ছোটবেলায় সবারই নাকি হাম হয়। ইন্দ্রনীল এমনটাই শুনে এসেছে মায়ের থেকে। অন্য শিশুদের মতোই তারও ছোটবেলায় হাম হয়েছে। যদিও সেই স্মৃতি ইন্দ্রনীলের নেই। তার মামাতো-মাসতুতো-খুড়তুতো সব ভাইবোনের কখনও না কখনও হাম হয়েছে। এবং সকলের ক্ষেত্রেই ছোটবেলাতেই হয়েছে। এত কিছু জানলেও হাম অসুখটা আসলে কেমন, সেটা ইন্দ্রনীলের জানা ছিল না। মায়ের মুখে সে শুধু শুনেছে, পক্স বা বসন্ত রোগ যেমন হয়, হাম-ও তেমনই খুব কমন একটা অসুখ। (What to Do if Your Child Gets the Measles)
কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরার যখন সারা গায়ে লাল-লাল ফুসকুরির মতো বেরোতে শুরু করল, ইন্দ্রনীলের মাথায় প্রথমেই এল—হাম! ইরা ইন্দ্রনীলের কন্যা। এখন বয়স মোটে এক মাস। ইন্দ্রনীলের স্ত্রী কস্তুরীও হামের বিষয় বিশেষ কিছু জানে না। ফলে দু’জনে মিলে ইরাকে নিয়ে ছুটল চিকিৎসকের কাছে। দিল্লিতে হুট বলতেই চিকিৎসক পাওয়া একটু কঠিন। তার উপর অবাঙালি চিকিৎসক।
এটা হাম কি না, জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ইন্দ্রনীলের গলদঘর্ম অবস্থা। ‘হাম’-এর ইংরেজি কিছুতেই মনে আসে না। শেষে মনে পড়ল মিজল (Measles)। ডাক্তারবাবু অবশ্য ইন্দ্রনীল-কস্তুরীর কথা শুনে খুব হাসলেন। উনি বললেন, এত চিন্তার কিছু নেই। এটা বর্ষার মরসুমের সাধারণ র্যাশ। হাম নয়! সে তো না-হয় হল। কিন্তু হাম হলে বোঝা যাবে কীভাবে? (Bacchar Ham Hole Ki Koronio?)
লাল-লাল র্যাশ মানেই হাম নয়। চিনে নিন, হামের উপসর্গ!
(Sign of Measles)
ডাক্তারবাবু বলে দিলেন সেই লক্ষণগুলোও। হাম বা মিজলের ক্ষেত্রে মাথা থেকে শুরু করে বাড়তে বাড়তে সারা গায়ে র্যাশ হবেই। কিন্তু তার আগেই বেশ কয়েকটি লক্ষণ থেকে বোঝা যায়, হামের আশঙ্কা রয়েছে কি না।
প্রাথমিক ভাবে এগুলোই হামের লক্ষণ। (Sign of measles) এ থেকে অনেক বাবা-মা মনে করেন, তাঁদের সন্তানের হয়তো সাধারণ জ্বর বা কোনও ইনফেকশন হয়েছে। কিন্তু হামের ক্ষেত্রে এর পরেই মাথা বা ঘাড়ের আশপাশে র্যাশ বেরতে শুরু করে। তারপর সেই র্যাশ সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। শিশুর চোখে প্রদাহ শুরু হয়। জোরালো আলোয় শিশুর মারাত্মক অসুবিধা হতে থাকে।
হাম খুবই ছোঁয়াচে অসুখ; জেনে নিন ছড়ায় কীভাবে?
(How does measles spread?)
হামের লক্ষণগুলো তো জানা গেল। কিন্তু জেনে রাখা দরকার, হাম ছড়ায় কীভাবে। সেটা জানা থাকলে, শিশুকে এই সমস্যা থেকে কিছুটা দূরে রাখা যাবে। বা সহজে তার প্রতিকার করা যাবে।
যেহেতু হাম অত্যন্ত সাধারণ একটি অসুখ এবং অধিকাংশ শিশুরই হাম হয়, তাই বাবা-মা হিসেবে আপনার জেনে রাখা উচিত আপনার সোনার এই সমস্যা হলে, তখন কী করবেন। শুধু একা আপনার শিশুর না, আপনারও হাম হতে পারে। তখনও এই পদ্ধতিগুলোই আপনাকে মনে রাখতে হবে।
সোনার গায়ে লাল-লাল র্যাশ, হাম নিশ্চিত হলে আপনার করণীয়
(What to do if you or your child gets the measles)
#1. অন্যদের থেকে দূরে রাখুন: যাঁর হাম হয়েছে, তাঁকে অবশ্যই অন্যদের থেকে দূরে রাখতে হবে। তা না-হলে তার থেকে এই অসুখ বাকিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু র্যাশ দেখা না-দিলে অনেকেই বুঝতে পারেন না, এটা হাম কি না, তাই অসুখ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বাড়িতে যদি এমন কোনও সদস্য থাকেন, যাঁর হামের টিকা নেওয়া হয়নি, তা হলে ততক্ষণাৎ তাঁর বিষয়ে চিকিৎসকরে সঙ্গে কথা বলুন। কীভাবে তাঁকে এই সমস্যা থেকে দূরে রাখা যায়, জেনে নিন। (What Can Measles Cause)
#2. ভিটামিন এ দিতে হবে কি?: ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগ্যানাইজেশন বা হু (WHO)-এর পরিসংখ্যান বলছে, যাঁদের শরীরে ভিটামিন এ-র অভাব রয়েছে, তাঁরা বেশি পরিমাণে হামে আক্রান্ত হন। (Treatment for Measles) শুধু তাই নয়, তাঁদের ক্ষেত্রে এই অসুখ বড় আকারও ধারণ করতে পারে। তাই আপনি নিজে বা বাড়ির অন্য কোনও সদস্য বা আপনার ছোট্ট সোনা যদি এই অসুখে আক্রান্ত হয়, তা হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন ভিটামিন এ-র সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে কি না।
