ঠিকঠাক সময়ে চিকিৎসা না হলে কৃমি ছড়িয়ে যেতে পারে সারা শরীরে। জেনে নিন উপশম!

ঠিকঠাক সময়ে চিকিৎসা না হলে কৃমি ছড়িয়ে যেতে পারে সারা শরীরে। জেনে নিন উপশম!

ক’দিন ধরেই বড্ড ফ্যাকাসে লাগছে পুঁচকেটাকে। কিছুই যেন মুখে রোচে না ওর। পছন্দের পদ রেঁধে দিলেও মুখ ফিরিয়ে সেই ‘না’। মাঝেই মাঝেই পেটে ব্যথায় কেঁদে উঠছে দস্যিটা। দাঁত কিড়মিড় করছে খালি খালি আর লালা ঝরছে মুখ দিয়ে। পেটটাও খানিক ফোলা ফোলা ঠেকছে বই কি! (Home remedies to treat worms in kids)

উদ্বেগ নয়, এসব আর কিছুই নয়। বাচ্চার পেটে কিলবিলে কৃমির উৎপাত। শিশুদের জটিল সমস্যাগুলির মধ্যে অন্য়তম। বিভিন্ন কারণে বাচ্চার শরীরে কৃমির উৎপাত হতে পারে যেমন- নিরাপদ ও বিশুদ্ধ জলের অভাব, অপরিচ্ছন্নতা, খাওয়ার আগে হাত না পরিষ্কার করা ও খালি পায়ে হাঁটা ইত্যাদি। আজকের এই প্রতিবেদনে এসব নিয়েই আলোচনা করব আমরা। বিচ্ছিরি কৃমির ইতিবৃত্তান্ত জানা থাকলে বাড়ন্ত বাচ্চার অসুখ-বিসুখ সামাল দেওয়ার কাজটাই অনেক সহজ হয়ে যায়। চটজলদি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই হলো। (Signs of Worms in Toddlers and Home Remedies to Deworm; Effective home remedies to treat worms in kids in Bangla)

কৃমি আসলে  কী? (Worm infection in young children)

নামটা যেমন বিচ্ছিরি, তেমনই বিদঘুটে এদের চেহারা-চরিত্তির। অদ্ভূত এই ক্ষতিকর পরজীবীগুলো মাঝেসাঝেই আক্রমণ করে আমাদের শরীরে। আর সেটা বাচ্চার শরীর হলে তাদের নাচানাচিটা যেন আরও বেড়ে যায়। কৃমির কূল সাধারণত আমাদের অন্ত্রে বাস করে, আমাদের শরীর থেকেই পুষ্টি গ্রহণ করে বেঁচে থাকে এবং আর আমাদের শরীরেই বংশবৃদ্ধি করে। কৃমির ডিম্বাণু আমাদের মুখ হয়ে শরীরে ঢুকতে পারে আবার ত্বকের সাহায্যেও লাভা হিসেবেও হানা দিতে পারে। অনেক সময় কৃমি আমাদের যকৃত বা অন্য কোনও অঙ্গতেও আক্রমণ করতে পারে। অনেকটা কেঁচোর মতো দেখতে হয় কৃমিগুলোকে, রংটা হলদে। পরিণত অবস্থায় একটি কৃমি ৬ থেকে ১৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে!

কীভাবে বুঝবেন কৃমি হয়েছে বাচ্চার? (Signs of worms in toddlers)

  • পেটে কৃমি হলে খাবারের প্রতি রুচি কমে যায় বাচ্চার। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয় সে। পেট ফেঁপে ফুলে যেতে পারে।
  • স্বাস্থ্য খারাপ হয়, ওজন বাড়ে না, বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শুরু হয় অপুষ্টির পালা। কেননা সে যা খায়, তার এক-তৃতীয়াংশই খেয়ে ফেলে বিচ্ছিরি কৃমির দল।
  • আয়রনের ঘাটতি ও রক্তশূন্যতার জন্য দুর্বলতা আসতে থাকে শরীরে। একটা কৃমি প্রতিদিন শরীর থেকে শূন্য দশমিক ১ মিলিলিটার রক্ত শোষণ করে নেয় যে!
  • কখনও কখনও এই কৃমির কারণেই অ্যালার্জি, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট, কফ-কাশি হতে পারে। হঠাৎ ডায়রিয়াও হতে পারে আপনার বাচ্চার।

বাচ্চার শরীরে কৃমি ঢোকে কীভাবে? (How Do Children Get Worms?)

