রোগ প্রতিষেধক টিকা কী, কীভাবে কাজ করে; সন্দেহ কাটিয়ে সচেতন হোন আজই!

রোগ প্রতিষেধক টিকা কী, কীভাবে কাজ করে; সন্দেহ কাটিয়ে সচেতন হোন আজই!

পরমা আর প্রান্তিকের মধ্যে সকাল থেকেই প্রচন্ড ঝগড়া! কেউই কারও কথা মানতে চায় না। ঝগড়ার বিষয় হল বুবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়া। ছোট্ট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত কোন বয়সে কোন ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত, তা নিয়ে ওদের স্কুলে গতকাল একটি অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম হয়েছে। সেখানে অভিভাবক হিসেবে পরমা উপস্থিত ছিল। ও কথাগুলো বাড়ি ফিরে প্রান্তিককে জানানোর পর থেকেই অশান্তি। প্রান্তিকের মতে, বুবাইকে ১৪ বছর বয়সের পরে আর ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। এটা যে ভুল ধারণা, তা পরমা কিছুতেই বোঝাতে পারছে না। (Vaccination; Myths and Facts)

বুবাইয়ের বয়স এখন ছয় বছর। মা-বাবার ঝগড়ায় ও খুব বিরক্ত! শেষে ও-ই বলল, ডাক্তারকাকুর কাছে চল না। উনিই তো ভ্যাকসিন দেন। ছোট্ট বুবাইয়ের কথা দু’জনেরই মনে ধরল। ওরা ঠিক করলো এ ব্যাপারে ওর চিকিৎসকের পরামর্শই নেবে।

চিকিৎসক ওদের কথা শুনে জানালেন ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়ে অনেকেরই প্রান্তিকের মতো ভুল ধারণা রয়েছে। আসলে টিকা কী ও কেন দেওয়া হয়, তা অনেকেই জানেন না। (Myths and Facts about Immunization) এ কারণেই এমন কিছু ধারণা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসককে প্রান্তিক জিজ্ঞেস করলো, আপনি যদি একটু বিস্তারিত বলেন বাচ্চার জীবনে টিকার ভূমিকা কী, তবে খুব ভালো হয়। চিকিৎসক তখন এই বিষয়ে বিশদে বললেন।

 

টিকা কী? (What Is Vaccine?)

টিকা তৈরি হয় কোনও নির্দিষ্ট রোগের জীবাণুর থেকেই। কখনও মৃত জীবাণু থেকে আবার কখনও জীবাণুর দেহে থাকা প্রোটিন থেকে এটি তৈরি করা হয়। টিকা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল কোনও রোগের সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করা। এর জন্য আগে থেকেই ওই রোগের জীবাণুর অংশ শরীরে ঢুকিয়ে প্রয়োজনীয় রোগপ্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলা হয়। এতে ভবিষ্যতে ওই রোগের জীবাণু আশেপাশের পরিবেশে ছড়ালেও টিকা নিয়েছে এমন কাউকে আক্রমণ করে না।

 

টিকা কেন দেওয়া হয়? (Why Is Vaccine Important?)

আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তির প্রধানত দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশ হল জন্মগত ও অন্যটি হল অর্জিত বা সময়ের সঙ্গে তৈরি হওয়া। এর মধ্যে প্রথমটি জন্মের সময় ছোট্ট শিশু মায়ের শরীর থেকে পায়, আর পরের অংশটি পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে সে অর্জন করে। কিছু রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেই রোগটি না-হওয়া পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয় না। এই কারণেই টিকা দেওয়া হয়। (Embrace the Facts about Vaccines, Not the Myths)

কোনও রোগের জীবাণুতে যে প্রোটিন থাকে, নির্দিষ্ট রোগটির টিকা ওই প্রোটিন দিয়েই তৈরি হয়। একে বলা হয় অ্যান্টিজেন। তবে প্রোটিনটির প্রভাব জীবাণুর মতো একেবারেই শক্তিশালী নয়। এই প্রোটিন প্রবেশের ফলে খুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তার বিরুদ্ধে লড়ার চেষ্টা করে। এভাবেই রোগটির বিরুদ্ধে খুদের শরীর প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে।

 

টিকা কী ও কেন দেওয়া হয় বলার পরে চিকিৎসক বেশ কিছু ভুল ধারণা বা ‘মিথ’-এর কথা বললেন। এই মিথ-গুলো মানুষের মধ্যে বহুদিন ধরেই রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগুলোর কোনওটিরই ভিত্তি নেই। তাই চিকিৎসক মিথ-গুলোর পাশাপাশি আসল সত্যিটাও ওদের জানিয়ে দিলেন। (Vaccine Myths and Facts: Do You Know the Truth?)

