ভ্যাপসা গরমেই শিশুর শরীরে হানা দেয় ঘামাচির জ্বালা। জেনে নিন প্রতিকারের পথ!

ভ্যাপসা গরমেই শিশুর শরীরে হানা দেয় ঘামাচির জ্বালা। জেনে নিন প্রতিকারের পথ!

সাত্যকির ধাতটা পুরোপুরি পেয়েছে সোনু। সোনুর বয়স এখনও এক বছরও হয়নি, কিন্তু এখনই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে, মুখের গড়ন, চোখ, চিবুক থেকে শুরু করে হাসিটা পর্যন্ত পুরোপুরি বাবার মতো। মিল আরও একটা আছে। ঘামাচি! শুনে হাসার কিছু নেই! একরত্তির সোনুরও সারা গায়ে ঘামাচি ভর্তি। ঠিক যেমন ছোটবেলায় হত সাত্যকির। (Home Remedies for Prickly Heat in Kids)

গত বছর সেপ্টেম্বরে জন্মানো সোনুর জন্য এবছরের এপ্রিল-মে মাসটা ছিল প্রথম গ্রীষ্ম। সেই দাবদাহেই ঘামাচিতে জেরবার হয়ে গেল খোকা (Heat Rash Home Remedies)। সাত্যকির ছোটবেলায় ওর মা নানা পাউডার, ক্রিম, বৃষ্টির জল—সব কিছু নিয়ে পরীক্ষা করেছেন, ঘামাচির তাড়ানোর জন্য। শেষে অনেক কষ্টে গোলাপ জলে গা ধুইয়ে সাত্যকির ঘামাচি (Baby Heat Rash) নিয়ন্ত্রণে আনেন তিনি। কিন্তু সোনুর ক্ষেত্রে কী করা যাবে?

নিজের খোকাকে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে বন্ধু অভিনন্দাকে ফোন করল সাত্যকি। অভিনন্দা নামজাদা ডারমাটোলজিস্ট। ঘামাচির তাড়ানোর ওষুধের কথা শুনে অভিনন্দা হেসে খুন। ওর কথায়, ঘরোয়া কয়েকটা সাধারণ জিনিসেই যদি ঘামাচি (Prickly Heat in Children) সেরে যেতে পারে, তা হলে শুধু শুধু ওষুধ কেন?

তার পাশাপাশি অভিনন্দা এটাও বুঝিয়ে দিল শিশুদের কেন ঘামাচি বেশি হয় (Heat Rash (Prickly Heat) in Babies)। সাত্যকি পটাপট লিখে নিল অভিনন্দার পরামর্শ। তার নোটবই থেকে টিপস রইল আপনাদের জন্য, যাঁরা নিজেদের খোকা বা খুকুর ঘামাচির সমস্যা নিয়ে জেরবার।

 

ঘামাচি আসলে কী? (What is Prickly Heat?)

  • ঘাম যখন ত্বকের তলায় আটকা পড়ে যায়, সেখানে জমে থাকে, তাকেই ঘামাচি বা প্রিকলি হিট (Prickly Heat) বলে।
  • এতে খুব ছোট ছোট ফোসকার মতো তৈরি হয় ত্বকের নীচে।
  • লাল রঙের ফুসকুরি দেখা যায় ত্বকে। প্রচণ্ড চুলকাতে থাকে।

 

শিশুদের ঘামাচি বেশি কেন? (Why Children Tend to Get it More Prickly Heat?)

