সদ্যোজাত বাচ্চাদের মধ্যে, বিশেষ করে যেসব বাচ্চারা তাড়াহুড়ো করে নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই চলে এসেছে; তাদের জন্ডিস হওয়া অতি পরিচিত একটি ঘটনা ডাক্তারদের কাছে। দেখা গেছে, নবজাতক ছেলেদের মধ্যে এই জন্ডিস হওয়ার প্রবণতা মেয়েদের তুলনায় বেশি থাকে। শরীরে বিলিরুবিনের আধিক্য ঘটলে জন্ডিস প্রকট হয়ে ওঠে। এমনটা নয় যে, শুধু সদ্যোজাত বাচ্চাদেরই জন্ডিস হতে পারে। বড় বয়সেও জন্ডিস হয় এবং তা সংক্রমণের কারণে। নবজাতকের জন্ডিসের পিছনে থাকা কারণ কিন্তু একটু অন্যরকম হওয়ার দাবি রাখে। আবার যতই পরিচিত বা সাধারণ রোগ হোক না কেন,সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে শিশুর মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক খারাপ প্রভাব হতে পারে, ঘটতে পারে অকাল মৃত্যুও। সাধারণত, শিশু জন্মের ১ সপ্তাহকালের মধ্যেই জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে। সদ্যোজাত বাচ্চার জন্ডিসের কারণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েই আমাদের আজকের বিশদ আলোচনা। (Jaundice in newborn baby: Causes, Symptoms, Treatment, and Prevention/ Jaundice in newborn baby in Bangla)
আমাদের শরীরের রক্ত প্রতিনিয়ত ভেঙে গিয়ে নতুন রক্ত তৈরি হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য পদার্থ রূপে বিলিরুবিন তৈরি হয়। লিভার এই বিলিরুবিনকে দ্রবণীয় পদার্থে রূপান্তরিত করে মল-মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। কিন্তু শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা যখন স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায়, তখন এই অসুস্থতাকে ‘জন্ডিস’ নাম দেওয়া হয়।সদ্যোজাত বাচ্চার ক্ষেত্রে এই জন্ডিসের সম্ভাব্য প্রধান কারণ দুটি;
বাচ্চা যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখন তার শরীরে যে হিমোগ্লোবিন থাকে, তার গঠন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের হিমোগ্লোবিনের গঠনের তুলনায় খানিক আলাদা হয়। বাচ্চা জন্মানোর পরে, তার শরীরের পুরানো হিমোগ্লোবিন দ্রুত গতিতে ভাঙতে শুরু করে। স্বাভাবিক ভাবেই, বর্জ্য পদার্থ হিসেবে তৈরি হতে থাকে প্রচুর পরিমাণে বিলিরুবিন। কিন্তু, ছোট্ট একরত্তির ছোট্ট লিভারখানি সেই গতির সাথে পাল্লা দিয়ে, অত দ্রুত বিলিরুবিন কে দ্রবণীয় পদার্থে পরিবর্তন করে শরীর থেকে বের করে দিতে পারে না। ফলস্বরূপ, বাচ্চার শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রার আধিক্য ঘটে। আর এখানেই জন্ডিসের সূত্রপাত। জন্মের তিনদিন পর থেকে এই সমস্যা হতে পারে এবং সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে নিজে নিজেই এই জন্ডিস কমে যায়। এই জন্ডিসের পোশাকি নাম ফিজিওলজিক জন্ডিস। এইরকম জন্ডিসে শিশুর শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা সর্বোচ্চ ১৩ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটার পর্যন্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন: শিশুর সুরক্ষায় কোন বয়সে কোন টিকা!
