মায়েদের জন্য আর কী টিপস রইল সুদীপার? খোঁজ নিলাম আমরা!

মায়েদের জন্য আর কী টিপস রইল সুদীপার? খোঁজ নিলাম আমরা!

কপালে বড় টিপ, মুখে স্নিগ্ধ হাসি, এক মাথা চুল আর আটপৌরে সাজ। তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতিতে বিকেলের চায়ের আড্ডাটা যেন জমে যেত জাস্ট! রান্নাবান্না, ঘরোয়া টোটকা, ভালোমন্দয় ঘেরা সেই বিকেলগুলোরই হঠাৎ অন্ত হলো একদিন। জনপ্রিয় রান্নার শো থেকে বিদায় নিলেন বাঙালির প্রাণের মানুষ, মনের মানুষ; সুদীপা চট্টোপাধ্যায় (Sudipa Chatterjee)!

তারপর? তারপর প্রায় বছর খানেকের ফারাক। নিজেরই একটা ছোট্ট সংস্করণকে কোলে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি! না, জনপ্রিয় উপস্থাপিকা হিসেবে নয়। সুদীপা এবার মায়ের ভূমিকায়। আরে আরে, ভূমিকা কী বলছি! গত নভেম্বরে সুদীপা (Sudipa Chatterjee) নিজেই মা হয়েছেন। এত্তটুকু ছেলে আদি, তিন-তিনটি না-মানুষ ছানা আর মনের মানুষকে নিয়ে এখন তাঁর ভরা সংসার। পাশাপাশি সামলাচ্ছেন জনপ্রিয় এক ধারাবাহিকের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের দায়িত্বও! এত সবের মাঝেও সময় দিলেন বেবি ডেস্টিনেশন বাংলার সম্পাদক ঋত্বিকা ভট্টাচার্যকে। ভাগ করে নিলেন মা হওয়ার পুরো পথটার ছোট ছোট মুহূর্ত, অনুভূতিগুলো…

 

(সন্ধে সাতটা হবে তখন। সারাদিনের ক্লান্তির এতটুকু ছাপ নেই চোখে-মুখে। চেনা, স্নিগ্ধ সেই হাসি নিয়েই কথা শুরু করলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে;)

Sudipa Chatterjee

প্রশ্ন: অভিনেত্রী, সঞ্চালিকা, স্ক্রিপট রাইটার না মা? কোন ভূমিকায় সবচেয়ে এগিয়ে সুদীপা?

উত্তর: দেখুন, প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ কখনই এক হয় না। কাজ করতে আমি ভালোবাসি, কাজ ছাড়া আমি থাকতে পারি না। কাজের জায়গায় তাই সবসময় নিজের সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এসবের উপরে রয়েছে মাতৃত্ব! এই অনুভূতিটার কোনও তুলনাই চলে না। ঐশ্বর্য রাই মা, আমি মা, আমার বাড়ির পরিচারিকাটিও মা। পরিচয় যা-ই হোক না কেন, মাতৃত্ব, সন্তানের প্রতি মায়ের টান, মা ডাকটার কোনও বদল হয় না। আদির সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূ্র্ত দারুণ উপভোগ করছি আমি…

 

প্রশ্ন: প্রেগন্যান্সি ও আদির জন্মের পর প্রথম ছয় মাস- পুরো জার্নিটা ঠিক কেমন ছিল?

