ইউরিন ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে ঘরোয়া কিছু নিয়মকানুন। জেনে নিন এখনই!

ইউরিন ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে ঘরোয়া কিছু নিয়মকানুন। জেনে নিন এখনই!

ঘটনা ১: বাড়ির সব্বার সাথে ছুটি কাটিয়ে কালই বাড়ি ফিরেছেন, বেশ বড় একখানা রোড-ট্রিপ ছিল তাই দেদার ব্যবহার করতে হয়েছে চলার পথে এদিক- ওদিক গজিয়ে ওঠা পাবলিক টয়লেট। বাড়ি ফেরার পরের দিনই প্রস্রাবের সময় অসহ্য জ্বালা, পেট ব্যথা আর জ্বরে কাবু হয়ে পড়লেন। বেড়ানোর আনন্দটাই যেন মিইয়ে যাওয়া মুড়ি হয়ে গেলো।

ঘটনা ২: আপনি আমার মতোই বড্ড পিটপিটে। নোংরা, ধুলোবালি যেন সব্বার আগে আপনার চোখেই এসে ঘুরপাক খায়। বেড়াতে যাচ্ছেন ট্রেনে চেপে, ট্রেনের টয়লেট ব্যবহার করবেন না এটাই প্রতিজ্ঞা। জল খাচ্ছেন বোতলের ছিপিতে করে ১-২ ঢোক, সারারাত প্রস্রাব আটকে কাটিয়ে দিলেন। পরের দিন হোটেলে ঢুকে তীব্র পেটে ব্যথায় সোজা বিছানায় কাত। বেড়ানোটা গেলো মায়ের ভোগে।

ঘটনা ৩: সুন্দর একটা রোম্যান্টিক রাত কাটিয়েছেন নিজের সঙ্গীর সাথে, নিজেদের বেশ “শ্রেষ্ঠ দম্পতি” বলে একটা ফিল নিলেন সারারাত, তার দু’দিন পরেই মূত্র দ্বারে তীব্র জ্বালা, সাথে কোমরে ব্যথা। বুঝতেই পারলেন না হল টা কী আপনার! (Home Remedies for UTI in Bangla or Home remedies for uti in bengali)

এবার আমি বলি, আপনি একটু লক্ষ্মী মেয়ের মতো শুনুন দেখি। এগুলো সবই মূত্র নালীর সংক্রমণ (UTI)-এর খুব সাধারণ উদাহরণ মাত্র। মেয়েদের জীবনে আর এক বিভীষিকা। আর একবার যদি ইউ টি আই ধরেছে আপনাকে, সে ব্যাটা যেতে চায় না কিছুতেই। সেরে গিয়েও ফিরে আসে বারবার। জানেন নাকি, এই মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI)-এর হাত থেকে বাঁচাতে পারে ঘরোয়া কিছু নিয়মকানুন? আসুন জেনে নিই, কীভাবে ঘরোয়া উপায়ে চিকিৎসা করবেন বা এর হাত থেকে বাঁচার উপায়ই বা কী?

 

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিকারে ঘরোয়া টোটকা (Home Remedies for UTI /Urinary Tract Infection)

 

ইউ টি আই(UTI) কী? (What is UTI?)-> আমাদের রেচন তন্ত্র দুটি কিডনি বা বৃক্ক, একটি ইউরিনারি ব্লাডার বা মূত্রথলি, দুটি ইউরেটার এবং ইউরেথ্রা বা মূত্রনালী নিয়ে তৈরি। এই রেচনতন্ত্রের মাধ্যমেই আমাদের শরীরে তরল বর্জ্য মূত্র হিসেবে দেহের বাইরে বেরিয়ে যায়। এই রেচনতন্ত্রের কোনও অংশে জীবাণুর সংক্রমণ হয়ে শরীরে যে অসুস্থতা দেখা দেয় তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (urinary tract infection/UTI) বলা হয়। সংক্ষেপে আমরা একে ইউরিন ইনফেকশন বলে থাকি। রেচনতন্ত্রের যে কোনও এক বা একাধিক অংশ আক্রান্ত হয় এই ইনফেকশনের প্রভাবে।

