‘মাতৃত্ব আমি উপভোগ করি!’ এক গাল হেসে কথা শুরু করলেন তিনি!
বয়স ৭৬, কিন্তু জৌলুসে যেন আজও সেই ১৬। হাতে শাঁখা-পলা। কপালে সিঁদুর। পরনে ছাপোষা সুতির শাড়ি।
শুরুটা শুনে মনে হতেই পারে, কোনও বাঙালি বধূর কথা বলছি আমরা। মনে হওয়াটা ভুলও নয়। হ্যাঁ, তিনি আমার-আপনার মতোই বাঙালি। তবে মননে। আদতে মার্কিন নাগরিক। পাকাপাকি ভাবে নিজের দেশটা ছেড়েছেন প্রায় দেড় দশক আগে। সেটাও মাতৃত্বের টানেই!
এক, দুই নয়, এ মায়ের যে তেরো সন্তান। সক্কলেই তথাকথিত সক্ষমতার নিরিখে ‘ডিসএবলড’। এই ডিসএবিলিটি অর্থাৎ না পারাটাকেই বাস্তব করার একলা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিনি মিশেল, মিশেল হ্যারিসন (Michelle Harrison)!
মমতায়, সংগ্রামে, অর্জনে, প্রগতিতে নারীর স্বীকৃতির লড়াই চলছে যখন, কী করে তখন মিশেলকে ভুলে থাকতে পারি আমরা! কলকাতার নিউ আলিপুরে তিনতলা একটা বাড়িই এখন দুনিয়া তাঁর। মিশেলকে মিলিয়ে বাসিন্দা জনা কুড়ি। তেমন স্বাচ্ছল্য হয়তো নেই, যেটা আছে তা হল প্রাণ খুলে বাঁচার তাগিদ। একে, অপরের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার প্রবল একটা চেষ্টা। আর আছে বিদেশিনি মায়ের সঙ্গে তেরো বাঙালি সন্তানের ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য টান। (International Women’s Day)
এই ভালোবাসার শুরুটা আসলে সেই আশির দশকের মাঝামাঝি। মিশেল তখন মধ্যবয়স্কা, প্রতিষ্ঠিত মার্কিন মনোবিদ। কলকাতায় এসেছিলেন নিছক পর্যটক হিসেবে। এশহরের অনাথ আশ্রমগুলি ঘুরে দেখার সময় ফুটফুটে এক মেয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়ে যান। মিশেল তখন বায়োলজিকালি আর এক মেয়েরও মা। পরদেশি মেয়েকে তবু আপন করে নিতে একটিবারও দ্বিধা হয়নি। খাতায়কলমে শিশুটিকে দত্তক নিলেন মিশেল (Michelle Harrison)। ফিরে গেলেন নিজের দেশে।
তারপর বেশ কিছু বছর এশহরের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই ছিল না তাঁর। দুই মেয়েকে নিয়ে মার্কিন মুলুকে ছিল সুখের পরিবার। কিন্তু কলকাতার অনাথ আশ্রমগুলির বাস্তব ছবিটা যেন তাড়া করে বেড়াতো সবসময়! পরিকাঠামোর অভাব, পরিচ্ছন্নতার অভাব, আর্থিক অভাব, স্বচ্ছতার অভাব- আরও কত কী!
২০০২-তে সে টানেই ফের শহরে আসা। উদ্দেশ্য, এশহরের হোমগুলোর আদৌ কোনও বদল হয়েছে কি না, নিজের চোখে একটিবার দেখা। দ্বিতীয় মেয়েকে যেখানে পেয়েছিলেন, সবার প্রথম সেখানেই গেলেন মিশেল।
লম্বা একটা ঘর। দুদিকে দুটো সারি। একটা ‘এবলড’ শিশুর আর একটা ‘ডিসএবলড’-এর। দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতিদের যাতে অসুবিধা না হয়, তাই এই ঝাড়াই-বাছাই।
কৌতূহল থেকেই মিশেল প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘বাতিলের’ তালিকায় থাকা একঝাঁক শিশুর তা হলে ভবিষ্য়তটা কী! উত্তর মেলেনি। উপরন্তু জানা গিয়েছিল, কেবল আঠারো অবধিই হোমে ঠাঁই হবে তাদের।
তারপর? তার আবার পর আছে নাকি! কর্তৃপক্ষের ‘আশা’ ছিল, ততদিন অপেক্ষার দরকারই হবে না। তার আগেই জীবনের পাট চুকাবে বাতিলের দল!
