দুধ খাওয়ানোর পর তোলাতেই হবে ঢেকুর। কীভাবে? জেনে নিন সহজ পথ!

দুধ খাওয়ানোর পর তোলাতেই হবে ঢেকুর। কীভাবে? জেনে নিন সহজ পথ!

গত দু’দিন ধরে ছোট্ট রিঙ্কি কিছুতেই দুধ খাচ্ছে না। অল্পক্ষণ দুধ খাওয়ার পরেই ওর মুখ দিয়ে দুধ বেরিয়ে আসছে। দুধ খাওয়ানোর পর অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে, কিছুতেই সে কান্না থামানো যাচ্ছে না। (How To Burp Your Babies, Tips & Positions)

রিঙ্কি হল রিমা আর কৌশিকের একমাত্র সন্তান। বয়স মোটে তিনমাস। খাওয়া নিয়ে রিঙ্কির এমন সমস্যা জন্মের পর থেকে ছিল না‌। স্বভাবতই রিমা আর কৌশিক দু’জনেই এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। কৌশিকই বলল, সমস্যাটা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সেই মতো তারা চিকিৎসকের চেম্বারে হাজির। চিকিৎসক সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন, রিঙ্কির মূল সমস্যা খাওয়াদাওয়া নিয়ে নয়, বরং পেটে জমে থাকা অতিরিক্ত বায়ু নিয়ে। কথাটা রিমার বোধগম্য হল না। চিকিৎসকই তখন রিঙ্কির সমস্যাটা ওদের বুঝিয়ে বললেন।

একবছরের কমবয়সি শিশুদের প্রধান খাদ্য হল দুধ। দুধ খাওয়ার সময় কিছু পরিমাণ বায়ুও বাচ্চার পেটে চলে যায়। এই বায়ুর কারণে অনেক শিশুই খাওয়ার সময় অস্বস্তিবোধ করে, যা রিঙ্কির ক্ষেত্রে হচ্ছিল। এর কারণে যথেষ্ট পরিমাণে খাবার খাওয়ার আগেই শিশুর পেট ভরে যায়। এই বায়ু খুদের পেট থেকে কীভাবে বের করা সম্ভব? (Burping a Baby Basics)

রিমার প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক বললেন, ঢেকুরের মাধ্যমে পেটের এই অতিরিক্ত বায়ু সহজেই বের করা যায়। তবে একরত্তি বাচ্চা নিজে ঢেকুর তুলতে পারে না। কারণ ওদের খাদ্যনালী প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পরিণত নয়। অপরিণত খাদ্যনালী থেকে সহজে বায়ু উপরের দিকে ওঠে না। তাই বাবা-মাকেই ঢেকুর তুলতে ওকে সাহায্য করতে হয় (How to Burp Your Baby)।

 

কেন ঢেকুর তোলা দরকার (Why Burping is Important?)

ছোট্ট খুদের ঢেকুর না-উঠলে কী সমস্যা হতে পারে? জিজ্ঞেস করেছিল কৌশিক। চিকিৎসক তার উত্তরে জানালেন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা।

  • পেট ভরবে না: বৃদ্ধির বয়সে পেট ভরে খাওয়াদাওয়া একটি শিশুর খুবই প্রয়োজন। পেটে বায়ু জমে থাকলে তা খাবারের জন্য জায়গা কমিয়ে দেয়। যার ফলে পেট ঠিকমতো ভরার আগেই শিশু খাবারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমনটা দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকলে ছোট্ট শরীরে অপুষ্টিজনিত সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
  • মেজাজ বিগড়ে যাবে: পেটে জমে থাকা বায়ু অনেকসময় খাদ্যনালী বরাবর বুকের নীচে হওয়া ব্যথার জন্য দায়ী। এর পোশাকি নাম গ্যাস্ট্রোএসোফেগাল রিফ্লাক্স। এই ব্যথা যথেষ্ট তীব্র হয়। স্বভাবতই একরত্তি শিশুর পক্ষে এই ব্যথা বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। যে কারণে ছোট্ট খুদে কান্নাকাটি করতে থাকে ও খাবার খেতে চায় না।
  • বমির প্রবণতা: পেটের বায়ুর কারণে শিশুর পরিমাণমতো না-খেয়েই খাবারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই সময় তাকে জোর করে খাওয়ানো হলে খাবার বমি হয়ে যেতে পারে। এর পিছনেও রয়েছে এসোফেগাল রিফ্লাক্স। বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী ধাক্কার ফলে খাবার পেটে না-গিয়ে মুখ দিয়ে বমি হয়ে বেরিয়ে আসে।

