কচি মনটাকেও যে বড় করে তুলতে হবে, বাইরের পৃথিবীতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো উপযোগী করে তুলতে হবে, এটা প্রায় সময়েই আমাদের মাথায় আসে না। একেক বাচ্চার প্রকৃতি একেকরকম। কেউ হয়তো ডাকাবুকো আবার কেউ হয়তো ভীষণ ভীতু। কেউ হয়তো খুব মিশুকে আবার কেউ মায়ের আঁচলের তলা খুঁজে বেড়ায়।
বাচ্চা শান্ত হোক বা দুরন্ত, রাগী হোক বা জেদি, তাকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্ব কিন্তু বাবা মায়ের ওপরই বর্তায়। বাড়িতে সবার আদরের মাঝে তো বড়জোর ৩ টে বছর, তারপরেই যে শুরু করতে হবে বাইরের জগতে খাপ খাওয়ানোর লড়াই। স্কুলে যাওয়া থেকেই শুরু হবে নানা প্রতিযোগিতা, চলার রাস্তা মসৃণ হবে না অনেক ক্ষেত্রেই এবং বাইরের পরিবেশে নিজের সেরাটা দিয়ে দাপট দেখিয়ে টিকে থাকতে হবে ওই পুঁচকেকে। আর এর জন্য ওকে হবে দৃঢ় মনের একজন মানুষ, বিদেশী ভাষায় যাকে “মেনটালি স্ট্রং” বলা হয়।
ভেবেছিলেন আগে এগুলো? হয়তো হ্যাঁ বা হয়তো না। উত্তর যাই হোক, বাচ্চার মন মানুষ করার তোড়জোড় শুরু করুন আজ থেকেই (How to Make Your Child Mentally Strong)।
বাচ্চার বয়স ১ বছর হয়ে গেলেই শুধু ওর শরীর নয়, পুরোমাত্রায় লক্ষ্য রাখুন ওর মনের ওপর। বয়স ও অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ওর মনের পরিপক্কতাও বাড়বে বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তৈরি হবে জানি, কিন্তু কীভাবে যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয় বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানতে হয়, তার হদিস দেখিয়ে দিতে পারেন আপনিই!
#1. বাচ্চাকে ভুল করতে দিন: বাচ্চা যখন নিজে নিজে স্কুলব্যাগ গোছানোর মতো বড় হয়ে যাবে, পরপর বেশ কয়েকদিন নিজে ওকে শিখিয়ে দিন সামনে থেকে। বাচ্চা ব্যাগ গোছাতে গিয়ে কিছু ঢোকাতে ভুলে গেলে ওকে মনে করিয়ে দিন। একটা মাস নজরে রাখুন।
তারপর যদি দেখেন, বাচ্চা তাড়াহুড়ো করে পেন্সিল ফেলে চলে যাচ্ছে, ওকে আর মনে করাবেন না। কী হবে? স্কুলে পেন্সিল না নিয়ে গেলে বড়জোর সামান্য ধমক খাবে মিসের কাছে বা বন্ধুর কাছে চাইবে, আর তো কিছু না! এরকম কিছুদিন হলেই, বাচ্চা লিখতে গিয়ে অসুবিধায় পড়লেই দেখবেন ঠিক আগামী দিনে পেন্সিল নিতে আর ভুলছে না। গোছালো স্বভাবের গুরুত্ব যে কতখানি, বুঝতে দিন বাচ্চাকে। নিজের জিনিস যে নিজেকেই সামলে রাখতে হবে সেটা ওর ছোট্ট মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া শুরু করুন।
#2. শাসন ভালো, মানসিক অত্যাচার নয়: ক্লাসটেস্টে নম্বর কম হোক বা ক্লাসে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে না থাকুক, সেটা নিয়ে ওর মনে ভয় ঢোকাবেন না। মনে রাখবেন, নম্বর দিয়ে কিন্তু সবসময় প্রতিভা বা মানুষ যাচাই করা যায় না।
পড়াশোনায় মন না দিলে বাচ্চাকে শাসন করুন, লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝান। কিন্তু খেতে না দেওয়া, কথা বন্ধ করে দেওয়া বা অন্ধকারে বন্ধ করে দেওয়ার মতো কাজ করবেন না। বাচ্চার মানসিক জোর বাড়ানোর চেষ্টা করুন। “ অঙ্ক তোকে পারতেই হবে” এটা না বলে “আয় আমরা একসাথে অঙ্ক করি” এভাবে বলুন! এতে বাচ্চার মনে অঙ্ক নিয়ে কোনও ভীতি থাকলে সেটাও চলে যাবে আবার আপনার সাথে সম্পর্কটাও আদুরে হবে।
#3. আদর ভালো, আদিখ্যেতা নয়: এখন অনেকেরই ছোট্ট পরিবারে একটিই সন্তান, তাদের আদরের ধন। কিন্তু একটি সন্তান বলে বাচ্চাকে আদর দিয়ে বাঁদর বানাবেন না। শুনতে কড়া লাগছে হয়তো, কিন্তু বাবা-মায়ের অত্যধিক আদরেই বাচ্চা নিজের পায়ের তলায় শক্ত মাটি বানাতে পারে না।
যেমন, বিয়েবাড়ির ভিড়ে বাচ্চার গরম লাগছে? লাগুক! ওর জন্য আলাদা এয়ার কনডিশনড রুম খুঁজবেন না। বাকি আর ৫ টা বাচ্চাও ওরই বয়সি এবং ওদেরও গরম লাগছে। সেটা বোঝান বাচ্চাকে। জীবনে চলার রাস্তায় অনেক গরম সহ্য করতে হবে, অনেক ঘাম ঝরাতে হবে। তাই “যখন যেমন, তখন তেমন” এই মন্ত্রটাই ওর কানে ঢুকিয়ে দিন।
