গর্ভাবস্থায় মেয়েদের শরীরে প্রচুর পরিবর্তন হয়। ভিতরে, বাইরে সবকিছু থেকে শরীর যেন “মা” হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পুরোদমে। শরীরের ভিতরের সব পরিবর্তন ধরা পড়ে ডাক্তারবাবুদের অভিজ্ঞ চোখে আর আল্ট্রা সাউন্ডের পর্দায়। আর বাইরের পরিবর্তন বলে দিতে তো আয়না আর প্রিয়জনেরাই যথেষ্ট। ওজনের হেরফের, স্পর্শকাতর ও ভারী ব্রেস্ট এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যপ্রদেশ (পেট) নিয়ে আপনি বেশ ওয়াকিবহাল, কিন্তু হবু সন্তানের পৃথিবীতে ঢোকার “প্রবেশদ্বার”টি কেমন আছে বা তার দেখভাল ঠিকমতো হয় কি না সে খবর রাখেন? আচ্ছা, আর হেঁয়ালি নয়। এমনিই হবু মা হিসেবে নানারকম আদেশ, উপদেশ আর শাসনের ঠেলায় আপনি অস্থির। তার ওপর যদি এত্ত হেঁয়ালির জাল বুনি, তাতে আপনার অসন্তোষের কারণ হব বই কি! যাই হোক, কথা বলছি হবু মায়ের যোনিপথ বা ভ্যাজাইনা নিয়ে। (how to take care of vagina during pregnancy in bangla, gorbhabosthay vaginar jotno. How to take care of Vagina during Pregnancy in Bengali.)
গোপনাঙ্গ হিসেবে গোপনে থাকলেও শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে এই ভ্যাজাইনার অবদান কতখানি তা কী আর বলতে হয়? প্রাণ সৃষ্টির প্রধান মাধ্যম এবং সেই প্রাণকে নিরাপদে পৃথিবীর আলো দেখানো, শুরু এবং শেষ, দুই ক্ষেত্রেই যোনিপথের গুরুত্ত্ব অনস্বীকার্য। স্বাভাবিক প্রসবে শিশু মায়ের গর্ভ থেকে এই যোনিপথের মাধ্যমেই বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আলো গায়ে মাখে। তাই, একে “জন্মদ্বার” বা পৃথিবীতে ঢোকার “প্রবেশদ্বার” বললে কি ভুল বলা হয়? গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ গোপনাঙ্গেও নানা পরিবর্তন ঘটে কিন্তু। এই পরিবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা ছাড়াও প্রয়োজন এর সঠিক পরিচর্যার। গর্ভাবস্থায় গোপনাঙ্গের যত্ন না নিলে কিন্তু ইনফেকশন, রোগ-জ্বালা আপনাকে ছেড়ে কথা কইবে না। আপনি তো ভুগবেন বটেই, পরোক্ষ প্রভাবে কষ্ট পেতে পারে গর্ভের প্রাণটিও। তাই চোখে দেখতে না পেলেও, নিজের গোপনাঙ্গের যত্নে কোনও ত্রুটি হতে দেবেন না। কীভাবে দেখভাল করবেন নিজের গোপনাঙ্গের এবং কীভাবে এড়িয়ে যাবেন ইনফেকশনের রক্তচক্ষু! এই নিয়েই আজকের প্রতিবেদন। দেখে নিন একনজরে। (how to take care of vagina during pregnancy in bangla, gorbhabosthay vaginar jotno)
#1. অতিরিক্ত যোনিস্রাব (Increased vaginal discharge)-> গর্ভাবস্থায় যোনিস্রাব (vaginal discharge)-এর পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায়। হবু মায়ের শরীরে হরমোনের দাপাদাপিই এর প্রধান কারণ বলা যায়। মায়ের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামক হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় তা প্রভাব ফেলে যোনিস্রাবের পরিমাণে। হবু মায়ের শরীরে রক্ত চলাচল ও রক্তের পরিমাণ দুইই বেড়ে যায়, এর ফলেও অতিরিক্ত স্রাব হয়ে থাকে। এই স্রাব সাদাটে, পাতলা দুধের মতো হয়ে থাকে। এর পোশাকি নাম লিউকোরিয়া (leukorrhea)। এর গন্ধও একটু অন্যরকম হয়ে থাকে। তবে, তা দুর্গন্ধ নয়। ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা যোনিস্রাবের মাধ্যমে শরীর যোনিপথকে ভিতর থেকে সুস্থ ও পরিষ্কার রাখে। যদি আপনি কর্মরতা হন এবং আপনাকে বাইরে বেরোতে হয়; তা হলে এসময় আপনি উন্নত মানের নরম প্যান্টি লাইনার ব্যবহার করতে পারেন।