সেই ‘আশা’তেই ছাই দিয়েছিন লড়াকু মা। তালিকায় থাকা সদ্য চোখ মেলা তেরোটি কুঁড়িকেই তখন দত্তক নিয়েছিলেন মিশেল। তেরো জনই মেয়ে, তেরো জনই ‘ডিসএবেলড’।
মার্কিন মুলুকের বিষয় সম্পত্তি বেচেবুচে এবার পাকাপাকি ভাবেই কলকাতায় চলে এলেন তিনি। মাতৃত্বের টানে হয়ে গেলেন এ-শহরেরই একজন। ২০০৬ সালে তাঁরই তত্ত্বাবধানে তৈরি হল ‘শিশুর সেবায়’ (Shishur Sevay)। মায়ের পরিচ্ছদ, সাজগোজের সঙ্গে দত্তক মেয়েরা যাতে সহজে মিলে যেতে পারে, তার জন্য ছাড়লেন বিদেশিনি-বেশও। নিজেই নিজের মাথায় তুলে নিলেন সিঁদুর। পরলেন শাঁখা-পলাও।
এখন তো দুপুরের খাবারে ডাঁটা দেওয়া শুক্তোও খাচ্ছেন মিশেল। আর একটু আগে যে তেরো কুঁড়ির কথা বললাম, মায়ের ছায়াও তারাও আজ এক-একটি বিকশিত ফুল। পূজা, গঙ্গা, পিঙ্কি, মণি, বর্ণালী, সোনালি- কী মিষ্টি সব নাম তাদের…
এদিকে পূজারা যত বড় হতে থেকেছে, ততই ছড়াতে থেকেছে মিশেলের মাতৃত্বের আঁচল। যাত্রাপথে হঠাৎই একদিন খবর আসে, বর্ধমান স্টেশন থেকে উদ্ধার হয়েছে একরত্তি এক মেয়ে। ট্রেনের সিটের নীচে তাকে রেখে গিয়েছিল কেউ বা কারা। শিশুটি তখন জ্বরে কাবু। নিউমোনিয়া হয়েছিল সম্ভবত।
খবরটা শুনে নিজেকে সামলাতে পারেননি মিশেল। জমানো পুঁজি ততদিনে কমতে শুরু করেছে। পরোয়া করেননি। মাতৃত্বের তাগিদেই ছুটে গিয়েছিলেন অচেনা মফঃশলে। আঁচলের তলে আশ্রয় দিয়েছিলেন কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকেও। সাধ করে কোলের মেয়ের নাম রেখেছিলেন মৌসম! মৌসমকে যদি এখন দেখেন, বুঝবেননই না কিছু বছর আগেই অবহেলায়, অনাদরে প্রায় মরতে বসেছিল চনমনে মেয়েটা!