#2. ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস (Breast milk jaundice)
মা যদি বাচ্চাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়াতে না পারে বা বাচ্চা বেশি খেতে না পারে, তা হলে বাচ্চার জন্ডিস বাড়তে পারে। জন্মের ২-৩ দিন পর এই ধরনের জন্ডিস বাড়তে পারে এবং ৭-৮ দিনের মধ্যে কমেও যায়। আবার কিছু কিছু মায়ের ব্রেস্ট মিল্কে এমন কিছু উপাদান আছে, যা বাচ্চার লিভারকে বিলিরুবিনকে প্রসেস করার কাজে বাধা দেয়। এর ফলেও জন্ডিস বাড়তে পারে। ব্রেস্ট মিল্কের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে এই ধরনের জন্ডিসকে ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস বলে। যদিও এই ধরনের জন্ডিস সাধারণভাবে কম হয়; প্রতি ১০০ জন নবজাতকের মধ্যে মাত্র ১ জন এই জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। এই জন্ডিস জন্মের সাতদিন পর প্রকট হয় এবং তারপর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। Newborn Jaundice: Causes, Symptoms, Treatment, and Prevention.
এছাড়া, বাচ্চার শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা ১৩ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটারের বেশি হলে মনে করা হয়, অন্য কোনও কারণে জন্ডিস হয়েছে। যেমন;
সদ্যোজাতের সামান্য জন্ডিস হলে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। মোটামুটি ২ সপ্তাহের মধ্যে এই জন্ডিস কমে যায় ও বিলিরুবিন স্বাভাবিক মাত্রায় চলে আসে। কিন্তু যদি শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যায়, তা হলে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। Newborn Jaundice: Causes, Symptoms, Treatment, and Prevention.
বাচ্চাকে বিশেষ আলোকরশ্মির তলায় রেখে জন্ডিসের চিকিৎসা করা হয়। বাচ্চার রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ১৭ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটার পেরিয়ে গেলে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
বাচ্চার রক্তে উপস্থিত বিলিরুবিনের মাত্রা ২০ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটার অতিক্রম করলে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাচ্চার রক্ত বার করার সাথে সাথে তার শরীরে অন্য কোনও দাতার রক্ত ঢোকানো হতে থাকে।
মা ও বাচ্চার রক্তের রিস্যাস ফ্যাক্টর আলাদা হওয়ার কারণে জন্ডিস হলে বাচ্চাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা হয়। এই পদ্ধতিতে শিশুর শরীরে আসা মায়ের অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে, মায়ের অ্যান্টিবডি বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে না।
নবজাতকের জন্ডিস খুবই সাধারণ ঘটনা হলেও, প্রয়োজন সতর্ক পর্যবেক্ষণ। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে বা জন্ডিস খুব বেড়ে গেলে শিশুর শরীরে নানাবিধ ক্ষতি হতে পারে। মস্তিষ্কের ক্ষতি, কানে কম শোনা, অপরিণত বুদ্ধি এসব তো ভবিষ্যতে দেখা দিতেই পারে; তার থেকেও বড় কথা, বাড়াবাড়ি রকমের জন্ডিস দেকে আনতে পারে শিশুর মৃত্যু। সাধারণত, শিশুর জন্মের ৩-৪ দিন পরে ডাক্তার শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসা করেন। পরীক্ষা করা ছাড়াও, শিশুর ত্বক ও চোখের রঙ থেকে সবার আগে বোঝা যায় তার জন্ডিস হয়েছে কি না। বাচ্চা যদি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়, তা হলে বাচ্চার কপালে আঙুলে করে অল্প চাপ দিয়ে সরিয়ে নিলে, সেখানে হলুদ রং দেখতে পাবেন । চোখের সাদা অংশ বা মুখে হলুদ ভাব থাকলে তা সামান্য জন্ডিসের লক্ষণ। জন্ডিস মাত্রায় বাড়লে এরপরে শিশুর পেটে ও বুকে হলুদ ভাব চলে আসে। জন্ডিস খুব বেড়ে গেলে হাতের তালু এবং পায়ের তলাও হলুদ হয়ে যায়। তবে, চিন্তার কোনও কারণ নেই। সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সতর্ক থাকুন একটু। জন্ডিস এলেও উঁকি দিয়েই পালিয়ে যাবে।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null