সবে এক মাস হল, হামা দিতে শিখেছে ছোট্ট গুড্ডুসোনা। দুপুরবেলা তাকে ঘুম পাড়িয়ে খাটের চারদিকে বালিশ দিয়ে খেতে গিয়েছে সমৃদ্ধা। হঠাৎ দুম করে একটা আওয়াজ। পড়িমরি করে ছেলের ঘরে ছুটে গিয়ে সমৃদ্ধা দেখে, গুড্ডু মেঝেতে বসে আছে। কেমন একটা হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। ও যে খাট থেকে নীচে পড়ে গেছে, ব্যথা পেয়েছে সেসব কিছুই যেন বুঝতে পারছে না! সমৃদ্ধা হাউমাউ করে চেঁচিয়ে এসে কোলে নিতেই তুমুল চিৎকার করে কান্না শুরু। কাঁদতে কাঁদতে দু-তিনবার বমিও করে ফেললো ছোট্ট শরীরটা। এর মধ্যেই সমৃদ্ধা গায়ে-পায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেখে নিয়েছে, কোথাও কিছু কাটাকুটি হয়নি। শুধু, মাথার সামনেটা একটু ফুলে উঠেছে। অনেকক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরিয়ে, মাথায় বরফ দিয়ে তবে শান্ত হল ছেলে। সমৃদ্ধাও ভাবলো, “সামান্য মাথা ফুলে গেছে, দু’দিনেই সেরে যাবে; যাক বাবা, খাট থেকে পড়ে বড় কিছু হয়নি”।
পরদিন সকালে গুড্ডু ঘুম থেকে যেন উঠতেই চাইছে না। যদিও বা উঠলো, বসতে গেলেই কেমন গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে।কু ডেকে উঠলো সমৃদ্ধার মাতৃসত্ত্বা। আর দেরি না করে ছুটে গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সবকিছু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে গুড্ডুকে পরীক্ষা করে জানালেন ‘ইন্টারনাল হেড ইনজুরি’ হয়েছে ওর। সমৃদ্ধার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। পরিচিত ডাক্তার এক ধমক দিলেন ওকে, গুড্ডু পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে কেন নিয়ে আসেনি ডাক্তারের কাছে! সমৃদ্ধা তখন জানায় যে, গুড্ডুর যে এত বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে সে বুঝতেই পারেনি বাইরে থেকে। ডাক্তার একটাই কথা বললেন, “পড়ে যাওয়ার পরে ও কি বমি করেছিলো?” উত্তরটা আমরা সবাই জানি। আর এখানেই সমৃদ্ধা অজান্তে ভুলটা করে ফেলেছিলো! (Kid’s symptoms you should never ignore in Bangla, sishur bipod kokhon, nobojayok sishur bipod chinho.Kid’s Symptoms You Should Never Ignore in Bengali.)
বাচ্চাদের শরীর আমাদের থেকে অনেক নরম আর তাই আঘাত পাওয়ার আশঙ্কাও অনেকটাই বেশি। বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয় বলে, ওদের ওপর রোগ-অসুখের হামলাও বেশি হয়। আর এদিক ওদিক পড়ে যাওয়া, উল্টে গিয়ে চোট পাওয়া তো বাড়ন্ত বাচ্চাদের মধ্যে খুবই সাধারণ। সময়বিশেষে যদি বাচ্চার শরীরের কোনও অস্বাভাবিক লক্ষণ আপনি এড়িয়ে যান, তা কিন্তু বাচ্চার ভবিষ্যৎ ছারখার করে দিতে পারে। ডেকে আনতে পারে অকালমৃত্যুও। শরীর খারাপ বা পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া, কোনওটাই আপনি আটকাতে পারবেন না। বাবা-মা হিসেবে যা করতে হবে, তা হল পর্যবেক্ষণ। কোন কোন উপসর্গ দেখলে বাচ্চাকে সত্বর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে বা বাচ্চার শরীরে কী ধরনের অস্বাভাবিকতা বিপজ্জনক; এই নিয়েই আমাদের আজকের প্রতিবেদন। বাচ্চার সুরক্ষার খাতিরে পড়ে দেখুন, জেনে রাখুন এবং সতর্ক থাকুন।
#1. পড়ে গিয়ে বমি করা-> বাচ্চাদের মধ্যে একটু করে বমি করা/দই তোলা যতটা সাধারণ, তেমনই সাধারণ ধুপধাপ পড়ে গিয়ে চোট পাওয়া। তবে বাচ্চা কোনও ভাবে বেকায়দায় পড়ে যাওয়ার পর যদি বমি করে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান। পড়ে গিয়ে কিছু বুঝতে না পারা, একটু হলেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলা বা বমি; যাই হোক, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। পড়ে গিয়ে মাথার ভিতরে আঘাত পেলে বা ইন্টারনাল হেড ইনজুরি হলে বাচ্চা বমি করতে পারে। বাচ্চা যদি মাথায় ভর দিয়ে পড়ে যায়, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা বিশেষ সতর্ক থাকুন।
