সাধারণ প্রসবের যন্ত্রণা এড়াতে যতই আমরা সি-সেকশনের দিকে ঝুঁকি না কেন, এর ধকলও কিছু কম নয় কিন্তু। যতই যাই বলুন, এ-ও তো একটা অস্ত্রোপচারই বটে! পেটের ক্ষত নিয়ে সদ্যজাতকে সামলানো চাট্টিখানি কথা নয় একেবারেই। বরং এই ক্ষেত্রে সেরে উঠতে সময় লেগে যায় অনেকটা!
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের তিন-চারদিনের মধ্য়েই বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় নতুন মাকে। তারও যদিও একটা কারণ আছে। এসব সত্ত্বেও বাড়ি ফেরার পর থেকেই মাথাচাড়া দিতে থাকে নানান জটিলতা! যার কিছু আমাদের বড্ড চেনা, কিছুর সাথে আবার পরিচয়ই হয়নি কোনওদিন।
এই জানা-চেনা জটিলতার ভিতরই সবচেয়ে সাধারণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য! অস্ত্রোপচারের পর-পরই ধরেবেঁধে আপনাকে বাড়ি পাঠানোর তোড়জোড় হয় এই কোষ্ঠকাঠিন্যের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই! কেননা যত তাড়াতাড়ি আপনি হাঁটাচলা, নড়াচড়া শুরু করবেন, ততই রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা কমবে। সেই সঙ্গে আশঙ্কা কমবে অযাচিত কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনস্টিপেশনেরও! (Home Remedies of Constipation After C Section in Bangla. C-section-er por kosthokathinyo.Home Remedies of Constipation After C Section in Bengali.)
আর-পাঁচটা অস্ত্রোপচারের মতোই সি-সেকশনও তো অস্ত্রোপচারই! এখানে তবে কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা আসছে কোথা থেকে? আপনার মনে এমন প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয়। সবার আগে তাই সে প্রশ্নই সমাধানের একটা চেষ্টা করছি আমরা।
গর্ভাবস্থার গোটা সময়টা শরীরে হরমোনের ধরন-ধারণ পাল্টাতে থাকে খুব দ্রুত। সন্তান প্রসবের পর ঠিক ততটাই তাড়াতাড়ি শরীর আবার আগের অবস্থায় ফেরত আসতে চায়। আর এই করতে গিয়ে কোষ্ঠকাঠিন্যর কবলে পড়েন নতুন মা। এরই সঙ্গে দোসর হয় শরীরে জলের অভাব আর খাদ্য তালিকায় আঁশযুক্ত খাবারের ঘাটতি! দেখে নিন সি-সেকশনের পর কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণ!
সিজারিয়ান সেকশন (Caesarean Section): অস্ত্রোপচারের সময় আপনাকে অজ্ঞান করার জন্য যে ওষুধের প্রয়োগ হয়, তাতে ব্যাঘাত হয় হজম প্রক্রিয়ায়। আর এরই জেরে কোষ্ঠকাঠিন্যর প্রকোপ হতেই পারে।
আয়রন সাপ্লিমেন্ট (Iron Supplements): ডেলিভারির পর অনেক মেয়েরই রক্তাল্পতার সমস্যা তৈরি হয়। এই কারণেই আয়রন সাপ্লিমেন্ট খেতে দেওয়া হয় তাঁদের। দুঃখের বিষয় এটাই, এই আয়রন সাপ্লিমেন্টই অন্ত্রে গিয়ে গোলযোগ পাকায়, যা থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য অবশ্যম্ভাবী!