#2.গন্ধে পরিবর্তন (Change in smell)-> রক্ত চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে যোনিপথের গন্ধে পরিবর্তন আসে।
#3.ইউ টি আই প্রবণ (Increased risk of UTI)-> গর্ভাবস্থায় ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (Urinary Tract Infections) হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়া জরায়ু মূত্রথলিতে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। এর পরোক্ষ প্রভাবে মূত্রথলি সবটা বর্জ্য শরীরের বাইরে বার করতে পারে না। এই কারণে ইউ টি আই বা ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। পরোক্ষ প্রভাব পরে ভ্যাজাইনার ওপরেও।
#4.ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস(Bacterial vaginosis (BV))-> গবেষকদের মতে, গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ১০-৩০%-এর এই ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। যোনিতে উপকারী ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সাম্য বজায় থাকে না বলেই, গর্ভবতী মহিলারা যোনির এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। এই অসুস্থতার যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তা হলে সময়ের আগে প্রসববেদনা ওঠা, বাচ্চার ওজন কম হওয়া, এমনকি গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
#5. ভ্যারিকস ভেনস-এর উঁকি (Appearance of Varicose Veins)-> রক্ত চলাচল বেড়ে যাওয়ায় ভ্যারিকস ভেনস (Varicose Veins) দেখা দিতে পারে যোনিতেও। পায়ে এদের আত্মপ্রকাশ আপনি স্বচক্ষেই দেখতে পাবেন। যোনিতেও যে এই ভেনস দেখা দিয়েছে, তা হয়তো আপনাকে জানাবেন আপনার ডাক্তার বা বিশেষ প্রিয়জন।
#6.রং পরিবর্তন (Color change)-> শরীরে হরমোনের আধিক্য এবং অতিরিক্ত রক্ত চলাচলের প্রভাবে বদল হয় যোনির রং। যোনিমুখের ঠোঁটের মতো অংশ বা লাবিয়াম (labium) এবং যোনিদ্বার বা ভাল্ভা(vulva), দুয়েরই রং বদলে যায়। তা হতে পারে ঘন নীল ঘেঁষা কোনও রং। বাচ্চার জন্মের পর যোনি আবার স্বাভাবিক রঙে ফিরে আসে।
#7.অবাঞ্ছিত চুলের আধিক্য (Unwanted hair)-> শরীরের অভ্যন্তরে ঘটা সব কারসাজির ফলে গোপনাঙ্গে বাড়-বৃদ্ধি হয় অবাঞ্ছিত চুলেরও।
#8.স্পর্শকাতর ভ্যাজাইনা (Sensitivity in vagina)-> এসময় ভ্যাজাইনা বা যোনি স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে। ফুলে থাকা এবং ভারী হয়ে থাকার অনুভূতিও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
#9.ইস্ট ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া (Increased chance of Yeast Infections)-> দেখা গেছে, হবু মায়েদের যোনি ইস্ট ইনফেকশন প্রবণ অঞ্চল হয়ে পড়ে। যথাযথ পরিচ্ছন্নতা এবং গোপনাঙ্গের pH ব্যালান্স নিয়ন্ত্রণে রাখলে এই ইনফেকশন রোধ করা সম্ভব।
সামান্য সতর্ক থাকলে ও নিজের খেয়াল রাখলে অনেক রোগ-যন্ত্রণা বা শারীরিক অস্বস্তির থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। গোপনাঙ্গের যত্ন নেওয়াও ঠিক এমনই একটা কাজ। শুধু গর্ভাবস্থায় বলে নয়, সাধারণ সময়েও এর যত্ন করা এবং যথাযথ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা একান্ত দরকার। গর্ভাবস্থায় যোনিস্রাবের পরিমাণ বাড়লেও তা কিন্তু দুর্গন্ধযুক্ত হয় না। যদি মনে হয়, যোনিস্রাবের রং অদ্ভুত বা গন্ধও অস্বাভাবিক; তা কিন্তু ইনফেকশনের লক্ষণ। দেরি না করে ডাক্তার দেখাবেন। গর্ভাবস্থায় যদি গোপনাঙ্গে অস্বস্তিকর চুলকানি, জ্বালা ভাব এবং অস্বাভাবিক ফুলে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null