ইউ টি আই-এর কারণ (Causes of UTI)-> ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই কিন্তু বেশি পড়ে এই ইউ টি আই (UTI)-এর খপ্পরে। একে মেয়েদের একচেটিয়া রোগ বললেও মনে হয় ভুল বলা হবে না। এর প্রধান মদতদাতা বা হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারে মেয়েদের শারীরিক গঠন। মেয়েদের মূত্রনালীর দৈর্ঘ্য খুবই কম হওয়ায় আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই হামলা করতে পারে রেচনতন্ত্রের অন্যান্য অংশের ওপর। ছেলেদের মূত্র নালীর দৈর্ঘ্য যেখানে ৮ ইঞ্চি, সেখানে আমাদের অর্থাৎ মেয়েদের মূত্র নালীর দৈর্ঘ্য মাত্র ১.৫ ইঞ্চি। আবার মেয়েদের পায়ুছিদ্র ও মূত্র ছিদ্র খুব কাছাকাছি থাকে বলে পায়ু থেকেও ব্যাকটেরিয়া সহজেই পৌঁছে যেতে পারে মূত্র নালীতে। এই কারণেই আমাদের শরীর বেশি ইউরিন ইনফেকশন প্রবণ। এবার জেনে নেবো ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার কারণগুলি কী কী;

 

ইউরিন ইনফেকশনের কারণ (Causes of Urinary tract infections in Bengali)

  • পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।
  • অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখা ও জল কম খাওয়া।
  • মাসিকের সময় নোংরা, অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা। যে পথ দিয়ে মাসিকের সময় রক্তপাত হয়, অর্থাৎ যোনিপথ ও মূত্র ছিদ্র খুব কাছাকাছি থাকে বলে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল। স্যানিটারি ন্যাপকিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর বদলে না ফেললে সেক্ষেত্রেও প্রথমে যোনি তারপর মূত্র ছিদ্র ও মূত্র নালী আক্রান্ত হয়।
  • যৌন সঙ্গমে যথাযথ পরিচ্ছন্নতা না নেওয়া।
  • এছাড়াও, মেনোপজের সময়, যাদের ডায়াবেটিস আছে বা গর্ভাবস্থায় ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে।
  • বয়স্কা মহিলাদের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ইউরিন ইনফেকশনের আধিক্য দেখা যায়।

আরও পড়ুনঃ যন্ত্রণাদায়ক মাসিকের কারণ ও ঘরোয়া টোটকায় প্রতিকার

ইউরিন ইনফেকশন (UTI)-এর উপসর্গ (Symptoms of UTI)

  • বার বার প্রস্রাব।
  • প্রস্রাবের সময় প্রচণ্ড জ্বালা; এই জ্বালা অনুভব প্রস্রাব হয়ে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ থাকতে পারে।
  • প্রস্রাবের সময় প্রচণ্ড চাপ ও যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি।
  • বার বার প্রস্রাব হবে এমন অনুভূতি কিন্তু খুবই কম পরিমাণে হওয়া।
  • লালচে বা ঘোলাটে রঙের দুর্গন্ধযুক্ত মূত্র।
  • কোমরের পিছনে,পাশে; তলপেটে ব্যথা।
  • জ্বর।
  • গা বমি ভাব ও বমি হওয়া।

ইউরিন ইনফেকশনের ঘরোয়া প্রতিকার (Natural Home Remedies for UTI in Bangla)

ইউরিন বা মূত্র পরীক্ষা করে ডাক্তাররা ইউ টি আই-এর প্রাবল্য এবং কী জাতীয় সংক্রমণ হয়েছে, তা বুঝতে পারেন এবং সেইভাবে চিকিৎসা করেন। আপনি যদি প্রথমেই ওষুধ খেতে না চান, তা হলে আপনাকে আরাম দিতে পারে ঘরোয়া কিছু ব্যবস্থাই। শুধু আরাম দেওয়াই নয়, এইগুলি মেনে চললে ইউ টি আই  খুব জটিল আকার ধারণ করতে পারে না আবার ভবিষ্যতে এর আক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যায়। দেখে নিন ইউ টি আই দমনের ঘরোয়া ব্যবস্থা;

