উঁহু, লজ্জা পাবেন না। চলতি কথায় যাকে আমরা ‘বাতকর্ম’ বা ‘পাদ’ বলি, তার মাধ্যমেই আমাদের পেটে তৈরি হওয়া গ্যাস আমাদের পায়ুছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতটা পড়েই লজ্জায় মুখ লাল করে ফেললেন দেখছি! হ্যাঁ, এটা সত্যি যে বড়দের জন্য এই গ্যাস নির্গমন খুব একটা স্বস্তিদায়ক কাজ নয়। আবার যদি জনসমক্ষে এই গ্যাসবাবাজী তুমুল দুর্গন্ধ নিয়ে বিনা নোটিশে বেরিয়ে আসেন, তা হলে তো আপনার ওপর সহানুভূতি ছাড়া আর কিছু দেখানোর নেই। আপনার না হয় মাঝে মধ্যে এসব হল আর আপনি টুক করে ব্যবস্থা নিয়ে ফেললেন; কিন্তু বাচ্চার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বড্ড অন্যরকম। (How to reduce gas in babies in Bangla. Shishur gaser somsya ar somadhan.)
পুঁচকে মানুষ জন্মের পর প্রায় তিনমাস গ্যাসের সমস্যায় ভালো মতো ভোগে। প্রত্যেকদিন বাচ্চা বেশ কয়েকবার গ্যাস বার করে দেয়। জানেন কী? একটি নবজাতক শিশু যদি দিনে ১২-২১ বার গ্যাস বার করে দেয়, তা হলে সেটা বেশ স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। শিশুর পরিপাকতন্ত্র ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে এই সময়। এছাড়াও শিশু বাতাস গিলে নেওয়ার ফলে শিশুর পেটে অতিরিক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে যায়। পেটে গ্যাস জমে গেলে কিন্তু বড্ড অস্বস্তিতে পড়ে শিশুটি। বাচ্চা নিজে যেহেতু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, তাই ওকে সাহায্য করতে হবে আপনাকেই। কী কারণে শিশুর পেটে গ্যাস তৈরি হয় আর এই গ্যাস বার করা যায় কীভাবে, এই নিয়েই আজকের আলোচনা।
কীভাবে বুঝবেন বাচ্চার অতিরিক্ত গ্যাস হয়েছে? (Symptoms of a baby suffering from gas)
- বাচ্চার পেট শক্ত হয়ে থাকলে বা ফেঁপে থাকলে।
- বারবার পায়ুছিদ্র দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে এলে।
- খাওয়ানোর সময় ছাড়া সাধারণ সময়েও শিশু ঢেকুর তুলবে।
- শিশু অস্থির হয়ে পড়ে ও কান্নাকাটি করে।
- বাচ্চা পা দুটো ওপর দিকে তুলে রাখলে।
- খুব বেশি ‘দই তোলা’ মাঝে মাঝে গ্যাস জমার কারণে হয়।
- বাচ্চা ঘুমোতে চায় না এবং চনমনে থাকে না।
শিশুর পেটে গ্যাস হওয়ার কারণগুলি কী কী? (Reasons behind baby’s gas)
- শিশুর পেটে গ্যাস হওয়ার প্রধান কারণ পেটে বেশি বাতাস ঢুকে যাওয়া। ল্যাচিং-এর সময় শিশু এবং মায়ের মধ্যে যদি পজিশন ঠিকঠাক না থাকে, তা হলে শিশু বেশি বাতাস খেয়ে ফেলে। আবার শিশু যদি বোতলে খায় এবং সেই বোতলের নিপলের ছিদ্র বড় হয়, তা হলেও শিশুর পেটে অনেকটা বাতাস ঢুকে যায়।
- অতিরিক্ত খাওয়ার কারণেও শিশুর পেটে গ্যাস হয়।
- যেসব বাচ্চা ফর্মুলা খায়, বোতলে তাদের ফর্মুলা তৈরি করার সময় মায়েরা খুব করে ঝাঁকিয়ে দেন। অবশ্যই এতে জল ও ফর্মুলা ভালোভাবে মিশে যায়, কিন্তু প্রচুর ফেনাও ফাউ হিসেবে তৈরি হয়ে যায়। লক্ষ্য করে দেখুন, যত বেশি বোতল ঝাঁকাবেন, তত বেশি ফেনা তৈরি হবে। এই ফেনা শুদ্ধ ফর্মুলা কিন্তু বাচ্চার পেটে গ্যাস তৈরি করে।
- মায়ের খাদ্যাভ্যাসের কারণেও শিশুর পেটে গ্যাস তৈরি হয়।
- বাচ্চা খুব কাঁদলে কান্নার প্রাবল্যে সে অজান্তেই অনেক হাওয়া গিলে ফেলে। এর ফলে পেটে গ্যাস জমে যেতে পারে।
- কোনও সময় কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণেও শিশুর গ্যাস হতে পারে।
আরও পড়ুন :সদ্যোজাত শিশুর অ্যালার্জি; কারণ ও প্রতিকার
শিশুর পেটে গ্যাসের সমস্যার সমাধান করবেন কীভাবে? (How to reduce gas in babies?)