  • ঘরের কাজে নোংরা ও অপরিশোধিত জলের ব্যবহার।
  • সবজি-আনাজ, ফল-মূল ভালো করে না ধুয়ে খাওয়া।
  • বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট না থাকা।
  • খাবারের আগে বা টয়লেটের পরে নিয়মিত হাত ধোওয়ার অভ্যাস না থাকা।
  • হাতের নখ বড় রাখা এবং দাঁত দিয়ে নখ কাটার অভ্যাস।
  • নোংরা জায়গায়, মাঠেঘাটে খালি পায়ে হাঁটা-চলা।
  • সময়মতো কৃমি নাশক ওষুধ নেওয়ায় গাফিলতি।

কৃমি নিয়ে কুসংস্কার ও ভুল ধারণা (Myths About Worm Infection In Young Children)

  • পেটে দু-চারটে কৃমি থাকা ভালো বা পেটে কিছু কৃমি না থাকলে খাবার হজম হয় না, অনেকেই এমনটা মানেন। এটি সম্পূর্ণ ভুল।
  • অনেকের ধারণা, বেশি মিষ্টি বা চিনি খেলে কৃমি হয়। এই ধারণাও একেবারেই ঠিক নয়।
  • মাছ খেলেও কখনও কৃমি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
  • কালমেঘ বা চিরতার জল খেলে কৃমি মরে যায়। অনেকেই এরকম ভেবে থাকেন। তা ঠিক নয়, কারণ কালমেঘ বা চিরতার অন্য অনেক ভেষজগুণ থাকলেও এতে কৃমি মরে বলে এখনও প্রমাণিত হয়নি।
  • কৃমির ওষুধ ঠান্ডার দিনে বা বৃষ্টির দিনে খাওয়াতে হয়, গরমে নয়! এরকম ধারণা অনেকের মধ্যে দেখা যায়। এরও কোনও যুক্তি বা ভিত্তি নেই।

কৃমি থাকলে কীসের আশঙ্কা! (Dangers Of Worms In Children)

বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের শরীরে বাসা বাঁধতেই বেশি আগ্রহী থাকে ক্ষতিকর এই পরজীবীর দল। ঠিকঠাক সময় যদি চিকিৎসা না হয়, কৃমি সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। আপনার বাচ্চাকে তাই নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়াতে ভুলবেন না। অন্তত ছয় মাসে একবার ওর ডি-ওয়ার্মিং হওয়া প্রয়োজন। কতটা দেবেন, কতবার দেবেন-এ বিষয়ে বিশদে জানতে দরকারে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিন।

বাচ্চার শরীর থেকে কৃমি তাড়াতে ঘরোয়া টোটকা (Effective home remedies to treat worms in kids)

ওষুধের পাশাপাশি ঘরোয়া কিছু টোটকাও কৃমির জন্য শরীরের অস্বস্তি থেকে আরাম দিতে পারে আপনার বাচ্চাকে। ঘরোয়া এই উপচারগুলি শরীর থেকে কৃমি হয়তো পুরোপুরি না-ও তাড়াতে পারে, তবে জোর দিয়ে বলা যায় এসবের ব্যবহারে কৃমির চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বেশ খানিকাটা সাহায্য হয়, পাশাপাশি এগুলো সংক্রমণও আটকে দেয়। দেখে নিন ১০টি টোটকা, যা খেলে কৃমির বংশ ধ্বংস হবে অচীরেই!

#1. রসুন (Garlic)

রসুন হল অ্যান্টি প্যারাসাইট খাবার। এতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাংগাল এবং অ্যান্টিসেপ্টিক উপাদান থাকে, যা শরীরের জীবাণু ধ্বংস করতে পারে। বাচ্চাকে কাঁচা রসুনের কোয়া চিবোতে বললে ঝামেলা করতে পারে, তাই ওর জন্য রইল অন্য পথ। দু’টি রসুন এক কাপ দুধে জাল দিন। দুধ উথলে এলে নামিয়ে ফেলুন। চামচে করে এবার এই মিশ্রণই বাচ্চাকে দিন। এক সপ্তাহ টানা খাওয়ান।

#2. নারকেল (Coconut)

কৃমি তাড়াতে বেশ কার্যকর একটি উপায় হল নারকেল! জল খাবারে এক টেবিল চামচ নারকেল কুচি খান। এর তিন ঘণ্টা পর এক গ্লাস কুসুম গরম দুধে দুই টেবিল-চামচ ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে খাইয়ে দিন ওকে। এটি নিয়মিত দিন আপনার বাচ্চাকে। তবে ক্যাস্টর অয়েল পাঁচ বছরের নীচের বাচ্চাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

#3. কাঁচা পেঁপে (Unripe Papaya)

আধ টেবিল-চামচ কাঁচা পেঁপের রস আর কয়েক ফোঁটা মধু গরম জলে মিশিয়ে নিন। রোজ সকালে খালি পেটে বাচ্চাকে খাওয়ান। আর একটা পথও আছে। পেঁপের দানা গুঁড়ো করে নিন। আধ কাপ কুসুম গরম দুধ বা জলের সাথে এক চা-চামচ পেঁপের গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। খালি পেটে তিনদিন খাওয়ান বাচ্চাকে।

#4. মিষ্টি কুমড়োর দানা (Pumpkin Seeds)

মিষ্টি কুমড়োয় থাকা বিশেষ উপাদান অন্ত্রের কৃমি মেরে ফেলে। তিন কাপ জলে দুই টেবিল-চামচ মিষ্টি কুমড়োর দানার গুঁড়ো মিশিয়ে ফুটতে দিন ৩০ মিনিট। ঠান্ডা হলে বাচ্চাকে দিন। এছাড়া এক টেবিল চামচ ভাজা মিষ্টি কুমড়োর দানার গুঁড়োর সাথে সমপরিমাণ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খাইয়ে দিন ওকে। এরপর জলখাবারে কলা বা কিউই দিন।

