মনে রাখা খুব সহজ;  শিশুর জন্য ঘরোয়া প্রতিকার ও সহজ খাবারের হদিস!

মনে রাখা খুব সহজ; শিশুর জন্য ঘরোয়া প্রতিকার ও সহজ খাবারের হদিস!

আট মাস হল পাপান কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়েছে। পরের মাসেই ওর চার বছরের জন্মদিন পালন হবে। অন্য সব বাবা-মায়ের মতো ঋত্বিক আর ঈশানির চোখেও পাপানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। ঋত্বিক আর ঈশানি দুজনেই পেশায় অধ্যাপক। তারা চায় পাপানও একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠুক। তবে বাধ সাধছে ওর স্মৃতিশক্তি। (Ways To Improve Your Child’s Memory Power)

হামাগুড়ি দেওয়া যেদিন থেকে শিখেছে, সেদিন থেকেই অত্যন্ত দুরন্ত সে, কিছুতেই তাকে একজায়গায় বসিয়ে ওয়ান-টু লেখানো বা শেখানো যায় না। শেখালেও সব ভুলে যায়। ঈশানির ধারণা, দুরন্তপনার কারণেই ও যা শেখে সব ভুলে যায়। ঈশানি বেশ কিছুদিন ধরেই পাপানের এই সমস্যা নিয়ে ভাবছিল।

ইতিমধ্যে ঋত্বিক ওর এক মনোবিদ বন্ধুর কথা জানালো। ঈশানি তখনই ঠিক করলো ওকে নিয়ে দু’জনেই যাবে ওই মনোবিদের কাছে। ঋত্বিকের মনোবিদ বন্ধু সবটা মন দিয়ে শুনলেন। শুধু তিনি নন, তাঁর মতো অনেক বিশেষজ্ঞরাই পাপানের মতো এমন অনেক বাচ্চার মুখোমুখি হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাবা-মায়েরা নিরুপায় হয়ে তাঁদের কাছে ছুটে এসেছেন।

বিশেষজ্ঞদের কথায়, শিশুবয়সে বাচ্চার মস্তিষ্ক চারপাশের অনেককিছুই মুহূর্তের মধ্যে শুষে নেয়। কিন্তু কোনও কিছু মনে রাখার ক্ষেত্রে শুধু শুষে নেওয়াই যথেষ্ট নয়। বরং কীভাবে শুষে নিচ্ছে তাও জরুরি (Develop Super Memory)। এই কারণে পাপানের জন্য উনি বেশ কিছু উপায় বাতলে দিলেন।

 

স্বাভাবিক ভাবেই বাড়তে পারে মনে রাখার ক্ষমতা, জেনে নিন টিপস (Quick And Proven Techniques To Boost Your Child’s Memory)

#1. অল্প করে শিখুক: খাওয়ার সময় যেমন গোগ্ৰাসে খাবার গেলা উচিত নয়, তেমনই শেখার সময় একসঙ্গে অনেকটা শেখার চেষ্টাও ভালো নয়। এতে মনের মধ্যে সব দলা পাকিয়ে যায়। ছোট্ট সোনা তার খেলাধূলার পাশপাশি এবারের মাথার কাজ শুরু করবে। তাই শুরুতে একদম অল্প অল্প করে শেখাতে হবে। একবারে এক থেকে দশ পর্যন্ত না-শিখিয়ে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত শেখানো বেশি ভালো‌। সোনামণি কতটা নিতে পারছে তার উপর নির্ভর করবে কতটা পরিমাণ সে এক চেষ্টায় শিখবে।

#2. আসল জায়গাটা ধরিয়ে দিন: বাচ্চারা চারপাশ থেকে অনেক কিছুই শুষে নেয়। পড়ার সময়েও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। একটা অংশ তাকে পড়ালে সে একচেষ্টায় তার থেকে কিছু জিনিস শুষে নেয়। সেই শুষে নেওয়া জিনিসে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও থাকতে পারে। (Tips to Increase Concentration Power in Kids) তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন কিছু পড়ানোর সময় প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা ওকে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। এতে প্রথম চেষ্টাতেই ওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটাই মনে থাকবে।