উত্তর: ৩৮ বছরে মা হয়েছি আমি।প্রেগন্যান্সির দিনগুলো তাই খুব সহজ কেটেছে, এমনটা বলবো না। কিন্তু মা হওয়ার জন্য মানসিক, শারীরিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমি। তাতেই কেটে গিয়েছে অনেক বাধা। মাদারহুড যদি প্ল্যান করে করা যায়, অনেক সমস্যাই এড়ানো যায় বলে মনে করি আমি। শুধুমাত্র কনসিভ করবো বলেই ১২ কেজি ওজন কমিয়েছিলাম। সাঁতার কেটেছি, স্ট্রিকট ডায়েট মেনেছি। এমনকী প্রেগন্যান্সিতেও আমি যেমন খুশি খাবার খাইনি! বাড়ির বড়রা এ সময় অনেককেই তেল-ঘী এসব খাওয়াতে থাকেন। এগুলোতে কিন্তু কোনও লাভ হয় না। যতটা প্রয়োজন, ততটাই খাবার খাওয়া উচিত। এরই মধ্যে যতটা পেরেছি, কাজের মধ্যে থেকেছি আমি। ধারাবাহিকের স্ক্রিপট লেখা, ক্রিয়েটিভ দিক সামলানো সেই সঙ্গে ঘর-সংসার সব কিছু! মাঝে তো একবার পরিচারিকাও ছিল না বাড়িতে। তখন কাপড় কাচা, সেগুলো মেলা, আমার না-মানুষ ছানাগুলোর দেখভাল সবই করতে হয়েছে! তাতে আমার ক্লান্তি তো হয়নি, উল্টে অনেক বেশি ফ্রেশ লাগতো…

         এটাই শুধু নয়, আমার যখন সাত মাস চলছে তখন একটা ক্রাইসিস হয়েছিল। বাড়িতে তখন কেউ নেই। এদিকে শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল আমার। নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম তখন…কী জানেন, পুরোটাই মনের জোর! আমি সেই জোরটা রাখতে পেরেছিলাম।

         তারপর আদি যখন কোলে এল, শরীরের ধকল-টকল কোথায় হাপিজ তখন! সিজার হয়েছিল আমার, সন্ধেবেলা জন্ম হয়েছিল আদির। একঝলক দেখিয়েই ওকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নার্সরা। শরীরের তখন ওই অবস্থা, কিন্তু ওকে আর একটিবার দেখার জন্য মনের মধ্যে যা হচ্ছিল, একজন মা-ই তা বুঝতে পারে…খালি মনে হচ্ছিল, কখন কোলে নেবো ওকে, কখন দুধ খাওয়াবো! ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছিল, তা-ও ঘুমাইনি। আদিকে নিয়ে এসেও যদি ফিরে যায় ওরা!

         ওকে নিয়ে এই ছটা মাস কীভাবে যে কেটে গেল, টেরও পাইনি। প্রথম তিন-চারদিন তো সামলাতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছিলাম। কীভাবে ধরব, কীভাবে কোলে নেবো…ওই অত্তটুকু ছেলে তো তখন! তারপর নিজে নিজেই কীভাবে সব শিখে গেলাম, আদিও মায়ের সাথে মানিয়ে গুছিয়ে নিলো। মায়ে-ছেলে মিলে এভাবেই দিব্য কেটে যাচ্ছে সময়।

 

প্রশ্ন: পড়াশোনা, চাকরি, কেরিয়ার গোছানো এসব নিয়ে অনেক মেয়েই বেশ দেরিতে বিয়ে করছে এখন, সন্তানও হচ্ছে দেরিতে। এই যে এত্ত কমপ্লিকেশনের কথা শুনি, সেগুলো কি আদৌ খাটে?

উত্তর: একেক জনের অভিজ্ঞতা একেক রকম হয়। ২৫-২৬ বয়সে যতটা সহজে সব কিছু হয়ে যেতে পারে, ৩০-এর পর সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে! তবে একটু ম্যাচিওর হলে যেটা হয়, অযথা প্যানিক হয় না। আমার ডেলিভারির সময় অনেককেই তো দেখলাম। কী ভয় পেয়েছিল মেয়েগুলো…আমার কিন্তু এক্কেবারে সেই ভয়টা হয়নি। বরং অধীর অপেক্ষায় ছিলাম, কখন সব কিছু শেষ হবে, আর বাচ্চাটাকে কাছে পাবো আমি। স্লিপলেস নাইটগুলোর জন্য যেন তর সইছিল না আমার! হ্যাঁ, এটা ঠিক কিছু জটিলতা আমারও তৈরি হয়েছিল, তবে সেটা সাময়িক। প্রেগন্যান্সি ডায়াবেটিসের সমস্যা হচ্ছিল আমার। বাচ্চা হওয়ার কিছুদিনের ভিতরই সেটা সেরে যায়!