  • শিশুদের ত্বক বড়দের তুলনায় অনেক বেশি স্পর্শকাতর বা সেনসিটিভ। ফলে যে কোনও সমস্যা সহজে বড় আকার নেয়।
  • শিশুদের ঘর্মগ্রন্থির পুরোপুরি বিকাশ হয় না। ফলে সব ঘাম ত্বকের উপর বেরিয়ে আসতে পারে না। তলায় আটকা পড়ে যায়।
  • এক প্রাপ্ত বয়স্কের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যতটা ক্ষমতা থাকে, শিশুর শরীরের ততটা থাকে না। ফলে এই ধরনের সমস্যা বাড়ে (Heat Rash in Babies Home Remedy)।
  • অনেক ক্ষেত্রেই শিশুর গরম লাগলে মুখ ফুটে বলতে পারে না, বা বোঝাতে পারে না। গরম লাগলেও পোশাক গায়ে থেকেই যায়। তাতে ঘামাচির সমস্যা বাড়ে।

 

ঘামাচি কখন হয়? (Which Weather Triggers Prickly Heat?)

  • গরমেই ঘামাচি বেশি হয়। গরমের সঙ্গে আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়লে ঘামাচির পরিমাণও (Prickly Heat Rash) বাড়ে।
  • হঠাৎ করে উষ্ণতার তারতম্য হলে শিশুদের ঘামাচির প্রবণতা বাড়ে।
  • অনেক শিশুর শীতকালেও ঘামাচি হয়। অত্যাধিক গরম জামা পরানো বা ত্বকের সমস্যার কারণে ঘামাচি বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার।
  • ঘামাচির ইতিবৃত্ত শুনে সাত্যকি বুঝে গিয়েছে এই সমস্যার কারণটা কী? কিন্তু ঘরোয়া সমাধানের কী হল (Home Remedies for Heat Rash)? অভিনন্দাকে সেই প্রশ্ন করতে, ও বলল, ‘ঠিক আছে, এ বার এক এক করে লিখে নে।’ রইল সেই ঘরোয়া সমাধানের তালিকা…

 

ঘামাচি তাড়ানোর ঘরোয়া উপায় (Home Remedies For Prickly Heat)

 

#1. গোলাপ জল: সাত্যকির মা এক সময় এই দাওয়াইতেই ওর ঘামাচি সারিয়েছিলেন। সেই দাওয়াই (Rose Water) একটু পরিবর্তন করে যে কোনও শিশুর ঘামাচি তাড়াতে ব্যবহার করা যেতে পারে (Home Remedies for Heat Rash in Babies)।

  • ২০০ মিলি গোলাপ জল, চার চামচ মধু আর ২০০ মিলি সাধারণ জল একসঙ্গে মিশিয়ে নিন।
  • ফ্রিজে রেখে এই মিশ্রণ জমিয়ে নিন।
  • তার থেকে চার-পাঁচটা কিউব নরম কাপড়ে জড়িয়ে নিন।
  • ঘামাচির জায়গায় নরম কাপড়টি আলতো করে বোলান। ঘামাচি অনেকটা কমে যাবে।
  • লক্ষ্য রাখবেন শিশুর যেন না ঠান্ডা লেগে যায়।
  • গোলাপ জল ত্বকের অতিরিক্ত তেল নিঃস্বরণ বন্ধ করে। তাই ঘামাচির পরিমাণ কমে।

 

#2. কাঁচা আলু: কাঁচা আলু (Raw Potato) ঘামাচি তাড়ানোর অব্যর্থ ওষুধ (Best Ways to Treat Baby Heat Rash)।

  • আলু খুব পাতলা করে গোল গোল চাকার মতো কেটে নিন।
  • ঘামাচির জায়গার ওপর কাটা আলুগুলো আলতো করে চাপিয়ে দিন। এই অবস্থায় ১০-১৫ মিনিট রেখে দিন।
  • তারপর ধুয়ে ফেলুন।
  • প্রতিদিন এই পদ্ধতি একবার করে প্রয়োগ করতে পারেন। ঘামাচি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
  • আলু চুলকানির মাত্রা কমায়। তাই ঘামাচির কষ্ট লাঘব হয়।

 

আরও পড়ুন:ডায়াপার র‍্যাশ কেন হয়; সারিয়ে তুলতে ঘরোয়া উপায়

 

