বাচ্চার বুকে কফ বসে যাওয়া অতি সাধারণ সমস্যা; জানুন ঘরোয়া প্রতিকারের উপায়!

বাচ্চার বুকে কফ বসে যাওয়া অতি সাধারণ সমস্যা; জানুন ঘরোয়া প্রতিকারের উপায়!

ঠান্ডা লেগে বুকের ভিতর রীতিমতো সর্দি জমে গিয়েছে রুমির। গতমাসেই ওর তিনবছর পূর্ণ হল। এমনিতে ও খুবই চঞ্চল, বাবার আদরের মেয়ে। তবে গতকাল থেকে ঠান্ডা লেগে এতই কাহিল হয়ে পড়েছে যে, খাওয়াদাওয়াও ঠিক মতো করছে না। এমনকী ঘুমের সময় শ্বাস নেওয়ার সময় সাঁই সাঁই করে আওয়াজ হচ্ছে। রুমির মা সুমিতা একটি প্রাইভেট ফার্মে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ছোট্ট সোনার এমন অবস্থা দেখে ও আজ ছুটি নিল। রুমিকে নিয়ে গেল একজন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে রুমিকে পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষা শেষে সুমিতাকে জানালেন, ঠান্ডা লেগে রুমির বুকে মিউকাস (শ্লেষ্মা/কফ) জমে গিয়েছে। সে কারণেই ঘুমের সময় বুকের সাঁই সাঁই আওয়াজ হচ্ছে। (Home Remedies To Get Rid Of Mucus In Children)

 

শ্লেষ্মা/কফ কেন জমে (Causes Of Mucus Build-up):

সুমিতা চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করল ঠান্ডা লাগার কারণেই কি ওর বুকে কফ জমেছে? চিকিৎসক বললেন, কফ জমার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করে।

  • সংক্রমণ: ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে খুদের শ্বাসনালিতে মিউকাস জমতে পারে। ঠান্ডার সময় বাতাসে ছড়িয়ে থাকা এই জীবাণু খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে। শিশুর প্রতিরোধশক্তি কম হলে এরা সহজেই শিশুর শ্বাসনালীতে বাসা বাঁধে।
  • অ্যাজমা: অ্যাজমা হলে ফুসফুসের ভিতরের পথ স্বাভাবিকের তুলনায় সরু হয়ে যায়। এর ফলে সহজেই মিউকাস তৈরি হয়। এক্ষেত্রে অল্প কফেই শিশুর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
  • ক্রনিক ব্রংকাইটিস: ক্রনিক ব্রংকাইটিসে শ্বাসনালীতে জ্বালা জ্বালা ভাব ও ব্যথা হতে থাকে। ছোট্ট সোনার এমন সমস্যা হলে ওর শ্বাসনালিতে সহজেই কফ জমে যায়। এর ফলে শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
  • সিস্টিক ফাইব্রোসিস: সিস্টিক ফাইব্রোসিস একটি জিনগত সমস্যা । বাবা-মা বা পরিবারের আর কারও এই সমস্যা থাকলে শিশুর মধ্যেও এটি সঞ্চারিত হয়। এই সমস্যায় শ্বাসনালীতে সহজেই কফ বা মিউকাস জমে যায়। এই মিউকাস ঘন হয়ে ফুসফুসের কাজেও ব্যাঘাত ঘটায়‌।
  • অ্যালার্জি: অ্যালার্জির ফলে মিউকাস খুদের শ্বাসনালীতে মিউকাস জমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কোনও পদার্থ থেকে অ্যালার্জি হলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি ওই বিজাতীয় পদার্থের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক আচরণ করে। এই পদার্থ ফুলের রেণু, ধুলোবালি ইত্যাদি যে কোনও কিছু হতে পারে। একেক জনের ক্ষেত্রে একেকটি পদার্থে এই অ্যালার্জি দেখা দেয়। অত্যাধিক অ্যালার্জির ফলেই শ্বাসনালীতে কফ জমে।

 

কফ বা মিউকাস থেকে মুক্তি পাবার ঘরোয়া উপায় (Home Remedies To Get Rid Of Mucus)

চিকিৎসক সুমিতাকে বললেন, রুমির ক্ষেত্রে তেমন গুরুতর কোনও ঘটনা ঘটেনি। ঠান্ডা লেগেই সংক্রমণের কারণে ওর বুকে কফ জমে গিয়েছে। এই সমস্যা বাড়িতেই কিছু ঘরোয়া পদ্ধতির সাহায্যে সারিয়ে তোলা সম্ভব। (Wet Cough Natural Remedies for Adults and Children)

#1. গরম জলের ভাপ: বুকে কফ বা সর্দি জমে গেলে শ্বাস নেওয়া আরওই কঠিন হয়ে পড়ে। একমাত্র আর্দ্র পরিবেশে থাকলেই কফ সহজে শুকিয়ে যায় না। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সময় নিয়মিত গরম জলের ভাপ নেওয়া উচিত (Soothing Your Child’s Cold)। এক্ষেত্রে প্রথমে একটি পাত্রে ফুটন্ত জল নিতে হয়। এরপর জলের উপর ঝুঁকে জলের বাষ্পকে শ্বাসের মাধ্যমে গ্ৰহণ করতে হয়। এই বাষ্পই কফ তরল রাখে।

#2. গরম জলে স্নান: গরম জলে স্নান করলে স্নানঘর জলের বাষ্পে ভরে যায়। এতে ঘরের পরিবেশ আর্দ্র থাকে। তা ছাড়া এতে ঠান্ডার সময় শরীরের উষ্ণতাও ঠিক থাকে। চিকিৎসকরা তাই এই সমস্যায় গরম জলে স্নানের পরামর্শ দেন (How to Stop Coughing)।