ঢেকুর ওঠা শিশুর খাবার খাওয়া ও ঠিকমতো হজম করার জন্য দরকার। তবে কীভাবে একরত্তি শিশুকে ঢেকুর তোলানো যায়? চিকিৎসক বললেন, ঢেকুর তোলানোর বেশকিছু উপায় আছে। সেই উপায়গুলো তিনিই প্রেসক্রিপশনে পরপর লিখে দিলেন।

 

ঢেকুর তোলানোর নানা পদ্ধতি (Baby Burping Tricks)

#1. ঘাড়ে শুইয়ে: ছোট্ট খুদেকে এক্ষেত্রে ঘাড়ে শোয়াতে হবে। খেয়াল রাখুন যাতে শোয়ানোর সময় ওর পেট আপনার কলার বোনের কাছে থাকে। এবারে পিঠে গোল গোল করে বা উপর থেকে নীচের দিকে হাত বোলা‌ন। হাত বোলানোর সময় ওর পেটের কাছটায় কন্ঠার হাড়ের মাধ্যমে আলতো চাপ প্রয়োগ করুন।

#2. পায়ে বসিয়ে: এই পদ্ধতিতে পায়ের থাইয়ের উপর ছোট্ট শিশুকে বসাতে হবে। এবারে এক হাতের তালু ওর বুকের নীচের দিকটায় রাখুন। আরেক হাত পিঠে উপর থেকে নীচের দিকে বোলান। এতে সহজেই ঢেকুর উঠবে সোনামণির‌।

#3. হাতের উপর শুইয়ে: প্রথমে ওর থুতনিতে হাতের তালু রেখে হাতের উপর ছোট্ট শরীরটা ঝুঁকিয়ে দিন। হাতের উপর উবু থাকা অবস্থায় আরেক হাতের তালু ওর পিঠে উপর থেকে নীচের দিকে বোলান। এভাবে কিছুক্ষণ মালিশ করলে সহজেই ঢেকুর উঠবে।

#4. হাঁটুর উপর শুইয়ে: এই পদ্ধতিটিও আগের মতোই সহজ। এক্ষেত্রে প্রথমে আপনার পা অল্প ভাঁজ করে হাঁটু মাটি থেকে সামান্য উপরে তুলে নিতে হবে। এবারে বাচ্চাকে পায়ের উপর উবুড় করে এমনভাবে শোওয়ান যাতে ওর পেটের অংশ হাঁটুর উপর থাকে। এই অবস্থায় ওর পিঠে উপর থেকে নীচে হাত বোলাতে থাকুন কিছুক্ষণ। (Burp Your Baby The Right Way With These Helpful Tips)

 

আরও পড়ুন: কলিক খুবই স্বাভাবিক এক সমস্যা, আপনার পুঁচকের জন্য সমাধানও বাড়িতেই আছে

 

#5. বুকের কাছে হাঁটু: এই পদ্ধতিতে ঢেকুর তোলা বাচ্চার জন্য সুবিধাজনক। এক্ষেত্রে প্রথমে বাচ্চাকে একটি সমতলে চিৎ অবস্থায় শোওয়াতে হবে। এবারে ওর হাঁটু ভাঁজ করে ধীরে ধীরে ওর বুকের কাছে নিয়ে যান। আবার ধীরে ধীরে হাঁটু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।