#1. পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় (Fear About Side Effects): টিকার ফলে হওয়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছোট্ট সোনার শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমন ধারণা অনেক বাবা-মায়েরই মধ্যেই রয়েছে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতেই অনেকে টিকা এড়িয়ে চলেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ না-হলে খুদেকে টিকা দেওয়ান না।

সত্যি: পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমবেশি সব টিকাতেই থাকে।‌ এর কারণ শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি সম্পূর্ণ অচেনা অ্যান্টিজেনের সঙ্গে লড়াই শুরু করেছে। তবে কোনও টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই গুরুতর হয় না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা মায়ের ভয় অমূলক। ১০ হাজার শিশুর মধ্যে একটি শিশুর ক্ষেত্রে হয়তো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাব সামান্য বেশি হয়। শিশুর অবস্থা অনুযায়ী এটি নির্ভর করে।

 

#2. শিশু সম্পূর্ণ সুরক্ষিত (Baby fully Protected): সব টিকাই নিয়মিত দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ আমার চোখের মণি একদম সুরক্ষিত। আর ওই রোগগুলো ওকে ছুঁতে পারবে না। বাবা-মায়ের মধ্যে এমন ধারণার প্রচলনও দেখা যায়।

সত্যি: টিকা একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে ঠিকই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষমতাও দুর্বল হতে থাকে। তাই বেশ কিছু বছর পর রোগটির জীবাণু আক্রমণ করলে ও যে অসুস্থ হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তবে টিকা না-দিলে পরিস্থিতি যতটা গুরুতর হতে পারে, এক্ষেত্রে ততটা হয় না।

 

#3. শুধু শিশুদের জন্য (Vaccine For Kids Only): অনেকেই বিশ্বাস করেন, টিকা আসলে শিশুদের দেওয়া প্রয়োজন। শিশু বয়সে যেহেতু ওদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তাই ওদের টিকার প্রয়োজন হয়। খুদের বয়স ১৩-১৪ পেরিয়ে গেলে আর টিকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এমনটাই কিছু অভিভাবক মনে করেন।

সত্যি: বিশেষজ্ঞদের কথায়, এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ১৩-১৪ বছর বয়সের পরেও বেশ কিছু টিকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এমনকী ১৮ বছর বয়সেও টিকা দিতে হয়।‌ বেশকিছু রোগ রয়েছে যাদের টিকা ছোট্ট বয়সে দেওয়া সম্ভব নয়। সেগুলোর টিকা তাই বড় বয়সে নিতে হয়। এছাড়াও কিছু টিকা প্রতি বছরই একবার করে একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নিতে হয়।

 

আরও পড়ুন: টিকার ব্যথা আর নয়। ছোট্ট সোনার ভ্যাকসিনের ব্যথা কমানোর সহজ, ঘরোয়া রাস্তা!

 

#4. প্রাকৃতিক ইমিউনিটি-ই ভালো (Natural Immunity Is Better): অনেক অভিভাবকের মতে, প্রকৃতি থেকে শিশু যে রোগ প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করে, তা-ই ওর জন্য ভালো। টিকার নাকি দরকার নেই। (Anti-vaccination: Myths and facts)

সত্যি: প্রকৃতি থেকে অর্জিত অনাক্রম্যতা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আসলে রোগ থেকে সেরে ওঠার মাধ্যমে অর্জিত হয়। তবে আপনার সোনামণির এতে বিপদ বাড়তে পারে। কারণ কিছু রোগ আরও অন্য রোগের জীবাণুর জন্ম দেয়‌। ফলে একটি রোগ থেকে মুক্তি পেলেও আরেকটি রোগে অনেকটা সময় ভুগতে হয়। এর তুলনায় সোনামণির টিকা দেওয়া থাকলে ও সহজে‌ রোগ সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে পারে।

