গর্ভকালে অনিদ্রা আর পাঁচটা উপসর্গের মতোই স্বাভাবিক; জেনে নিন কারণ আর প্রতিকার!

গর্ভকালে অনিদ্রা আর পাঁচটা উপসর্গের মতোই স্বাভাবিক; জেনে নিন কারণ আর প্রতিকার!

দিনভর চোখ মেলে চেয়ে থাকত পিকু, যাতে রাতের ঘুমটা স্বাভাবিক হয়। ওমা! রাত ১টা, ২টো, ৩টে- ঘড়ির কাঁটা এগিয়েই চলেছে এদিকে ঘুমের দেখা নেই। ঘুম আনতে সে কত কসরৎ। বর মাথা টিপে দিচ্ছে, মাথায় বাম লাগাচ্ছে, গল্পের বই পড়ছে- কিছুতেই কিছু কাজ হয় না! ফলটা কী? দিনভর ঘা ঝিমুনি, ঘুমঘুম ভাব, খিটখিটে মেজাজ আর খাবারে বিরক্তি!
হরমোনের নাচানাচি আর শারীরিক নানা সমস্যার জন্য গর্ভাবস্থায় ঘুমের এই সমস্যা হবেই। আর এসবের সাথেই হাত মেলাবে হবু মায়ের মানসিক দুশ্চিন্তা, সন্তানকে নিয়ে উত্তেজিত থাকা, ক্রমাগত বাথরুমে যাওয়া আসা-এবং আরও নানা সব সমস্যা। আর এসবের জেরেই রাতের পর রাত বিনিদ্র কাটে গর্ভবতী মায়েদের। ঘুম ছোটার কারণ যা-ই হোক, এটা মাথায় রাখবেন অনিদ্রা বা insomnia আপনার গর্ভস্থ শিশুর জন্য় ক্ষতিকর নয়। গর্ভকালে অনিদ্রা আর পাঁচটা উপসর্গের মতোই স্বাভাবিক। ১০০ জনের ভিতর ৭৮জন হবু মায়েরই এমন সমস্যা হয়! (Insomnia During Pregnancy: Causes And Treatment. Pregnancy te anidra, ghumer problem. Insomnia During Pregnancy In Bangla)

গর্ভকালীন ঘুমের সমস্যা (Insomnia During Pregnancy In Bangla)

অনিদ্রা বা Insomnia নামটা এত ভারী যে মনে হতেই পারে যে এ ভয়ানক কোনও রোগ। বিষয়টা তেমন কিছুই নয়, আসুন দেখে নিই অনিদ্রা বা Insomnia জিনিসটা আসলে কী? অনিদ্রা আর কিছুই নয়, এ হলো ঘুমে ঘাটতি, পাতলা ঘুমের লক্ষণ! যার থেকে নিম্নলিখিত সমস্যা গুলো হতে পারে:

  • ঘুম আসতে দেরি
  • রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাবে
  • একবার ভাঙলে ঘুম আসবে না আর
  • ঘুম হলেও ক্লান্তিভাব

তবে আশার কথা হলো কিছু নিয়ম মেনে চললেই গর্ভাবস্থায় এই ঘুমের সমস্যা আপনি কাটিয়ে উঠতে পারেন। ট্রাইমেস্টার অনুযায়ী আমাদের গাইড গর্ভাবস্থায় আপনার ঘুমের সমস্যা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।

 

গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যার কারণ (What causes insomnia during pregnancy?)