#2. ওজন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া-> বাচ্চা খাচ্ছে না আর বাচ্চার ওজন বাড়ছে না, এই কথাগুলো যেন মায়েদের মুখে মুখে ঘোরে। জানেন তো, কোনও কিছুই বেশি ভালো নয়। স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করার পরেও যদি বাচ্চার ওজন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়, তা হতে পারে হাইপোথাইরয়ডিসম, কাশিং সিন্ড্রোম, অ্যাক্রোমেগালি বা ইডিমার মতো অসুস্থতার কারণেও।
#3. হঠাৎ মুখ ফুলে যাওয়া-> বাচ্চার মুখ হঠাৎ ফুলে গেলে, বিশেষ করে চোখ, ঠোঁটের চারপাশ, পায়ের পাতা যদি ফুলে যায়, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা সারা শরীর চুলকোতে থাকে, তা হলে এলারজি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এর পোশাকি নাম অ্যানাফাইলাক্সিস (anaphylaxis)। কোনও খাবার বা কোনও কিছুর স্পর্শ থেকেও এই ধরনের এলারজি হতে পারে। যেমন, অনেকের চিনাবাদামে এলারজি হয় আবার অনেকের চিংড়ি মাছে। পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখুন তার পুরুষাঙ্গের আকারেও। অনেক সময়ই, খাবার থেকে হওয়া এলারজি পুরুষাঙ্গেও থাবা বসায়।
#4. ঘন ঘন জল খাওয়া ও বাথরুম যাওয়া-> বেশি জল খাওয়া অবশ্যই ভালো, অস্বাভাবিক ভাবে খাওয়া ভালো না। বাচ্চা যদি ঘন ঘন জল খায়, সবসময় তৃষ্ণার্ত থাকে এবং বারবার প্রস্রাব করে, তা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডায়াবেটিসের খপ্পরে পড়লে এমনটা হয়ে থাকে।
#5. শ্বাস নিতে কষ্ট-> বাচ্চা যদি নিশ্বাস নেওয়ার সময় সাঁই-সাঁই আওয়াজ করে, পেট দ্রুত ওঠানামা করে, তা হতে পারে অ্যাজমার পূর্বলক্ষণ। আবার খুব ঠান্ডা লাগার সাথে যদি এরকম শ্বাসকষ্ট হয় এবং ঠোঁটে নীলভাব আসে, তা হলে বাচ্চা সম্ভবত ব্রঙ্কিওলাইটিসে (bronchiolitis) আক্রান্ত হয়েছে।
#6. মাথাব্যথা ও খুব জ্বর-> বাচ্চাদের জ্বর-জারি হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। এতে সেরকম কিছু উদ্বেগের কারণও নেই। কিন্তু বাচ্চার জ্বর যদি অনেকদিন থাকে বা বেশ ভালোমতো জ্বর উঠে যাচ্ছে। সাথে ফাউ হিসেবে আছে তীব্র মাথাব্যথা। তবে তা হতে পারে মেনিনজাইটিসের (meningitis)সিগন্যাল।
#7. ওজন কমতে শুরু করা-> অস্বাভাবিক ভাবে ওজন কমে গেলেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ওজন কমার সাথে সাথে বাচ্চা যদি প্রাণবন্ত না থাকে বা ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে চোখ-মুখ; তা হলে শীঘ্র ডাক্তারি পরামর্শ নিন।
#8. ইউরিন করার সময় জ্বালা ও ব্যথা-> প্রস্রাব করার সময় যদি বাচ্চার তলপেটে ব্যথা হয় ও মূত্রদ্বারে জ্বালা করে, তা হলে ও ইউরিন ইনফেকশনের শিকার হতে পারে। ইউরিন ইনফেকশনের যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয়, তা হলে বিগড়ে যেতে পারে কিডনির কার্যকলাপও।
#9. গোলাকার র্যাশ-> বাচ্চার গায়ে যে কোনও জায়গায় যদি অস্বাভাবিক কোনও র্যাশ বা প্রদাহ দেখা দেয়, তবে সতর্ক হোন। স্কিনের তলায় গোল হয়ে ছোট ছোট অনেকগুলো লাল ডট একজায়গায় হয়ে আছে, আপনি হাত দিয়ে চাপ দিলেও মিলিয়ে যাচ্ছে না। বা ধরুন, স্কিনের তলায় কোনও জায়গায় রঙের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। বাচ্চার স্কিনের তলায় যদি সামান্যতমও স্কিন ডিসকালারেশন বা রঙের পার্থক্য চোখে পড়ে, ডাক্তারের পরামর্শ নিন। স্কিনের তলায় গজিয়ে ওঠা অস্বাভাবিক র্যাশ বেশিরভাগ সময়ই রক্তের অস্বাভাবিকতা বা ব্লাড ডিসঅর্ডার (blood disorder), কোনও চর্মরোগ বা এলারজির প্রাথমিক লক্ষণ হয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ বাচ্চার ভাইরাল ইনফেকশনে যত্ন নেবেন কীভাবে?