#3. বিপদের কথা মাথায় রাখুন: হাম খুব কমন একটি অসুখ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, হাম হলে আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। মনে রাখবেন, পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সের শিশু বা ২০ বছরের চেয়ে বেশি বয়সের মানুষের মানুষের ক্ষেত্রে হাম সব চেয়ে বাড়াবাড়ি আকার ধারণ করতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা যদি খুব বেড়ে যায় (১০৩.৫ ডিগ্রি) তা হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এই অসুখ বড় আকার ধারণ করলে, মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। (Treatment of Measles in Infants) খেয়াল রাখুন আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশু কোনও অস্বাভাবিক আচরণ করছে কি না, বা খুব ঝিমিয়ে থাকছে কি না, তা হলে বুঝতে হবে মস্তিষ্কে সংক্রমণ হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
#4. জ্বর কমানোর ওষুধ: মনে রাখবেন, হাম বা মিজল-এর ভ্যাকসিন থাকলেও, একবার এই অসুখ হলে তা দ্রুত সারিয়ে ফেলার কোনও ওষুধ নেই। ফলে অসুখটা নিজে-নিজে সারার সময় দিতেই হবে। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শে আক্রান্তকে বেশ কিছু ওষুধ খাওয়াতে হবে। (How to Protect Your Children During a Measles Outbreak) তার মধ্যে যেমন রয়েছে সাপ্লিমেন্ট, তেমনই রয়েছে শরীরের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ। এই অসুখে শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে মস্তিষ্কে চাপ পড়তে পারে। সেই অবস্থা থেকে বাঁচতেই জ্বর কমানোর ওষুধ খাওয়ান আক্রান্তকে। তবে আলাদা-আলাদা বয়সে ওষুধের মাত্রাও আলাদা হবে। কোন ওষুধটা আদর্শ, সেটা বলতে পারবেন একমাত্র চিকিৎসকই। (Bacchar Ham Hole Ki Koronio?)
আরও পড়ুন:বাচ্চার ভাইরাল ইনফেকশনে যত্ন নেবেন কীভাবে?
#5. জলের ঘাটতি না-হয় যেন: এই সমস্যায় শরীর খুব শুকিয়ে যায়। এবং তাতে জীবাণু আরও সক্রিয় হয়ে পড়ে। যদি আপনার সোনার হাম হয়, তা হলে ওকে যতটা সম্ভব হাইড্রেটেড রাখার চেষ্টা করুন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে একটু বেশি পরিমাণে জল খাওয়ান। (Kids Health Info) নুন-চিনির জলও খাওয়ানো যেতে পারে। আক্রান্ত মানুষটি যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন, তা হলেও তাঁকে বেশি পরিমাণে জল খেতে হবে। যত বেশি পরিমাণে জল পান করানো যাবে, অসুখটি বাড়াবাড়ি জায়গায় যাওযার আশঙ্কা তত কমবে। (Measles – Caring for Kids)
#6. পুঁচকের যত্নে বিশেষ টিপস: হামের জ্বর হলে কুসুম গরম জলে তোয়ালে বা নরম গামছা ভিজিয়ে হালকা করে রোজ শরীর মুছিয়ে দিন। মনে রাখবেন, হামে আক্রান্ত হওয়ার সাথে স্নানের কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। (Can a Baby With Measles Take a Bath) বাচ্চার স্নান বন্ধ করে তাই অজান্তে বিপদ বাড়াবেন না। খাবারদাবারও স্বাভাবিক থাকবে পুরোপুরি। প্রোটিন খাওয়ান বেশি করে। সাথে চলুক তরল খাবারও। হাম একবার হানা দিলে আপনার সোনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় অনেকখানি। ফলত হামে আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিনের ভিতর বাচ্চার নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই হাম সেরে গেলেও সতর্ক থাকতে হবে আরও কিছুদিন। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো, আর বাড়তি যত্ন নিতে হবে বাচ্চার। (Measles Food to Avoid)
অসুখের লক্ষণ এবং অসুখ হলে কী কী করতে হবে, সে কথা তো হল। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, অসুখটির বিষয়ে সতর্কতা। সব কথার শেষে ইন্দ্রনীল এবং কস্তুরীকে চিকিৎসক বুঝিয়ে দিলেন সেটাও।
হামের প্রতিকার; আসলে সবসময়ই ভোগার চেয়ে সতর্কতা শ্রেয়
(Prevention of measles)
হাম বা মিজল নিয়ে মোটেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেহেতু এটি খুব ছোঁয়াচে অসুখ, তাই সাবধানতা বজায় রাখতেই হবে। আর আপনি কিংবা আপনার সোনা যদি এই অসুখে আক্রান্ত হন? তা হলে তখন চিকিৎসক যেমনটি বলবেন, তেমনটি মেনে চললেই হল। খুব অল্প দিনেই মুক্তি পাবেন সমস্যা থেকে। (What to Do if Your Child Gets the Measles)
আরও পড়ুন: বাচ্চার ঠান্ডা লাগার ধাত? ঘরোয়া খাবারেই সমাধান আছে সাধারণ সর্দি-জ্বর, খুশখুশে কাশির
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null