  • প্রচুর পরিমাণে জল খান। যত জল খাবেন, তত বারবার আপনাকে প্রস্রাব করতে হবে, এবং প্রস্রাবের মাধ্যমেই মূত্র নালীতে থাকা ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু বাইরে বার হয়ে যাবে।
  • আনারসে ব্রোমিলিন নামে একটি উৎসেচক থাকে, যা ইউরিন ইনফেকশনের সময় মূত্র দ্বারে যে তীব্র জ্বালা হয় তা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন এক কাপ করে আনারসের রস খান। তাজা আনারস কিনে এনে তার রস বানিয়ে তবেই খাবেন। যদি আপনি গর্ভবতী, সেক্ষেত্রে আনারস খাবেন না যেন।
  • শসা খান দিনে ২-৩ টি। শসাতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকায় এটি ইউ টি আই তে বিশেষ কার্যকরী।
  • একটি করে ডাবের জল খেলে ঠান্ডা হবে শরীর এবং ইউরিনে সমস্যাও কমবে।
  • এক গ্লাস জলে এক চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে রোজ সকালে খান। প্রস্রাবের জ্বালা অনেকটাই কমবে।
  • গরম সেঁক অনেকটাই আরাম দেবে আপনাকে। হট ওয়াটার ব্যাগে সহ্য করার মতো গরম জল নিয়ে তলপেটে, কোমরে সেঁক দিন।
  • এক গ্লাস জলে দুই চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনিগার মিশিয়ে প্রত্যেকদিন ২বার করে খান। এই ভিনিগার ইউরিন ইনফেকশন সারিয়ে তুলতে খুব সাহায্য করে। প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়টিক হিসেবে কাজ করে এই অ্যাপেল সিডার ভিনিগার এবং রেচনতন্ত্রকে পরিষ্কার করে দেয়।
  • প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান। ভিটামিন সি মূত্র থলির স্বাস্থ্য ভালো করে, ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করে এবং ইউরিন ইনফেকশনের কারণে হওয়া অস্বস্তি কমায়।
  • ক্র্যানবেরি জ্যুসকে ইউ টি আই-এর প্রাকৃতিক ওষুধ বলতে পারেন। এই জ্যুস ব্যাকটেরিয়াকে ছড়াতে দেয় না আবার পলিফেনলের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে ব্যাকটেরিয়া নষ্ট তো বটেই, জ্বালা কমাতেও সাহায্য করে।
  • আরামদায়ক ঢিলেঢালা অন্তর্বাস পরুন, যাতে হাওয়া চলাচল করতে পারে। এতে ব্যাকটেরিয়া বংশবিস্তারে বাধা পায়।

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধের উপায়(How to prevent UTI)

যেসব মেয়েদের বা মহিলাদের একবার ইউ টি আই(UTI) বা ইউরিন ইনফেকশন হয়েছে, তাদের কিন্তু বারবার এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সামান্য কিছু সতর্কতা নিলে এড়ানো যায় ইউ টি আই-এর রক্তচক্ষু;

  • প্রচুর পরিমাণে জল খাবেন। দিনে ৩-৪ লিটার করে জল খাওয়ার অভ্যেস করুন।
  • সহবাসের আগে ও পরে প্রস্রাব অবশ্যই করবেন। এতে মূত্র নালী থেকে সব জীবাণু বার হয়ে যায়। সহবাসের পরে ভালো করে নিজের গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করুন। সহবাসের সময় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
  • মলত্যাগের পরে পায়ুছিদ্র পরিষ্কার করার সময় হাত পিছন থেকে সামনের দিকে অর্থাৎ মূত্র ছিদ্রের দিকে আনবেন না। এতে পায়ুছিদ্র থেকে ব্যাকটেরিয়া মূত্র ছিদ্রের সংস্পর্শে এসে মূত্র নালী আক্রমণ করতে পারে।
  • প্রতিদিন ২-৩ কাপ গ্রিন টি খান, এতে ইউ টি আই হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
  • যেসব মহিলার ইউ টি আই হওয়ার ধাত রয়েছে, তারা কোনও লুব্রিকেনট, সেক্স টয় বা ভ্যাজাইনাল কাপ জাতীয় কিছু ব্যবহার না করলেই ভালো।
  • অন্তর্বাস নিয়মিত বদলে ফেলবেন এবং কাচার পরে তা খটখটে রোদে শুকিয়ে নেবেন। ভিজে অন্তর্বাস পরে থাকলে তা ব্যাকটেরিয়াকে বংশবিস্তারের সুযোগ করে দেবে।
    বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
  • পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হলে আগে বেশ ভালো করে জল ঢেলে নিন। এখন বাজারে অনেক জীবাণুনাশক স্প্রে বা ইউস অ্যান্ড থ্রো(Use and throw) টয়লেট সিট কিনতে পাওয়া যায়। ব্যবহার করতে পারেন সেগুলিও।
  • নির্দিষ্ট কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও যদি ইউ টি আই(UTI) না সারে, প্রস্রাবের সময় অসহ্য ব্যথা ও জ্বালা হয় এবং জ্বর বেশি হয়; তা হলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

আরও পড়ুনঃ যোনিস্রাবের প্রকারভেদের কারণ কী!

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null