#5. কাঁচা হলুদ (Turmeric)

কৃমির যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার আরও একটি পথ হল কাঁচা হলুদ। হলুদে উপস্থিত কৃমিনাশক উপাদান কৃমিগুলোকে অকেজো করে দেয় এবং ডিমগুলো নষ্ট করে ফেলে। আধ গ্লাস গরম জলে কাঁচা হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে রোজ একবারটি করে বাচ্চাকে দিন। ওকে হলুদ মেশানো দুধও দিতে পারেন। এক সপ্তাহ এই রুটিন মানুন। উপকার পাবেন।

#6. গাজর (Carrots)

কৃমি তাড়াবে গাজর? অবাক হওয়ারই কথা। গাজরে বিশেষ কিছু ভিটামিন, মিনারেল এবং জৈব উপাদান থাকে যা কৃমির ডিম ধ্বংস করতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে। গাজরে উপস্থিত উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি, বেটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন-এ এককথায় কৃমির যম। ভিটামিন-এ কৃমির ডিম ধ্বংস করে এবং ভিটামিন-সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা কৃমির বারবার ফিরে আসাকে প্রতিহত করে।

#7. নিম (Indian Lilac)

নিমেও আছে অ্যান্টি প্যারাসাইটিকাল উপাদান, অন্ত্রের কৃমি মারতে যার কোনও তুলনাই নেই। গরম দুধে নিমের গুঁড়ো আর মধু মিশিয়ে হপ্তায় দু’বার বাচ্চাকে দিতে পারেন। মাখনে রোস্ট করে ভাত বা পাউরুটির সাথে দিতে পারেন। এতেও যদি বাচ্চার আপত্তি হয়, তা হলে এক গ্লাস গরম জলে আধা চা-চামচ নিমের পেস্ট মিশিয়ে খালি পেটে খাইয়ে দিন ওকে। এক সপ্তাহ এই নিয়ম মানুন, কৃমি পালাতে বাধ্য।

#8. করলা (Bitter gourd)

তেঁতো খাবার বলতে প্রথমেই মাথায় যে খাবারটা আসে, তাই হল করলা। কৃমি তাড়াতে এই করলাকে কিন্তু ভুললে চলবে না। বাচ্চার পেটের ভিতর কৃমির সঙ্গে মল্লযুদ্ধে আমাদের সব্বার ‘অপ্রিয়’ করলাই সিদ্ধহস্ত। এক কাপ করলার রস জল আর মধুর সাথে মিশিয়ে দু’দিন অন্তর বাচ্চাকে দিন।

#9. লবঙ্গ (Cloves)

লবঙ্গে থাকা অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টি পারাসাইটিক, ব্যাকটিরিসাইডাল উপাদান কৃমির ডিম ধ্বংস করে দেয়। এক কাপ গরম জলে এক চা-চামচ লবঙ্গের গুঁড়ো মিশিয়ে ১০-২০ মিনিট জ্বাল দিন। বাচ্চাকে এটি দিনে দু’বার দিন। এক সপ্তাহ এমন চলতে থাকুক, দেখবেন কৃমি অকালে প্রাণ হারিয়েছে।

#10. জোয়াান (Carom seeds)

ছোট, তবে একেবারেই খাটো নয়। জোয়ান থাইমলের মতো উপাদানে ভরপুর, যা অন্ত্রে কৃমির বাড়বৃদ্ধি রোধ করে। জোয়ানের সাথে যদি গুড়ও হাত মেলায়, পেটের ভিতর কৃমির বিরুদ্ধে মহাভারতের যুদ্ধ চলে যেন। দিনের শুরুতে ছোট এক টুকরো অথবা এক চা-চামচ নরম গুড় খাইয়ে দিন বাচ্চাকে। খালি পেটে কিন্তু! মিনিট পনেরো পর একটি চামচের এক ভাগের তিন ভাগ জোয়ান গুঁড়ো জলের সাথে মিশিয়ে দিন। ১৫ দিন এই রুটিন মেনে চলুন। পরিবার-সমেত কৃমি পালাবে বাচ্চার পেট ছেড়ে।

সব শেষে বলতে চাই, কৃমির উৎপাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একাধিক ঘরোয়া চিকিৎসা রয়েছে। তারই ভিতর ১০টির কথা বললাম আমরা। এগুলো একদিকে যেমন সহজলভ্য, অন্য দিকে ঝামেলামুক্ত। তবে, আপনার বাচ্চার কৃমির সমস্যা কতটা মারাত্মক তার উপর নির্ভর করবে আপনি ঘরোয়া চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন, নাকি ডাক্তারের দ্বারস্থ হবেন। কৃমির আক্রমণে যদি দ্রুত ওজন কমতে থাকে, বাচ্চা দিনভর ক্লান্ত থাকে, অ্যানিমিয়া বা অন্য রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে আর ঘরোয়া চিকিৎসা চালিয়ে না গিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়!

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null