- শিশুর পেটে যাতে অতিরিক্ত বাতাস না ঢুকে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। স্তন্যপান করানোর সময় শিশুকে এমনভাবে রাখুন, যেন শিশুর বেশি বাতাস গিলে না ফেলে। যে ফিডিং বোতলে শিশু দুধ বা ফর্মুলা খায়, সেটা উল্টো করে ধরুন। যদি বোতলের নিপল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা দুধ পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে নিপলের ছিদ্র ঠিক আছে। যদি নিপল দিয়ে একনাগাড়ে দুধ বেরিয়ে যায়, তা হলে নিপলের ছিদ্র বড়। এই নিপলের ছিদ্র বড় থাকলে বাচ্চা খুব তাড়াতাড়ি খাবার চেষ্টা করে এবং বেশি বাতাস গিলে নেয়। এইরকম নিপল বা বোতল জলদি পাল্টে ফেলুন। বাজারে নামী কোম্পানির অ্যান্টি কলিক ফিডিং বোতল কিনতে পাওয়া যায়, কিনতে পারেন তাও। ঝাঁকিয়ে ফর্মুলা বানিয়ে নেওয়ার পর বোতলটি এক জায়গায় একটু রেখে দিন। ওপরের ফেনাগুলো চলে গেলে তবেই শিশুকে খাওয়ান।
- ঈষদুষ্ণ গরম জলে একটু হাত-পা মুছিয়ে দিন, বা স্নান করিয়ে দিন বাচ্চাকে। ও আরাম পাবে।
- মা যদি ডেয়ারি প্রোডাক্ট বেশি খান, তা হলে অনেকসময় বাচ্চার গ্যাস হতে পারে। বাচ্চা মায়ের দুধ খেলে, মায়ের খাদ্যাভ্যাসে কিছু রদবদল এনে দেখা যেতে পারে। আবার নতুন কোনও ফর্মুলা খাওয়া শুরু করার পর যদি শিশুর গ্যাস বেশি হয়, তা হলে হয়তো ফর্মুলার কোনও বিশেষ প্রোটিন তার সহ্য হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শিশুর ফর্মুলা কিনুন।
- বাচ্চাকে একটানা খাওয়াবেন না। খাওয়ানোর মাঝে ওকে সোজা করে নিয়ে একটু ঢেকুর তুলিয়ে দিন।বাচ্চাকে সোজা করে কোলে নিন। ওর মুখ যেন আপনার কাঁধের দিকে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে পিঠে চাপড়ে দিন। বাচ্চার গ্যাস ঢেকুরের মাধ্যমে বেরিয়ে যাবে। স্তন্যপান করানোর সময়ও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করুন।
- বাচ্চার পেট সামান্য গরম সরষের তেল দিয়ে ভালো করে মালিশ করে দিলে গ্যাস তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। গরম কালে মালিশের জন্য ব্যবহার করতে পারেন অলিভ অয়েল, নারকেল তেল বা বেবি অয়েল। এই সব তেল শিশুর শরীর ঠান্ডা করে আবার আলতো চাপ দিয়ে ভালো করে পেটে ম্যাসাজ করে দিলে পেটে জমা গ্যাস বেরিয়ে যায়। শিশু এতে খুব আরাম পাবে। শিশুকে স্নান করাবেন কুসুম কুসুম গরম জলে। এতেও শিশুর গ্যাসের সমস্যা কমবে।
- বাচ্চাকে একদম শুইয়ে রাখবেন না। একদম কচি বাচ্চা যেহেতু সারাদিন শুয়েই থাকে, তাকে একটু করে ব্যায়াম করিয়ে দিন আপনি। সাইকেল চালানোর ভঙ্গীতে ওকে একটু ব্যায়াম করিয়ে দিন। বা ওর দুই পা ধরে আস্তে আস্তে পেটের কাছে আনুন এবং সোজা করুন। এরকম কয়েকবার আস্তে আস্তে করে দিন। এতে পেটে জমা গ্যাস বেরিয়ে যায় ও অতিরিক্ত গ্যাস জমে যায় না। নরম তোয়ালে হাল্কা গরম জলে ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে পেটের ওপর সেঁক দিন। এতেও গ্যাস বেরিয়ে যাবে।
- খাইয়ে দিতে পারেন গ্রাইপ ওয়াটার।
- শিশু খুব কাঁদলে ওকে ভোলানোর চেষ্টা করুন। যত কাঁদবে ততই বেশি বাতাস খাবে ও। আর এর থেকে হতে পারে গ্যাস। ওকে আরামদায়ক ভাবে জড়িয়ে ধরুন, আদর করুন।
আরও পড়ুন : হেঁচকি খুকির, হেঁচকি খোকার; হেঁচকিতে যায় চেনা!
মনে রাখুন কয়েকটি বিষয় (Things to keep in mind)
- বাচ্চা যদি বেশ কদিন পটি না করে বা পটি খুব শক্ত হয় ও সাথে রক্ত থাকে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।
- বাচ্চা ক্রমাগত অস্বস্তিতে কাঁদলে, বমি করলে এবং তার জ্বর এলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- আবার যদি গ্যাস প্রচণ্ড দুর্গন্ধ যুক্ত হয় বা বাচ্চার লুজ মোশন শুরু হয়, তা হলে ডাক্তার দেখান। অনেক সময় বাচ্চার পেটে ইনফেকশনের কারণেও এটা হতে পারে।
- নিজে নিজে কোনও ওষুধ বাচ্চাকে খাওয়াবেন না। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তবেই খাওয়ান।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null