 

#5. টিকা গুরুত্বপূর্ণ নয় (Vaccines Not Necessary): রোগ হলে ঠিক মতো চিকিৎসা করলেই তা সারিয়ে তোলা যায়‌। তাই ওই রোগের টিকা আগে থেকে নিয়ে কোনও লাভ নেই। টিকা এড়িয়ে যেতে চাওয়া অনেক অভিভাবকই এমন কথা বলে থাকেন।

সত্যি: সব ধরনের সংক্রামক রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। একমাত্র গুটি বসন্তই সারিয়ে তোলা যায়। তাও সেটি অবস্থা বুঝে মাম্পস, হাম-এর আকারও ধারণ করতে পারে। টিকা নেওয়া থাকলে কোনও রোগ হলেও তা গুরুতর আকার ধারণ করে না। তাছাড়াও টিকা না-নেওয়া লোকের থেকে রোগ সংক্রমণের ভয় থাকে না।

 

#6. রোগটি এই দেশে নেই (Disease Doesn’t Spread In My Country): এই দেশে তো রোগটাই নেই। তবে ওই রোগটির টিকা নিয়ে কী হবে? চিকিৎসককে অনেক বাবা-মা এমন প্রশ্ন করে থাকেন।

সত্যি: বিশেষজ্ঞদের কথায়, রোগটি এদেশে না- থাকলেও অন্য দেশে থাকতে পারে। অথবা আজ না-থাকলেও কাল এই দেশে রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। তাই রোগটির টিকা নেওয়া থাকলে ছোট্ট সোনা তুলনায় নিরাপদ থাকে।

 

#7. অটিজম হওয়ার আশঙ্কা থাকে (Vaccine Cause Autism): কিছু নির্দিষ্ট রোগের টিকা দেওয়ার সঙ্গে শিশুর অটিজম হওয়ার একটি যোগসূত্র রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশিত হয় বিদেশে করা একটি ছোট পরীক্ষায়। এটি জানার পরেই মানুষের মধ্যে একটি ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনার পরে পরেই টিকা দেওয়ার হারও অনেক কমে যায়।

সত্যি: এই সমীক্ষাটি পরে ভুল প্রমাণিত হয়। যে জার্নালে সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়, তারাই এর পদ্বতিগত কিছু ত্রুটি খুঁজে পায়। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করে আসলে এমন কোনও যোগসূত্র নেই।

 

#8. টিকায় ক্ষতিকর পদার্থ থাকে (Vaccine Contains Harmful Ingredients): টিকা একটি রোগের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধশক্তি গড়ে তোলে। তবে এতে শরীরের জন্য ক্ষতিকর পদার্থও থাকে। তাই সব ধরনের টিকা মোটেই ভালো নয়। অনেক মা-বাবাই এমন মন্তব্য চিকিৎসককে জানান।

সত্যি: টিকার মধ্যে অতি সামান্য পরিমাণে ফর্ম্যালডিহাইড থাকে। এটি শরীরে যে ভাইরাস তৈরি হয় তাকেই নষ্ট করতে প্রয়োজন। এছাড়া কোনও কোনও টিকায় সামান্য পরিমাণে অ্যালুমিনিয়ামও উপাদান হিসেবে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞদের কথায়, এদের কোনওটিই শরীরে জমে শরীরের ক্ষতি করে না।

 

চিকিৎসকের মুখ থেকে এতরকম ভুল ধারণা শুনে প্রান্তিকের চক্ষু চড়কগাছ! পাশাপাশি ওর অনেক ভুল ধারণাও ও শুধরে নিতে পারল। পরমা এমনটাই চাইছিল। প্রান্তিক চেম্বার থেকে বেরিয়ে বলল, নাহ্, তুমিই ঠিক। বুবাইকে সব ক’টি টিকাই দেওয়া উচিত। আমরা একটা তালিকা করে নেব, যাতে ভুলে না যাই। (Vaccination; Myths and Facts)

 

আরও পড়ুন: জটিল ও মারণ নানা রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে সময় মেনে টিকা দিন আপনার শিশুকে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null