#3. উদাহরণ দিয়ে শেখান: কোনও কিছু শেখার সময় উদাহরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখানোর বিষয়টা নিয়ে উদাহরণ দিলে শিশুর মনে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই নতুন কিছু শেখানোর সময় উদাহরণ দিন। মনোবিদরা বলেন, ও আশেপাশের যেসব জিনিসগুলো সারাদিন দেখছে, তাই নিয়েই উদাহরণ তৈরি করে দেওয়া উচিত। এতে আশপাশ সম্পর্কে ওর ধারণা যেমন আরও ভালো হবে, তেমনই শেখার বিষয়টাকে ও কাছে টেনে নেবে।

#4. খেলার মাধ্যমে শেখান: বাচ্চা সারাদিন খেলা নিয়েই ব্যস্ত। পড়াশোনায় মনোযোগ খুবই কম।‌ অনেক বাবা-মায়ের মতে, মনোযোগ এত কম হলে পড়া কী করে মনে থাকবে! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কথাটা ঠিক। তবে খেলাতেই যখন মনোযোগ বেশি, তার মাধ্যমেই তো পড়াশোনা শেখা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জোর দেন খেলাধূলার মাধ্যমে পড়াশোনার উপর। খেলাধূলার মাধ্যমে শিশু যখন নতুন নতুন জিনিস শেখে, তখন তা ওর মনে আরও ভালো করে গেঁথে যায়। (Ways Parents Can Help Kids Sharpen Their Memory) ফলে মনে রাখতেও সুবিধা।

#5. মেমোরি গেম: স্মৃতিশক্তি বাড়াতে মেমোরি গেম যথেষ্ট কার্যকর পদ্ধতি। এর জন্য শিশু-বয়স থেকেই ছোট্ট সোনার খেলাধূলার মধ্যে বেশকিছু মেমোরি গেম (Child Memory Games) রাখার চেষ্টা করুন। এই খেলাগুলো খেলতে খেলতেই ওর স্মৃতিশক্তির উন্নতি হবে। পরে পড়াশোনার মধ্যেও যার প্রতিফলন পড়বে। শুধু খেলা নয়, আশপাশের বিভিন্ন জিনিস চিনিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেও স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। যেমন একটি ফুলগাছ বা ফলের গাছ চিনিয়ে দিয়ে প্রতিদিন নিয়মিত জিজ্ঞেস করুন এই গাছের নাম কী? না পারলে বলে দিন, পরদিন আবার জিজ্ঞেস করুন।

#6. সারাদিনই শিখতে থাকুক: শিখতে গেলে বইয়ের সামনে বসতেই হবে এমন কোনও মানে নেই। বরং শেখার পদ্ধতিটি সারাদিনই চলতে পারে। সারাদিন একটি শিশু তার চারপাশে যা যা দেখে, সেগুলো থেকে তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে সাহায্য করুন। যেমন একটি ফুলের রং দেখে রং চিনিয়ে দিন। হাঁটার সময় পায়ের ধাপ গুণতে সাহায্য করুন। এভাবে সারাদিন ধরেই শেখার পরিবেশে কাটুক ওর সময়‌। (Effective Ways to Improve Memory Power of a Child) মনোবিদদের মতে, দৈনন্দিন রুটিন থেকে শেখার ফলে স্মৃতিশক্তি যেমন বাড়ে তেমনই বাড়ে শেখার প্রতি আগ্ৰহও।

 

আরও পড়ুন: ডিএইচএ কী? বাচ্চার সার্বিক বিকাশে ডিএইচএ অপরিহার্য কেন জানেন তো?

 

#7. শেখার স্থান পরিবর্তন করুন: ‘আমার ছেলে হাতেপায়ে খুবই দুরন্ত’ — বাবা-মায়েদের এমন অভিযোগ থাকলে, বিশেষজ্ঞরা শিশুর জন্য এরকম পরামর্শ দিয়ে থাকেন। একজায়গায় বেশিক্ষণ বসে শেখা কোনও বাচ্চার পক্ষেই সম্ভব নয়। ফলে শেখার জিনিসে আগ্ৰহ কমে, কমে যায় মনে রাখার ইচ্ছেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থান পরিবর্তন করলে বাচ্চাদের প্রতিদিনের একঘেয়েমি কেটে যায়। শেখার জিনিসের প্রতি নতুন করে আগ্ৰহ তৈরি হয়। শিশুর আগ্ৰহ না-থাকলে শেখানো বিষয় মনে রাখার ইচ্ছেও কমে যায়। তাই এই উপায়টি অবলম্বন করাই যায়।