#6. সাইক্লিং: এই পদ্ধতিটি বাচ্চার কাছে যেমন মজার, তেমনই এতে ঢেকুর তোলাও ওর জন্য সহজ। এই ক্ষেত্রে বাচ্চাকে আগের মতোই কোনও সমতলে শোওয়াতে হবে। এবারে ওর এক পায়ের হাঁটু ভাঁজ করে ধীরে ধীরে পেটের দিকে ওঠান। এই সময় ওর আরেকটি পা টানটান অবস্থায় থাকবে। প্রথম পা পেট পর্যন্ত ভাঁজ হলে এবারে আরেকটি পা ধীরে ধীরে ভাঁজ করতে থাকুন। এই সময় প্রথম পা ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন। এভাবে সাইকেলের প্যাডল ঘোরানোর মতো পদ্ধতিটি চলতে থাকবে। এতে খুব সহজেই পেটের অতিরিক্ত বায়ু বেরিয়ে যায়।
ছোট্ট খুদেকে ঢেকুর কীভাবে তোলানো যায় তা তো জানা গেল। তবে এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে বেশকিছু টিপস্ যা এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বনের সময় প্রয়োজন। চিকিৎসকরা পদ্ধতিগুলো বলার পাশপাশি এই সবকটি টিপস্ই মনে করিয়ে দেন (Burping Tips)।

 

সহজে ঢেকুর তোলানোর টিপস (Burping Tips)

  • হাতের কাছে ন্যাপকিন: অনেকসময় বাচ্চার ঢেকুরের সঙ্গে খাবারের কণা বা জলীয় পদার্থ উঠে আসে যা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়‌। এগুলো মুছে দেওয়ার জন্য হাতের কাছে ন্যাপকিন রাখা জরুরি।
    পিঠে হাত বোলানো: প্রত্যেক পদ্ধতি অবলম্বনের সময়ই পিঠে হাত বোলাতে হবে আস্তে আস্তে। সাধারণত একদম ছোট্ট সোনাদের পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিলেই কাজ হয়। তবে কিছুক্ষেত্রে হাত বোলানোর সময় সামান্য চাপপ্রয়োগও করতে হয় (How to Burp Your Baby)।
  • বাঁদিকে হাত বোলান: ছোট্ট সোনার পাকস্থলী পেটের ডানদিকে থাকে। অর্থাৎ পিঠের দিক থেকে বাঁদিকে তার অবস্থান । তাই পিঠে হাত বোলানোর সময় বাঁদিক ঘেঁষে হাত বোলাতে হবে। এতে সহজে ও তাড়াতাড়ি ঢেকুর উঠবে।
  • খাওয়ার সময় কান্না: খেতে খেতে হঠাৎ করেই ছোট্ট সোনা কাঁদতে শুরু করলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ পেটে জমে থাকা অতিরিক্ত বায়ু হতে পারে। তাই কান্নার আঁচ পেলেই খাওয়ানো থামিয়ে ওকে ঢেকুর তুলতে সাহায্য করুন।

বাচ্চাকে কীভাবে ঢেকুর তোলানো উচিত সে সম্পর্কে জানা থাকলেও অনেক মায়েরাই বুঝে পান না কখন ঢেকুর তোলানো দরকার। সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরাই বেশকিছু উপায় বলে থাকেন।

 

কখন তোলাবেন ঢেকুর (Baby Burping: What You Should Know)

  • খাওয়ানোর সময়: খাওয়ানোর মাঝে মাঝে ঢেকুর তোলানোর কথা সব চিকিৎসকই বলে থাকেন। এতে পেটের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়, যা খাবারের মাধ্যমে পূরণ হয়।
  • খাওয়ানোর পরে: খাওয়ানোর মাঝে তো অবশ্যই, খাওয়ানোর পরেও ঢেকুর তোলানো উচিত। এতে খাবার বমি করে ফেলবার প্রবণতা কমে। পাশাপাশি খাবার হজম করতেও ছোট্ট খুদের সমস্যা হয় না।

 

চিকিৎসকের কাছ থেকে বিস্তারিত শোনবার পর রিমার কাছে রিঙ্কির সমস্যাটা স্পষ্ট হয়ে গেল। দু’দিন ধরে ওর মনে জমে উঠেছিল নানা অজানা আশঙ্কা। সেগুলোও কেটে গেল সহজেই। এখন ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে রিঙ্কিকে খাওয়ানোর মাঝে মাঝে ঢেকুর তুলতে সাহায্য করে। আর রিঙ্কি তো লক্ষী মেয়ে। সেও কান্নাকাটি ছাড়াই দুধ খেয়ে নেয়। (How To Burp Your Babies, Tips & Positions)

 

আরও পড়ুন: বাড়তি খাবার পেটে গেলে বাচ্চার ঢেকুরের সঙ্গে তা বেরিয়ে আসে। এটা কিন্তু বমি নয়, রইল প্রতিকারের উপায়!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null