 

প্রশ্ন: কর্মরতা মায়েদের জন্য কিছু টিপস?

উত্তর: প্রেগন্যান্সির দিনগুলোয় কাজের মধ্যে থাকাটা খুবই জরুরি। কিন্তু কাজের ধরনটা যদি টানা দাঁড়িয়ে থেকে হয়, সেলস গার্ল বা এই ধরনের, তা হলে অসুবিধা তো হয় বই কি! এ সময় সবচেয়ে ভালো মেয়েদের যদি বাড়ি থেকে কাজের (Work from home) সুযোগ দেওয়া হয়। বাইরে এগুলোর খুব চল আছে। আমাদের এখানে এখনও সে ভাবে চালুই হয়নি। এই সুযোগটা থাকলে কাজের ভিতর থাকা যায়, আবার শরীরটাও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পায়।

 

প্রশ্ন: ছেলের সাথে না-মানুষ ছানাদের বন্ধুত্ব হলো?

উত্তর: হলো মানে? হইয়েছি! তা-ও অনেক কৌশল করে। তিনটে না-মানুষ ছানার মধ্যে আমার সবচেয়ে নেওটা ভানু (গ্রেট ডেন)। ওকে নিয়েই সবচেয়ে চিন্তায় ছিলাম আমি। প্রেগন্যান্সির দিনগুলো থেকেই ভানুর সাথে আদির ভাব করানোর চেষ্টা করেছি। আদি যখন হাত-পা ছুঁড়ত, ভানু সেটা দিব্যি টের পেত। বেবিকে আদর করতে বললে আমার পেটে চেটে দিয়ে পালাত!

        এত করেও লাভ যদিও তেমন কিছুই হয়নি। আদিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে চারদিন পর যখন বাড়ি এলাম, ভানুর সে কী রাগ…আমার না থাকার জন্য আদিকেই দায়ী করছিল ও। তারপর আস্তে আস্তে ভানুকে বোঝালাম, তোর জায়গাটা তোরই আছে, একটা নতুন ভাই এসেছে কেবল!

 

প্রশ্ন: বাড়িতে তিন-তিনটে পোষ্য, লোম বা কিছু থেকে রোগ-ভোগের ভয় হয়নি কখনও!

উত্তর: আমার অপশনটা কী ছিল? ওরাও তো আমারই সন্তান। আজ যদি আদির একটা মানুষ দাদা থাকত, আর তার হাঁচি-কাশির রোগ থাকত, সংক্রমণের ভয় তাকে কি আমি বাড়ির বাইরে পাঠাতাম? আমি আসলে ওভাবে ভাবিই না। ওদের লোম থেকে আদির যদি কোনও অসুবিধা হয়, তা হলে আদির চিকিৎসা করাব আমি। চিকিৎসা করাব না-মানুষ সন্তানদের। যাতে দু’পক্ষই ভালোবেসে একসাথে থাকতে পারে। আদি কোলে এসেছে বলে ওদের কী করে ভুলে যাই বলুন!

 

প্রশ্ন: সুদীপার রান্না আর রান্নাঘর তো সর্বজনবিদিত। ছেলের কি সৌভাগ্য হলো, মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার?

উত্তর: (এক গাল হেসে সুদীপা বললেন) এই এক সপ্তাহ হলো হয়েছে। টুকটাক খাবার বানিয়ে খাওয়াচ্ছি ওকে, আর এই রান্নাটা করতেই সবচেয়ে ভালো লাগছে আমার! এ এক অপার তৃপ্তি…

 

প্রশ্ন: আদি-স্পেশাল রেসিপিগুলো জানতে পারি কি?

