টুকাইয়ের বয়স সবে দেড় বছর। এখন নানারকম শক্ত খাবারই ও খেতে পারে। তবে গত কিছুদিন ধরেই খাওয়ার পরেই পরেই বমি হচ্ছে! এমনিতেই খাওয়ার সময় ওর নানা বায়না। প্রথমে অপূর্বা বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়নি। ভেবেছিল, সাধারণ সমস্যা। কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তৃতীয়দিন টুকাই যখন বিছানা থেকেই উঠতে চাইল না, অপূর্বা ভয় পেয়ে গেল। (Common Children’s Digestive Problems and Solutions)
বিপদের আঁচ পেয়ে অপূর্বা ফোন করে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল টুকাইয়ের ডাক্তারবাবুর। নির্দিষ্ট দিনে তাঁর চেম্বারে গিয়ে সমস্তটা তাকে জানাল। অপূর্বার মুখ থেকে সব শোনার পর চিকিৎসক টুকাইকে পরীক্ষা করে দেখলেন। পেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন টুকাইয়ের জিইআরডি হয়েছে। যার পুরো নাম গ্যাস্ট্রোএসোফেগাল রিফ্লাক্স। এই রিফ্লাক্সের কারণে পেটে থাকা বায়ু খাদ্যনালী বরাবর ঊর্ধ্বমুখী ধাক্কা দেয়। ফলে খাবার বমি হয়ে যায়। টুকাইয়ের ক্ষেত্রে বমির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি।
চিকিৎসক অপূর্বাকে বললেন, এই সময়টা ওর খাবার থেকে পুষ্টি পেয়ে বেড়ে ওঠার সময়। তাই পেটের গণ্ডগোল হচ্ছে বুঝলে দেরি না-করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নয়তো খুদের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। অপূর্বা জিজ্ঞেস করলো, কী কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে ওর পেটে ব্যথা বা খাদ্যতন্ত্রে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। চিকিৎসক এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি লক্ষণের কথা বলে দিলেন।
#1. পেটে ব্যথা ও কান্না (Stomachache & Crying): এই সমস্যায় পেটে ব্যথা প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে ফুটে ওঠা স্বাভাবিক। অনেক সময় দেখা যায়, খুদে বারবার পেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। একেবারে ছোট্ট বাচ্চারা সেটুকুও পারে না। নিরুপায় হয়ে তারা কাঁদতে থাকে। চিকিৎসকদের মতে, সমস্যা অনুযায়ী কান্নার নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে। একটানা অনেকক্ষণ কান্নার মাধ্যমে খুদে তার পেটের ব্যথার কথাও বোঝাতে পারে।
2. নসিয়া বা বমিবমি ভাব (Nausea): খাদ্যতন্ত্রে কোনওরকম সমস্যা হলে নসিয়ার লক্ষণ দেখা যায়। ছোট্ট সোনার খাদ্যনালী প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পরিণত হয় না। তাই সহজেই খাবার থেকে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নসিয়া লক্ষণটি আসলে কয়েকটি লক্ষণের সমাবেশ। এতে মাথা ব্যথা, বমিবমি ভাব ও ঝিমুনি আসে। খুদের মধ্যে এই লক্ষণ দেখা গেলে তার মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। খাওয়াদাওয়ার প্রতি অনীহাও দেখা দেয়। নসিয়ার লক্ষণ পেটের অসুখকেও নির্দেশ করে।
#3. ডায়রিয়া (Diarrhea): বিশেষজ্ঞরা বলেন, খুদের পায়খানার প্রকৃতিই বলে দেয়, তার পেটে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। পায়খানা যেমন খুব শক্ত হওয়া ভালো নয়, তেমনই পাতলা হলেও তা ভয়ের কারণ। দু’-একবারের বেশি পাতলা পায়খানা হলে খুদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে শরীরও ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায় বা শুকিয়ে যায়।
#4. বমি (Vomiting): নসিয়া ছাড়াও শুধু বমিও শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। খাবার খাওয়ার পর ছোট্ট সোনা খাবার বমি করে ফেলছে, এমনটা একাধিকবার হলে দেরি না-করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। খাবার থেকে খুদের পেটে কোনও সংক্রমণ হলে ওর বমি হতে পারে। এছাড়াও অ্যাসিডিটির কারণেও খুদে খাবার বমি করে ফেলে।
#5. খাবার খেতে না-চাওয়া (Refuse To Eat): ছোট্ট সোনা খাবার খেতে না-চাওয়া অনেকসময় তার পেট ব্যথার লক্ষণ হতে পারে। যেসব বাচ্চারা খাওয়ার সময় তেমন বায়না করে না, তাদের ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন পেটের সমস্যারই (Toddler Diegestive Problems) পূর্বাভাস। তাই এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটলে চিকিৎসককে জানানো জরুরি।
#6. পেট ফুলে যাওয়া (Swelling of Tummy): ছোট্ট সোনার পেটের আকৃতিও সম্ভাব্য সমস্যার কথা বলে দিতে সক্ষম। খাওয়ার আগে ও পরে খুদের পেটের আকৃতি কেমন হয়, মায়েরা তা ভালোই জানেন। পেটের আকৃতি যদি হঠাৎ করেই বড় হতে থাকে অর্থাৎ ফুলে যেতে থাকে, তবে তা ভয়ের। অন্ত্রে সংক্রমণের ফলে এমন লক্ষণ দেখা যায়। তবে পেটের আকৃতি বৃদ্ধির সঙ্গে বমি, ঝিমুনি ইত্যাদি অন্যান্য লক্ষণগুলোও ফুটে উঠতে পারে।
লক্ষণগুলো শোনার পর অপূর্বার ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেল। তবে ওর মনে অন্য প্রশ্ন এল। ঠিক কী ধরনের সমস্যায় ভুগতে পারে টুকাই? চিকিৎসক ওর সেই কৌতুহলও মেটালেন। তিনি বেশ কিছু রোগের লক্ষণ জানিয়ে দিলেন অপূর্বাকে।
আরও পড়ুন: বমি, পেট খারাপে নাজেহাল ছোট্ট সোনা, টোটকাগুলো ট্রাই করেছেন কি?