অ্যাসিসটেড ডেলিভারি (Assisted Delivery): ডেলিভারির সময় জটিলতা তৈরি হলে বাইরে থেকে নানাভাবে চাপ দিয়ে গর্ভস্থ শিশুকে বাইরে আনা হয়। আর এটা করতে গিয়ে মায়ের পশ্চাৎ অঞ্চলে চাপ পড়ে, যার থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য হতেই পারে।
ওষুধপত্র (Medication): এছাড়াও মাকে যদি ভারী ভারী ওষুধপত্তর নিয়মিত খেতে হয়, তা হলে তাঁর কোষ্ঠকাঠিন্য হবেই হবে।
হরমোন (Hormones): গর্ভাবস্থায় শরীরে বিশেষ কিছু হরমোনের নাচানাচিতে হজম প্রক্রিয়ার দফারফা হয়ে যায়। যার কারণেই কোষ্ঠকাঠিন্য চেপে বসতে পারে নতুন মায়ের শরীরে।
ডিহাইড্রেশন (Dehydration): শরীরে জলের ঘাটতি হলে তো কোষ্ঠকাঠিন্য় হবেই বাপু। নতুন মা বলে নয়, এমন সমস্যা যে কারও হতে পারে।
আঁশযুক্ত খাবারের অভাব:( Lack of fibre): পটি ঠিকঠাক হতে গেলে রোজের খাবারে যথেষ্ট আঁশযুক্ত খাবার থাকা চাই-ই চাই। আর সেটা না হলেই কোষ্ঠকাঠিন্য চেপে বসবে। সে নতুন মা-ই হোক, কিংবা আমি বা অন্য কেউ!
ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট (Prenatal Vitamins): স্তন্যপান করানোর দিনগুলোয় নতুন মায়েদের অধিকাংশ সময়ই নানা মাল্টি-ভিটামিন খেতে হয়, দুধের পরিমাণ বাড়াতে। আর এটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া! দুর্ভাগ্য়বশত এই মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্টগুলোর অধিকাংশই আয়রন সমৃদ্ধ হয়। যা থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে বাধ্য!
উত্তেজনা (Anxiety): সব শেষে বলছি ঠিক, কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যর জন্য় অনেকাংশেই দায়ী হয়ে পড়ে নতুন মায়ের অহেতুক উত্তেজনা আর ছানার জন্য উদ্বেগ!
এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার অসুখ ঠিক কতটা জটিল, কতটা সিরিয়াস তার উপর! সাধারণত ডেলিভারির কিছুদিনের ভিতরই কোষ্ঠকাঠিন্যের নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু কখনও সখনও এর আয়ু হয় দীর্ঘ! এই ক’টা দিন অগত্যা পটির সময় খানিক কষ্ট আপনাকে সহ্য করে নিতেই হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে সব কিছুই। ঠিক তো হবে, কিন্তু যদি ঠিক হওয়ার প্রক্রিয়াটাই একটু জলদি শেষ হয় তখন? সেই আশাটাই পূর্ণ হবে এবার। নীচে রইল সহজ-সাদামাটা কিছু ঘরোয়া টোটকার হদিস। নতুন মায়েরা, একবারটি প্লিজ চোখ বুলিয়ে নিন। জোর দিয়ে বলতে পারি, কাজ হবেই হবে!
#1. ফলের রস (Fruit Juices): গবেষণাই বলছে, আপেল-পেয়ারার মতো ফলে এমনই কিছু উপকারী উপাদান থাকে যা থেকে রেহাই মেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায়। এসব ফল তাই রস করে নিয়মিত খান। ফলের পাশাপাশি বেশ কিছু সবজিরও রয়েছে এই গুণ!
#2. জল পান (Drinking Water): দিনে পর্যাপ্ত জল খাওয়াটা এ সময়ে অত্য়ন্ত দরকার। এতেই শরীরটা তরতাজা থাকবে। পটির সময় এড়াতে পারবেন ব্য়থা, যন্ত্রণা!