উত্তর: এটাও পুরোটাই আমারই পরীক্ষানিরীক্ষা! আমাদের ভাত যখন হয়, তখনই ফেনা ভাত তুলে নিয়ে তাতে কখনও মুগ ডাল কখনও মুসুর ডাল দিয়ে খিচুড়ি বানাই। স্বাদের জন্য কখনও দিই এলাচ গুঁড়ো, কখনও জিরে, কখনও বা অল্প রসুন-পেঁয়াজ! ঘী-তে টেলে নিই ওগুলো। আদির যাতে একঘেয়েমি না লাগে, তার জন্য কখনও দিই আতপ চাল, কখনও সেদ্ধ চাল! সবটা মিলিয়ে ব্লেন্ডারে পেস্ট করে ওকে খাওয়াই ওকে।

 

প্রশ্ন: ছেলে মা ঘেঁষা হলো, না বাপকা বেটা?

উত্তর: মহা ফেঁসাদে ফেললেন তো! এতটুকু বয়সে এটা কী করে বলি বলুন দেখি? এমনিতেই এই বয়সে বাচ্চারা একটু মা-ঘেঁষাই হয়। তাও বলছি, বাবাকে দেখতে পেলেই আদির চোখটা যেন চকচক করে ওঠে! ভাবখানা জানি, এই তো, এই যে এসেছে আমার আবদার-আহ্লাদের সঙ্গী! মাকে তখন ভালো লাগবে কেন? মা যে জোর করে খাওয়ায়, বকাবকি করে…

 

প্রশ্ন: আজ মাতৃত্ব দিবস, নতুন মায়েদের জন্য সুদীপার কোনও স্পেশাল মেসেজ?

উত্তর: আমি একটাই কথা বলব, মাতৃত্ব মানে নিজস্বতা ভুলে থাকা নয়। সন্তানের জন্মের পর নিজের জীবনটা অনেকাংশেই ঘেঁটে ফেলেন মেয়েরা। স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কটা তখন শুধুই দায়িত্ব-কর্তব্যে এসে ঠেকে! সেখানে নেই কোনও রোম্যান্স, নেই কোনও প্যাশন। এটা কেন হবে বলুন তো? আমি বলব, পার্টনারের সঙ্গে বন্ডিংটা কখনও আলগা হতে দেবেন না। বাড়ির বড় কেউ হোক, বা সন্তানের দেখভাল করেন যিনি, তাঁর কাছেই বাচ্চাটিকে রেখে দু’জনে মিলে একটা সিনেমা দেখে আসুন, কিংবা কোনও রেস্তোরাঁয় রোম্যান্টিক ডিনার।           

সন্তানের জন্য সর্বস্ব করুন, কিন্তু ওকে আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করবেন না। এতে আগামী দিনে মারাত্মক ইনসিকিওরিটি আসতে পারে। আমি তো এখন থেকেই আদিকে একটু একটু করে একলা রাখি। ওর ওপর নজর রাখি, কিন্তু দূর থেকে। চেঁচামেচি করলেই যদি আগলে ধরি, কোনও দিনই স্বনির্ভর হবে না আদি। মা হয়ে সেটা করি কী করে বলুন তো!

(যেই না একলা রাখার কথা বলা,  চ্যাঁএএএএএএ করে অমনি প্যাঁএএএএএএ জুড়ে দিল আদি…ছোট্ট ছেলের কান্না শুনে মায়ের মন থির থাকতে পারে না কি! ইন্টারভিউ থামিয়ে অগত্যা আদির কাছে গেলেন সুদীপা ((Sudipa Chatterjee)। বাড়িমুখো হলো বেবি ডেস্টিনেশন…)

null

null