#8. বকাবকি একেবারেই নয়: বাচ্চা পড়া মনে রাখতে পারছে না। এই কারণে অনেক বাবা-মায়েরাই বাচ্চাদের বকাবকি করেন। মনোবিদদের মতে, বকাবকি করে কোনওকিছু শেখানো একেবারেই উচিত নয়। এতে বাচ্চাদের মনে ভয়ানক প্রভাব পড়ে। পাশাপাশি শেখার প্রতিও তীব্র অনীহা তৈরি হতে পারে। তাই ছোট্ট খুদেকে কোনও বিষয় শেখানোর সময় ধৈর্য ধরতে হবে (Easy Ways to Enhance Your Child’s Memory)। কোনও মতেই ধৈর্য হারালে চলবে না।

মস্তিস্কের একটি বিশেষ অংশ স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই শিশুদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে শেখানোর বিভিন্ন পদ্ধতি যথেষ্ট নয়। বরং মস্তিষ্কের ওই অংশের উন্নতির জন্য নানারকম খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। ঋত্বিকের মনোবিদ বন্ধু পাপানকেও সেই খাবারগুলো খাওয়ানোর কথা বললেন।

 

কোন কোন খাবার স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তুলবে আপনার বাচ্চার (Best Food for Memory Boosting, Child Brain Development)

  • ডিম: অতিপরিচিত এই খাবারটি শিশুদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ডিমের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন ছাড়াও থাকে কোলিন নামক একটি জৈব উপাদান। এটি মস্তিষ্কের স্মৃতি জমা রাখার অংশকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করে।

 

  • পিনাট বাটার: পিনাট বাটারের স্বাদের জন্য অনেক বাচ্চাদেরই এটি অত্যন্ত প্রিয় খাবার। পিনাট বাটারে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নার্ভের মেমব্রেন বা পর্দাকে সতেজ রাখে। ঘরোয়া রেসিপি দেখে নিন সঙ্গের ছবিতে->

Homemade peanut butter in Bengali

  • স্যামন মাছ: অনেক খুদে সোনাই ছোট বয়স থেকে মাছ খেতে ভালোবাসে। তাদের প্লেটে অনায়াসে রাখাই যায় স্যামনের টুকরো। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে ও মস্তিষ্ককে উন্নত করতে স্যামন মাছের কথা সব বিশেষজ্ঞরাই বলে থাকেন। স্যামন মাছে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ডিএইচএ ও ইপিএ। এই তিনটি উপাদানই ছোট্ট সোনার স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

 

  • ওটস: ওটস-এ প্রচুর পরিমাণ শক্তি। বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশ ও কার্যক্ষমত বৃদ্ধির জন্য সবকিছুর আগে শক্তির প্রয়োজন। পর্যাপ্ত শক্তি না-পেলে মস্তিষ্কের কোষ ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। যার প্রভাব পড়ে স্মৃতিশক্তির উপর (Types of Foods to Help Boost Your Memory)। ওটস্-এর ব্রেকফাস্ট বাচ্চাকে সেই শক্তির জোগান দেয়।

ঋত্বিকের বন্ধুর থেকে পরামর্শ নিয়ে ঈশানি পাপানকে সেভাবেই পড়ানো শুরু করে। পাশপাশি ওর ডায়েটচার্টও মনোবিদের পরামর্শ মেনেই সাজানো হয়। এমনটা বেশ কিছুদিন চলার পর ঈশানি হাতেনাতে ফল পেতে শুরু করলো। আগের তুলনায় পাপান এখন বেশি মনে রাখতে পারে। মায়ের প্রশ্নের চটপট উত্তর দেয় সে। দুরন্তপনা যদিও একটুও কমেনি। ঈশানিও এখন আর কমাতেও চায় না। কারণ দুরন্তপনার মধ্যে দিয়েই ওর ছোট্ট খুদে শিখে নিচ্ছে নতুন নতুন জিনিস‌। (Ways To Improve Your Child’s Memory Power)

 

আরও পড়ুন: অপুষ্টিই ঘটাতে পারে শিশু-মৃত্যু! সচেতন হোন আজই!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null