#1. গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস (১-১২ সপ্তাহ)

এই সময় গর্ভবতী মহিলাদের ঘুম কম হয় বিশেষ করে দিনের বেলায় প্রায়ই চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকে। শরীর ক্লান্ত থাকে এবং ঘুমের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বারবার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, যার ফলে একটানা ঘুম ব্যাহত হয়। নানাপ্রকার শারীরিক ও মানসিক চাপের ফলে মনের ভিতরে অজানা আশঙ্কা, ভয়, উত্তেজনা তৈরি হয়। এর ফলেও ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

#2. গর্ভকালীন দ্বিতীয় তিন মাস (১৩-২৭ সপ্তাহ)

এসময় গর্ভবতী মহিলারা প্রথম তিন মাসের তুলনায় কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেন। রাতের বেলায় বাথরুমে কম যেতে হয় বলে এসময় ঘুমের অনেকটাই উন্নতি ঘটে। তবে এতটাও আনন্দের কিছু নেই! গর্ভে বাড়ন্ত ভ্রূণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও মানসিক অবসাদ ঘুমের পরিমাণকে কমিয়ে দিতে পারে।

#3. গর্ভকালীন তৃতীয় তিন মাস (২৮-৪০ সপ্তাহ)

তৃতীয় তিন মাসে অর্থাৎ গর্ভের ৭-৯ মাসে গর্ভবতী মায়েদের রাতে হাঁটার ও অনিদ্রার পরিমাণ অনেক গুণে বেড়ে যায়। বেশিরভাগ মহিলাদের এসময় রাতের বেলায় কমপক্ষে ৩-৫ বার ঘুম ভেঙে যায়, যার কারণ বারবার বাথরুমে যাওয়া ও পিঠ ব্যথা। এছাড়াও গর্ভস্থ বাচ্চার ক্রমাগত নড়াচড়া মূত্রস্থলীতে চাপ দেয় ফলে ঘনঘন প্রস্রাবের চাপ পড়ে। গর্ভকালীন শেষের কয়েক সপ্তাহে ঘুমের মধ্যে নানা দুঃস্বপ্নও এর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

কীভাবে ঘুম আনবেন চোখে (How To Deal With Insomnia During Pregnancy In Bangla)

#1. ঘুমের রুটিন তৈরি করুন (Have a routine for sleep)

গর্ভাবস্থায় ঘুমের একটা রুটিন তৈরি থাকা খুবই দরকার। দুপুরে ২টো থেকে চারটে অবধি হালকা জিরিয়ে নিন। নয়তো রাতে আবার ঘুম আসতে সমস্যা হতে পারে। একবারে বেশি ঘুমানোর চেয়ে চেষ্টা দু-তিনবার জিরিয়ে নিন, আরাম পাবেন।

#2. সন্ধ্যার পর জল কম খান (Drink less water after evening)

দিনভর যতখুশি জল খান। সন্ধে হতেই কমিয়ে আনুন পরিমাণ। জল কম খেলে প্রস্রাব কম হবে, গর্ভবতী মা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমাতেও পারবেন। আপনার যদি চায়ের নেশা থাকে তবে তা শুধু সকালেই খাওয়ার চেষ্টা করুন। চা-কফি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। ফলে ভালো ঘুম হয় না!

 

আরও পড়ুন: সি সেকশন ডেলিভারি হতে চলেছে? জেনে রাখুন এগুলো

 

#3. হাতের কাছে কিছু খাবার রাখুন (Always keep some food near you)

সারাদিন যাই খান না কেন রাতে অবশ্যই আপনার কাছে হালকা, কিন্তু স্বাস্থ্যকর এমন কিছু খাবার মজুদ রাখুন। যেমন তাজা ফলমূল, চিজ, সিদ্ধ ডিম, হেলদি স্ন্যাকস ইত্যাদি। খিদে পেলে এগুলো কিছুটা খেয়ে শুয়ে পরুন, দেখবেন চট করে ঘুম চলে আসছে।

#4. ব্যায়াম করুন প্রতিদিন (Exercise regularly)

নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এতে শরীর-মন দুটোই ভালো থাকবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা গভীর ঘুমের জন্য খুবই সহায়ক। তবে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্যায়াম না করাই ভালো। সেই সঙ্গে গর্ভবতী মায়েরা কোনও ভারী ব্যায়াম করবেন না যেন। যোগা করতে পারেন, এতে অন্য উপকারের পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা মোকাবিলায় উপকার পাবেন।