#1. গ্যাস্ট্রোএসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিসিজ (Gastroesophegal Reflux Disease): সংক্ষেপে জিইআরডি নামে পরিচিত এই রোগটি খাদ্যতন্ত্রের ভিতরে তৈরি হওয়া অ্যাসিডের কারণে হয়। এই অ্যাসিড খাদ্যনালী বরাবর উপরের দিকে ধাক্কা দেয়। এই ধাক্কা গুরুতর হলে হজম না-হওয়া খাবার খুদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। অনেক সময় এই অ্যাসিডের জন্যই শিশু সঠিক পরিমাণে খাবার খেতে পারে না। অথবা খেলেও তা বমি করে ফেলে।
#2. ইউসিনোফিলিক গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ডিসঅর্ডার (Eosinophilic Gastrointestinal Disorders): রক্তের শ্বেতরক্তকণিকাই এই সমস্যার মূল কারণ। এই রোগে অন্ত্রের ভিতরে শ্বেতরক্তকণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। এই সময় খুদের খাবার গিলতে কষ্ট হয়। পেট ফুলে যায় ও পেটের ভিতর জ্বালা হতে থাকে।
#3. ইন্টাসাসেপশন (Intussusception): ইন্টাসাসেপশন এমন একটি সমস্যা, যাতে অন্ত্রের একটি অংশ অন্য অংশের ভিতর ভাঁজ খেয়ে ঢুকে যায়। একটি বড় পাইপের মধ্যে যেমন একটি ছোট পাইপ ঢুকে যায় এক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়। এটি অন্ত্রের যে কোনও স্থানে হতে পারে। এই রোগের কারণ এখনও বিজ্ঞানের অজানা। এক্ষেত্রে শিশুর পেটের কাছে পা ভাঁজ করে কান্নাকাটি করে। ছোট্ট সোনার পেট ফুলে যায়, ও ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
#4.শর্ট বাওয়েল সিনড্রোম (Short Bowel Syndrome): প্রতিদিনের খাওয়া খাবার থেকে পুষ্টি সংগ্রহের জায়গা হল অন্ত্র। শর্ট বাওয়েল সিনড্রোম এমন সমস্যা যাতে খুদে সোনার অন্ত্র যথেষ্ট দীর্ঘ হয় না। এতে খাবার থেকে সম্পূর্ণ পুষ্টি শরীরে যায় না। ডায়রিয়া এই রোগের প্রধান লক্ষণ। এই সময় শরীর প্রচন্ড ডিহাইড্রেটেড হতে থাকে। পায়খানার প্রকৃতির কারণেই ডায়পার র্যাশ হয়। এই লক্ষণগুলোর শিশুর মধ্যে অপুষ্টিও দেখা যায়।
চিকিৎসকের থেকে রোগ ও তার লক্ষণের ব্যাপারে জানার পর অপূর্বা বুঝতে পারে কখন কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তবে টুকাইয়ের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকই ওকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, খাওয়াদাওয়ার পর নিয়মিত ঢেকুর তোলালে ওর এই সমস্যা আর হবে না। হলও তাই।
চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলায় দু’-একদিনের মধ্যেই টুকাই সুস্থ। অপূর্বাও খুশি। এরপর বাড়িতে নতুন নতুন রেসিপি টুকাইবাবুর জন্য। (Common Children’s Digestive Problems and Solutions)
আরও পড়ুন: কোষ্ঠকাঠিন্যে নাজেহাল বাচ্চার বেহাল পেটের হাল ফেরাতে কী খাওয়াবেন, কী খাওয়াবেন না!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null