#10. কেটে গিয়ে রক্ত বন্ধ না হওয়া->পরিষ্কার কাপড় চেপে ধরে বা চিনি চেপে ধরে, ইত্যাদি ঘরোয়া টোটকায় যদি ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ না হয়, তা হলে ডাক্তারের কাছে যান। একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে ক্ষতের গুরুত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত নিন। বাচ্চার ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার আশংকা বেশি থাকে, তাই ওদের চিকিৎসায় বিশেষ যত্নশীল হতে হয়। টুকটাক ফার্স্ট এড শিখে রাখা খুবই ভালো, তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন।
#11. খুব ক্লান্ত থাকা-> বাচ্চা খুব ক্লান্ত থাকছে, চনমনে থাকছে না বা খেলতেও চাইছে না। এতে ওকে ধমক না দিয়ে ভিতরের কারণটা বোঝার চেষ্টা করুন। বাচ্চার জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম অবশ্যই দরকার। কিন্তু তা যেন অস্বাভাবিক না হয়। সর্বক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব, নেতিয়ে থাকা বা প্রচণ্ড ক্লান্তি কিন্তু রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
#12. স্কুল যেতে অনীহা-> বাচ্চা পড়তে পারছে না বা পড়তে চাইছে না, এই সমস্যা সব বাবা-মায়ের থাকে। কিন্তু সবসময় সেটা দুষ্টুমি ভেবে ভুল করবেন না। বাচ্চার পড়তে অসুবিধে হচ্ছে বা ও চেয়েও পড়তে পারছে না সেটাও তো হতে পারে। আর স্কুলে নিয়মিত বকা খেয়ে তৈরি হয়েছে ডিপ্রেশন। বাচ্চার যদি পড়তে অসুবিধা হয়, তা হলে চোখের পাওয়ার চেক করিয়ে নিন। পড়াশোনা সংক্রান্ত বা অক্ষর চিনতে যদি বাচ্চার বিশেষ অসুবিধা হয়, তা হলে চিকিৎসাই ওকে সাহায্য করতে পারে। আবার রোগ কি শুধু শরীরেই হয়? মনে হয় না বুঝি! স্কুলে যেতে না চাইলে, তার সঠিক কারণ বোঝার ও জানার চেষ্টা করুন। হতে পারে, স্কুলে এমন কিছু ঘটনায় ও বিব্রত, যার ফলস্বরূপ কচি মনে থাবা বসাচ্ছে ভয় ও ডিপ্রেশন।
#13. অস্বাভাবিক আঁচিল গজানো-> বাচ্চার গায়ে যদি কোনও আঁচিল গজিয়ে ওঠে এবং তার চারপাশে লাল হয়ে যায়, ফুলে যায়, তবে তা ফেলে রাখবেন না। একই কথা বলবো, জন্মদাগ ও জন্ম-আঁচিল নিয়েও। বাচ্চার গায়ে যদি জন্ম থেকেই কোনও আঁচিল বা দাগ থাকে, বাচ্চার জ্ঞান-বুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত আপনিই তাতে নজর রাখুন। আঁচিল যদি বেড়ে যায় বা তার পাশে আরও আঁচিল গজায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।
#14. ডানদিকে পেটে ব্যথা-> বাচ্চা যদি বলে তার তলপেটে ডানদিকে ব্যথা হচ্ছে, একটু নজরে রাখুন। কয়েকদিন হয়ে গেলেও ব্যথা যদি না কমে, সাথে জ্বর ও বমির তাণ্ডব শুরু হয়, তা হলে হয়তো তা অ্যাপেনডিসাইটিসের লক্ষণ। অ্যাপেনডিক্স পেটের তলায় ডানদিকে থাকলেও এই ব্যথা প্রথমে নাভির আশপাশ থেকে শুরু হতে পারে।
#15. শুকনো ঠোঁট ও প্রস্রাব কমে যাওয়া-> একদম ছোট বাচ্চা যদি প্রস্রাবের পরিমাণ কমিয়ে দেয় বা তার ঠোঁট শুকনো হয়ে যায়, তা হলে বাচ্চার ডিহাইড্রেশন হতে পারে। বাচ্চা যদি ডায়রিয়ায় ভুগছে, সে সময় বিশেষ সতর্ক থাকুন।
আরও পড়ুনঃ বাচ্চার পটির রং, কোনটা স্বাভাবিক কোনটা নয়!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null