#3. আদা: আদাও (Ginger) একই কাজে ব্যবহার করতে পারেন।

  • প্রথমে কুচি কুচি করে কেটে নিন।
  • তারপর কুচিগুলো জলে ফুটিয়ে নিন।
  • জল ঠান্ডা হলে তা দিয়ে শিশুর ঘামাচির জায়গাগুলোয় হালকা প্রলেপ দিন। প্রলেপ ১০-১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
  • দিনে দু’বার এই পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পারেন।
  • আয়ুর্বেদেও আদার এই জাতীয় প্রয়োগের কথা বলা রয়েছে। এতেও ঘামাচির পাশাপাশি চুলকানির পরিমাণ কমে (Effective Home Remedies For Prickly Heat)।

 

#4. বরফের কিউব: এই পদ্ধতির প্রয়োগে (Ice cube) শিশুর ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই খুব অল্প পরিমাণে ব্যবহার করুন।

  • দু’-তিনটে বরফের কিউব একটা তোয়ালের মধ্যে রেখে জড়িয়ে নিন।
  • ঠান্ডা তোয়ালে ঘামাচির জায়গায় আলতো করে বোলান (How to Prevent Heat Rash)।
  • শিশুর শরীরে দু’-তিন মিনিটের বেশি ব্যবহার করবেন না।
  • বরফ ত্বককে আরাম দেয়, ঘর্মগ্রন্থির অস্বস্তি কমায়। তাই ঘামাচির মাত্রাও কমে।

 

#5. লেবুর রস: নিয়মিত লেবুর রস পানে (Lime juice) ১২-১৪ দিনের মধ্যে ঘামাচির (Heat Rash (Prickly Heat) in Babies) লক্ষণ কমে যায়।

  • একটা গোটা লেবুর রস বের করে নিন। এক গ্লাস জলে সেই রস মেশান।
  • মিষ্টি ভাব আনার জন্য অল্প মধুও মেশাতে পারেন।
  • সেই লেবুর জল শিশুকে খুব অল্প অল্প করে পান করান।
  • তবে মনে রাখবেন, খুব ছোট শিশুদের এই জল একেবারে পান করানো যাবে না। কোন বয়সের শিশুদের এই জল পান করানো যাবে, এবং কতটা পরিমাণে পান করানো যাবে, তা চিকিৎসকের থেকে জেনে নিতে হবে। না-হলে শিশুর মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।

 

#6. শশা: ঘামাচির জ্বালা সারানোর ক্ষেত্রে শশার (Cucumber) জুড়ি নেই।

  • খুব পাতলা এবং সরু করে শশা কেটে নিন।
  • কিছুক্ষণ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে নিন।
  • ঘামাচির জায়গায় ঠান্ডা শশার প্রলেপ লাগিয়ে রাখুন। শশা ঘরের উষ্ণতায় এসে গেলে সরিয়ে ফেলুন।

 

#7. নিমের পেস্ট: ত্বকের হাজারো সমস্যার সমাধান হল নিম (Neem paste)। ঘামাচি বা তার কারণে ত্বকের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিমের ভূমিকা অতুলনীয়।

  • তাজা নিম পাতা হালকা শুকিয়ে নিন।
  • তারপর সেগুলো থেঁতো করে জল মিশিয়ে একটা পেস্ট বানান।
  • ঘামাচির জায়গায় ১৫-২০ মিনিট পেস্টটা লাগিয়ে রাখুন। তারপর ধুয়ে ফেলুন (Prickly Heat in Children)।
  • যে কোনও বয়সের মানুষের ঘামাচির জন্যই এটা অত্যন্ত ভালো সমাধান।

 

#8. নারকেল তেল: নারকেল তেল ত্বকের জলীয় ভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে (Coconut oil)। তাছাড়া চুলকানি কমাতেও এর জুড়ি নেই।

  • রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে শিশুর ঘামাচির জায়গাগুলোয় খুব অল্প পরিমাণে নারকেল তেলের প্রলেপ লাগিয়ে দিন।
  • সকালে নরম শুকনো কাপড় দিয়ে হালকা করে মুছে দিন।
  • মনে রাখবেন, শুদ্ধ নারকেল তেল (ঠান্ডায় যা জমে যায়) ব্যবহার করাটাই ভালো। মাথায় মাখার তেল হিসেবে বোতলবন্দি যে নারকেল তেল পাওয়া যায়, তা না-লাগানোই ভালো।