#3. ওটমিল (Eating Oatmeal): শরীর সচেতন বাঙালির ঘরে ঘরে ওটসের একটা কৌটো অন্তত থাকবেই। নতুন মায়েরা, হ্যাঁ আপনাদেরই বলছি। ওই কৌটোটাই কাজে লাগান এবার। আঁশযুক্ত ওটমিলই ঘুচিয়ে দেবে পটির কষ্ট। সাথে থাক নানান খাদ্যশস্য।
#4. হালকা মালিশ (Massages): কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে কখনও সখনও দারুণ কাজে আসতে পারে হালকা মালিশ! লাগাতার পটি নিয়ে কষ্ট হতে থাকলে মাঝেসাঝেই নিজের পৈটিক প্রদেশে হালকা মালিশ নিন। নিজেও করতে পারেন, সঙ্গীকেও বলতে পারেন। এই মালিশই দেখবেন কাজ করছে মোক্ষম ওষধির মতো। এরই সঙ্গে যথেষ্ট বিশ্রাম নিন। জানবেন, বিশ্রামই আপনার জলদি সেরে ওঠার একমাত্র চাবিকাঠি।
#5. জোলাপ (Natural Laxatives): কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে জোলাপের যে জুড়ি নেই, এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনার খাবার তালিকায় আলুবোখরা, শণ বীজ, ডাবের জল রাখুন, দিনের শেষে এগুলোই কাজ করবে প্রাকৃতিক জোলাপের মতো!
#5. অল্প ব্যায়াম (Mild Exercises):
সদ্য সিজার হয়েছে আপনার। আপনাকে তাই মোটেই হাত-পা ছুড়ে এক্সারসাইজ করতে বলছি না আমরা। শুধু বলছি, খানিক সচল থাকুন। রোজের রোজ ৩০ মিনিট মতো হাঁটাচলাই যথেষ্ট হতে পারে। এতে খাবারদাবার জলদি হজমও হবে আপনার। সেই সঙ্গে যতটা পারুন, উত্তেজনা কমিয়ে ফেলুন। দরকারে দিনের কোনও একটা সময়ে মেডিটেশন করুন।
#6. প্রোবায়োটিক (Probiotics):
উপরের টোটকাগুলি তো বটেই, এরই পাশাপাশি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা সারিয়ে তুলতে পারে প্রোবায়োটিক খাবারদাবারও। রোজের খাবারে তাই দই থাকুক অবশ্য়ই।
#7. আদা-চা (Ginger Tea): চা তো আপনি দিন-রাত খাচ্ছেন। সেটাই যদি এবার একটু আদা কুচিয়ে বানানো যায়? স্বাদ তো বাড়বেই, রেহাই পাবেন আপনিও। আদা-চা-ই চটজলদি হজমে দারুণ সাহায্য করে। তবে হ্যাঁ, যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে এটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
#8. লেবু জল (Lemon Water): বানাতে ঝক্কি নেই আবার খেতেও ভালো। রোজ সকালে লেবু-জলই আপনার হজমে সাহায্য করবে। রেহাই দেবে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে। জলটা আবার গরম হলে কাজ হবে দ্বিগুণ!
#9. আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার (Iron-Rich Foods): হয়তো ভাববেন, এ আবার কী! একটু আগেই লেখা হল আয়রন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে, আর এখনই আবার লিখছে কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার খান! ভুল নয়, ঠিকই পড়ছেন আপনি। কথায় আছে না, বিষে বিষে বিষক্ষয়! আয়রন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে আপনাকে যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের পাল্লায় পড়তে হয় তবে রেহাই দেবে আয়রন-সমৃদ্ধ খাবারই। যেমন, মাংস, সবুজ শাক-সবজি ইত্যাদি।
সব ক্ষেত্রে নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই কোষ্ঠকাঠিন্যই অনেক বড় জটিলতার কারণ হতে পারে। ঘরোয়া নানা টোটকাতেও যদি কাজ না হয়, উল্টে দিন দিন আপনার অবস্থার অবনতি হতে থাকে তখন ডাক্তারের পরামর্শ আপনাকে নিতেই হবে। দেখে নিন, ডাক্তার ডাকবেন কখন!
দেখুন, এত সব বলা ওই একটিই কারণে। নতুন মা হয়েছেন আপনি, আপনার উপরই পুঁচকেটার সবকিছুর ভার। যেনতেনপ্রকারেণ তাই সুস্থ আপনাকে থাকতেই হবে! আপনার সুস্থতাই যে একরত্তির সুস্থ থাকার চাবিকাঠি!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null