প্রতিবন্ধী কথাটা সচরাচর মুখে আনি না আমরা, সভ্যতার খাতিরে বলি বিশেষ ভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু সেটা তো বলেই ক্ষান্ত, চিন্তায়-ভাবনায় আদৌ মানি কি? মিশেল কিন্তু মানেন। মনে-প্রাণে মানেন। দত্তক-মেয়েদের যার যেটুকু ক্ষমতা থাকতে পারে, তার পুরোটাই নিংড়ে সামনে এনেছেন তিনি। প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করেছেন শহরের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোয়।
নাচে-গানে এখন রীতিমতো পারদর্শী মণি। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তবলা বাজাচ্ছে পিঙ্কি। পূজার হাতের কাজ দেখলে তো চোখই ফিরবে না। এ মেয়েরই প্রতিভা সামনে আনার জন্য কিছুদিন আগে বিশেষ প্রর্দশনীর আয়োজনও করেছিলেন মা মিশেল।
সৃজনশীলতার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে পড়াশোনাও। এই এবারই তো মাধ্যমিক দিল মিশেলের এক মেয়ে! নেই প্রতিযোগিতা, নেই কান মোলার ভয়। মনের তাগিদে, কিছু করে দেখানোর প্রবল ইচ্ছেয় মায়ের স্বপ্ন স্বার্থক করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরাও।
‘ডিসএবিলিটি’র নিরিখে সবচেয়ে পিছনে ছিল গঙ্গা, বর্ণালীরা। কথা বলার শক্তিটাও ছিল না তাদের কাছে। তারাও এখন ‘এবল’। দু-দুটি আই ট্র্যাকারের সাহায্যে দিব্য মনের ভাব প্রকাশ করছে ‘দুই-বোন’। সন্তানের চোখের ভাষা অনায়াসে বুঝে নিচ্ছে মায়ের মনও…
লড়াইপথে চড়াই-উতরাই যে ছিল না, তা নয়। মাতৃত্বের জোরে সবটাই সামলে উঠেছেন মিশেল। ‘ডিসএবলড’ মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়া করানোর চেষ্টাটা চালিয়ে গিয়েছেন সর্বত ভাবে। আর-পাঁচটা সন্তান ঠিক যে ভাবে মায়ের আদরে-আহ্লাদে বেড়ে ওঠে, মিশেলের মেয়েদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, তা-ই হয়েছে। সে পার্কে গিয়ে মজা করাই হোক, কিংবা চিড়িয়াখানার হুল্লোড়!
বিকেলের আড্ডা থেকে শুরু করে, মন খারাপের রাতে মায়ের কোলে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকা, কোনও কিছু থেকে থেকেই বঞ্চিত হয়নি শৈশব। মাতৃত্বের স্বাদ চেটেপুটে পুরোটা উপভোগ করেছেন মিশেল, করেও যাচ্ছেন।
লড়াইয়ের স্বীকৃতি যে একেবারে মেলেনি তা নয়। এই এবছরই ‘গাইড স্টার ইন্ডিয়া গোল্ড সিল ফর ট্রান্সপ্যারেন্সি’র (Guide Star India Gold Seal for Transparency) মতো পুরষ্কার এসেছে ‘শিশুর সেবায়’ (Shishur Sevay)-এর ঝুলিতে। পুরস্কার পেলে কার না ভালো লাগে বলুন? মিশেলেরও ভালোই লেগেছে। কিন্তু এসব নিয়ে আনন্দে মেতে লক্ষ্য়ভ্রষ্ট হতে নারাজ তিনি!
বয়সভারে এখন খানিক দুর্বলতা এসেছে ঠিকই, তবে সেটা শুধুই শারীরিক। মনে-প্রাণে, হাসিতে-উচ্ছ্বলতায় ওই যে শুরুতেই বললাম, আজও তারুণ্য়ে ভরপুর এই মা। সন্তানদের নিয়ে আরও আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন, মেয়েদের বিয়ে হবে। সুখী সংসার হবে! আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বুড়ি দিম্মা রূপকথার গপ্পো শোনাবেন নাতিপুতিদের…
কথার ফাঁকে তো বড় মেয়ে পিঙ্কির জন্য পাত্র খোঁজার প্রস্তাবটা পেড়েই ফেললেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
কিন্তু এই শরীরে একলার এই লড়াই আর কাঁহাতক?
মানলাম, এখন কিছু বন্ধু পেয়েছে ‘শিশুর সেবায়’। পুঁজির জোগানে এগিয়ে এসেছে কিছু সহৃদয় ব্যক্তি, কিছু সংগঠন। কিন্তু মা তো মা-ই হয়। মা না থাকলে কেই বা মেটাবে সন্তানের আবদার, কেই বা নিজের আঁচলে আগলে রাখবে তাদের?
চিন্তাটা যে মিশেলকেও কুড়ে কুড়ে খায় না, তা নয়। প্রশ্ন শুনেই খানিক বিষণ্ণ হয়ে গেলেন তিনি। পর ক্ষণেই যদিও কাটিয়ে উঠলেন সেটা।
ছলছলে চোখ, মুখে সেই চেনা হাসি। মিশেল বললেন, ‘মাতৃত্বের অপার খিদেয় হয়তো কোনও মা-ই আবার দায়িত্ব নেবে ওদের। যতদিন না হচ্ছে, ততদিন এই মাকে তার সন্তানদের থেকে আলাদা করার সাধ্যি নেই কারও!’ International Women’s Day.
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null