 

#5. খাওয়ার পরপরই না শোওয়া (Gap between dinner and bedtime)

গর্ভাবস্থায় আপনি যা-ই খান না কেন, তা হজম হতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই এ সময় খাওয়ার পর অন্তত চার ঘণ্টা না শোওয়াই ভালো। অ্যাসিডিটির ধাত থাকলে সকালে বেশি খেয়ে রাতে কম খেলে এই অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

#6. ভাজা-পোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন (Avoid fried and tandoori food items)

হয়তো তন্দুর আপনার বেজায় পছন্দ, কিংবা তেলঝাল দেওয়া দারুণ স্পাইসি কিছু! কিন্তু বন্ধু মা হতে গেলে এইটুকু আত্মত্যাগ তো করতেই হবে আপনায়। নিজের শরীর, নিজের ঘুম, সর্বোপরি পুঁচকেটার খাতিরে ভাজা পোড়া খাবার পরিহার করুন এবং বেশি মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।

#7. কফি-চকলেট বর্জন করুন (Avoid caffeine and chocolate)

চোখে ঘুম চাইলে চকলেট-কফির প্রতি ভালোবাসা আপনাকে বর্জন করতেই হবে। এগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। ফলে ভালো ঘুম হয় না। চা-টা খেলেও খেতে পারেন, তাও সকালের দিকে খাওয়াই ভালো। সন্ধের পর চায়ের কাপে চুমুক অনিদ্রার কারণ হতে পারে।

#8. বাঁ দিক ফিরে শোওয়া (Turn to your left while sleeping)

বাঁ দিক ফিরে শোওয়াটা আপনার বাচ্চার জন্যও ভালো হতে পারে, কেন না এতে পুষ্টি ও রক্ত প্ল্যাসেন্টা দিয়ে সহজেই বাচ্চার কাছে পৌঁছাতে পারে। আপনার কিডনিও বর্জ্য ও অতিরিক্ত ফ্লুইড আপনার শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য কাজ করতে পারে। এর ফলে আপনার হাত-পা-গোড়ালি ফুলে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।

#9. শোওয়ার ভঙ্গি বদলে ফেলুন (Change your sleeping position)

শোওয়ার সময় একটি বালিশ পেটের নীচে এবং আরেকটি দুই পায়ের মাঝে রাখলে ও পিছনে পিঠের দিকে নরম কম্বল রোল করে সাপোর্ট হিসেবে রাখলে উপকার পেতে পারেন। দুই হাঁটুর মাঝে বালিশ থাকলে আপনার হিপ ও পেলভিস-এর পেশীর ওপর চাপ কম পড়বে।

#10. খুশি খুশি থাকুন সর্বক্ষণ (Always be happy)

দেখুন, গর্ভকালে হরমোনের নাচানাচিতে মন-মেজাজ বিগড়ে যেতে বাধ্য। তা-ও বলব যতটা পারেন, মন ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করুন। শোওয়ার আগে আরাম পেতে হালকা গরম জলে গা ধুয়ে নিতে পারেন অথবা ক্যাফাইন ছাড়া পানীয় যেমন হালকা গরম দুধ খেতে পারেন।

এরপরেও কাজ না হলে আর চেষ্টা-চরিত্তির না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা অন্যতম বড় আর জটিল সমস্যা। তাই মাকে নিজে এবং কাছের সব মানুষদের তাঁর ঘুমের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় একজন মায়ের ও শিশুর শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গর্ভবতী মা যদি ভালোভাবে ঘুমাতে না পারেন তবে এই সমস্যাই মাতৃত্বের জন্য নিজেকে তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুস্থ মা-ই সুস্থ শিশুর জন্ম দেন। সুতরাং এ বিষয়ে সক্কলের সচেতনতা ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন!

 

আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম- উপকারিতা আর সাবধানতা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null