#4. সাথে থাকুন, আগলে রাখবেন না: বাচ্চার পিছনে থাকুন দেওয়াল হয়ে, সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে যাবেন না। বাচ্চাকে ছোট থেকে বোঝান যে, আপনি ওর সাথে সবসময় আছেন, কীভাবে এগোতে হবে আপনি দেখিয়ে দেবেন কিন্তু এগোতে ওকে নিজেকেই হবে। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বললে মনে হয় সহজ হবে,
আরও পড়ুন: ছোট থেকেই শুরু হোক নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা, জেনে নিন কৌশল
#5. বাচ্চার মতামতকে সম্মান করুন: বাচ্চা মানুষ, বোধবুদ্ধি খুব কম। হয়তো কোনও সমস্যার মারাত্মক হাস্যকর সমাধান দিল। তাতে হাসি পেলেও হাসবেন না। বরং ওর কাছে জানতে চান যে কেন ওর এমন মনে হল। এটাও বলুন আপনি কী ভাবছেন। যেসব আলোচনায় বাচ্চাকে সামিল করতে পারেন, সেইসব আলোচনা ওর সামনে করুন এবং ওকেও অংশ নিতে দিন।
বাচ্চা কীভাবে ভাবছে সেটাও বুঝবেন আবার আপনার কথা শুনে বাচ্চা পরবর্তীতে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
#6. দায়িত্ব দিন ওকেও: বাচ্চা বলে ও একেবারেই দুধ-ভাত নয়। কাজ, দায়িত্ব দিন ওকেও। বাচ্চাকে যদি কোনও দায়িত্ব দেন, তা হলে বাচ্চা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং আনন্দের সাথে সেটা করতে যায়। ছোটখাটো কাজের মধ্যেই হয়তো সে শিখে যাবে অনেক কিছু। আবার উদাহরণ দিয়ে বলি?
#7. বাস্তবের পরিচয় দিন গল্পের ছলে: বাচ্চা বয়সেই ওর মাথায় হাজার চিন্তা ঢোকাতে বলছি না আমরা, কিন্তু আঁচ দিতে ক্ষতি নেই। বাবা-মাকে বাইরের পরিবেশে কতকিছুর মোকাবিলা করতে হয়, বাবার বসও যে বাবার কাছে কৈফিয়ত চান বা মা হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও রাতের খাবারটা নিজের হাতে বানান, এগুলো বাচ্চাকেও বোঝান। বাচ্চা এতে দরদি হবে, বাবা-মাকে বুঝতে শিখবে, সহমর্মী হবে আবার নিজের মনেও বাস্তবের একটা ধারণা ছকে নেবে। (Happier Parents do These Things)
বাচ্চাকে নানা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যান, নানা ধরনের মানুষ, তাদের জীবিকা, বেঁচে থাকার পদ্ধতি, বাঁচার জন্য তারা কত লড়াই করে সেসব সোজা ভাষায় গল্পের ছলে বোঝান। বাচ্চাকে মানবিক ও বাস্তববাদী করে তুলুন ছোট থেকেই।
#8. আপনার কথাই শেষ কথা: সবকিছু “কেন”, “কী জন্য”-র কৈফিয়ত দেবেন না বাচ্চাকে। কিছু ক্ষেত্রে আপনার সিদ্ধান্তই যে শেষ কথা এটা বুঝিয়ে দিন ওকে। সবসময় বাচ্চার মনমতো সবকিছু হবে এমন কোনও কথা নেই। নিজের সিদ্ধান্তের ওপর যে আপনার আস্থা আছে এবং আপনি নিজের ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস করেন, এটা বাচ্চাকে বুঝিয়ে দিন।
#9. প্রচেষ্টার প্রশংসা করুন, পুরষ্কারের নয়: আপনার সন্তান হয়তো অনেক পুরষ্কার পেতে পারে, আবার হয়তো কিছুই পেল না। পুরষ্কার পেলে সুনাম করুন, তবে একবারই। সবার সামনে প্রশংসা করুন ওর চেষ্টার বা অধ্যবসায়ের। বাচ্চা যদি কোনও প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার নাও পায়, তার চেষ্টার সুনাম করুন। এটাই ওকে ভবিষ্যতে আরও ভালো চেষ্টা করতে সাহায্য করবে।
#10. বাড়িতে রুটিন মেনে চলুন: ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলাবোধ কিন্তু জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে প্রয়োজন। বাচ্চা ছোট থাকতে থাকতেই তাই ওর মধ্যে পুঁতে দিন সহবত শিক্ষার বীজ। এছাড়াও বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বাড়িতে মেনে চলুন কিছু নিয়ম; যেমন,
বাচ্চাবেলা থেকে এভাবেই ছোট্ট ছোট্ট নিয়ম মেনে চললে ভবিষ্যতে সন্তানের ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারবেন। তখন না হয় নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে নেবেন খানিক! (Mentally Strong Kids Have Parents Who Do These Things)
আরও পড়ুন: না বকে, না মেরে কীভাবে মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখবেন বাচ্চাকে? সহজ উপায় থাকল এখানে!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null