 

#9. এপসম লবণ: ত্বকের মৃত কোষ ঝরিয়ে ফেলতে এবং ত্বকের তলায় জমে থাকা টক্সিক পদার্থ বের করে দিতে এই লবণের (Epsom salt) কোনও তুলনা নেই। ঘামাচির প্রকোপ কমাতেও তাই এটি ব্যবহার করতে পারেন।

  • শিশুকে যে গরম জলে স্নান করান, তাতে কিছুটা এপসম লবণ মিশিয়ে নিন।
  • বাথটবে এই জলের মধ্যে ওকে ১৫ মিনিট থাকতে বলুন। লক্ষ্য রাখবেন, বেশিক্ষণ থাকার ফলে যেন ঠান্ডা না-লেগে যায়।
  • বাথটব না-থাকলে কাপড় এপসম লবণের মিশ্রণে ভিজিয়ে নিয়ে তা ঘামাচির জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন (Heat Rash Home Remedies)।

 

#10. ট্যালকম পাউডার: ট্যালকম পাউডার (Talcum powder) ঘাম নিয়ন্ত্রণে রাখে। ঘাম তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেতেও সাহায্য করে। তাই ঘামাচি নিয়ন্ত্রণে (Ghamachi Powder) এর জুড়ি নেই।

  • শিশুকে স্নান করানোর পর গায়ে অল্প করে এই পাউডার লাগিয়ে দিন। ও আরাম পাবে।
  • কোন পাউডার ব্যবহার করবেন, সেটা চিকিৎসকের কাছ থেকে ভালো করে জেনে নিন।

 

#11. অ্যালো ভেরা জেল: অ্যালো ভেরা (Aloe Vera gel) ব্যাকটেরিয়া-জাত ত্বকের সংক্রমণের চমৎকার দাওয়াই। ঘামাচিতেও খুব কার্যকরি।

  • গাছ থেকে ভেঙে নেওয়া অ্যালো ভেরা পাতা থেকে চেপে জেল বের করে নিন।
  • শিশুর ঘামাচির জায়গায় ওই জেল দিয়ে মালিস করুন।
  • গাছ না-পেলে অ্যালো ভেরা সমৃদ্ধ ক্রিমও ব্যবহার করতে পারেন।

 

#12. পাকা পেঁপে: পাকা পেঁপের (Papaya) ব্যবহারে ত্বকের জ্বলুনি কমে। ঘামাচিও কমে।

  • পাকা পেঁপে থেঁতো করে পেস্ট বানিয়ে নিন।
  • শিশুর ঘামাচির জায়গায় প্রলেপ লাগিয়ে দিন।
  • ২০-২৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।

 

উপরে উল্লেখ করা পদ্ধতির এক-একটা একেক শিশুর জন্য আদর্শ। সব ক’টাই যে সবার কাজে লাগবে, তেমন নয়। পাশাপাশি কোনও কোনওটা থেকে আবার কারও অ্যালার্জিও হতে পারে (Ghamachi Medicine, Prickly Heat Treatment)। তাই ঘামাচি তাড়ানোর কোন পদ্ধতি আপনার সোনার উপর প্রয়োগ করবেন, তা চিকিৎসককে একবার জানিয়ে রাখুন। আর তাতে ওর কোনও অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা বন্ধ করুন। এবং শিশুস্বাস্থ্যবিদের সঙ্গে কথা বলুন। (Home Remedies for Prickly Heat in Kids)

 

আরও পড়ুন: ডায়াপার পরালেই কান্না জুড়ছে সোনা? র‍্যাশ হচ্ছে না তো ওর? সেক্ষেত্রে কোন র‍্যাশের কেমন ধরন, জেনে নিন!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null