#3. নুনজল দিয়ে গার্গল: হালকা গরম জলে নামমাত্র নুন দিয়ে গার্গল করলে এই সমস্যায় অনেকটাই আরাম মেলে। হালকা গরম নুন জলের গলার পিছনদিকে জমে থাকা কফ বের করে ফেলতে সাহায্য করে। গার্গলের সময় খুদেকে লক্ষ রাখতে হবে যাতে জল আলজিভ পর্যন্ত যায় (Home Remedies To Clear Chest Congestion In Kids)। তবে এখন অনেক চিকিৎসক গার্গল না-করতে বলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই গার্গল করা উচিত।

 

আরও পড়ুনঃ শিশুর জ্বর হঠাৎ বেড়ে গেলে, ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারেন আপনিই!

 

#4. উষ্ণ পানীয়: শ্বাসনালীতে জমে থাকা কফ তরল করার ক্ষেত্রে উষ্ণ পানীয় যথেষ্ট উপকারী। চিকিৎসকরা এই সময় প্রায়ই চা বা কফিপানের পরামর্শ দেন। এই পানীয় সহজে কফ জমতে দেয় না। তবে ছোট্ট খুদে চা বা কফি নাই খেতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ, খুদেকে শুধু উষ্ণ জলই পান করতে দেওয়া যেতে পারে (Home Remedies for Coughs and Colds)।

#5. মধু: বুকে সর্দি বা কম জমার সমস্যায় মধু ও তুলসীপাতার তুলনায় ভালো পথ্য আর নেই। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস থেকে সংক্রমণের ফলে কফ জমলে মধু তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এক্ষেত্রে সমস্যা পুরোপুরি না-সেরে ওঠা পর্যন্ত প্রতি চার-পাঁচ ঘণ্টা অন্তর এক টেবিলচামচ মধু খাওয়া উচিত।‌ এক বছরের কমবয়সি খুদের অবশ্য মধু খাওয়া উচিত নয়।

#6. এসেনসিয়াল অয়েল: এসেনসিয়াল অয়েলের ভাপ খুদের শ্বাসনালী থেকে কফ সরিয়ে তাকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও এই তেল শ্বাসনালীতে থাকা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও লড়াই করে (How to Get Rid of Mucus in the Chest)। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য থেকে এই তেল তৈরি হয়। যেমন দারচিনি, পিপারমিন্ট, বাসিল, থাইম, চা গাছ ইত্যাদি। একটি বোতলে এই তেল রেখে ধীরে ধীরে শ্বাসের মাধ্যমে এর গন্ধ নেওয়া যেতে পারে। তবে ছোট্ট খুদের জন্য এই ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় কি না তা চিকিৎসকই বলে দেবেন।

#7. হিউমিডিফায়ার: বুকের ভিতর কফ জমলে চিকিৎসক তা তরল রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণেই অনেক চিকিৎসক হিউমিডিফায়ার ব্যবহারের কথা বলেন (Natural Cold Remedies for Babies)। এই যন্ত্র ঘরের পরিবেশকে আর্দ্র রাখে। ঠান্ডার পাশপাশি শুষ্ক আবহাওয়ার ফলে কফ বা মিউকাস সহজেই শিশুর শ্বাসনালীতে জমে যায়। এর ফলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে পারে। তাই রাতে ঘুমনোর সময় দরজা জানালা বন্ধ করে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করলে ঘরের ভিতর আর্দ্রতা বজায় রাখে। এতে শিশুর শ্বাসকষ্টও কম হয়‌।

#8. প্রচুর জল খাওয়ান: কফ জমতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে জলের পরিমাণ কমতে শুরু করে। এতে খুদের শরীরের মিউকাস গ্ৰন্থিতেও তরলের পরিমাণ কমতে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ, এই সমস্যায় খুদেকে অল্প সময় অন্তর জল খাওয়ানো উচিত (Natural Toddler Cough Remedies)। এতে শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় থাকে। ওর শরীরে জলের পরিমাণ কমে গেলে অন্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

 

বুকে সর্দি বা কফ জমা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য (Some Important Facts on Prevnting Mucus)

ঘরোয়া উপায়গুলো জানিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এই সমস্যা যাতে আর না হয়, তাই চিকিৎসক বেশ কিছু টিপস্ দিলেন। সুমিতা পুরোটাই মনোযোগ সহকারে শুনল।

  • ভিটামিন সি: খুদের জন্য ভিটামিন শীতকালে খুবই প্রয়োজনীয়। শীতের সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ভিটামিন সি খুদের প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাছাড়াও বাইরের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ থেকেও ওকে রক্ষা করে। (How to Get Rid of Mucus Fast)
  • ধুলোবালি এড়িয়ে চলা: ধুলোবালি থেকে অনেক শিশুরই অ্যালার্জি হয়। এছাড়াও ধুলোবালি শ্বাসনালীতে ঢুকে খুদের শ্বাসঅঙ্গকে সংক্রামিত করে। বিশেষজ্ঞরা তাই পরামর্শ দেন, ধুলোবালি থেকে সবসময় ছোট্ট সোনা যেন দূরে থাকে। ধুলোবালি এড়াতে মাস্কও ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • হাত ধোয়া: হাত ধুয়ে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস সব শিশুরই থাকা উচিত। চিকিৎসকরা তাই সবস ময় বলেন হাত ধুয়ে খাওয়ার কথা। এতে জীবাণুর সংক্রমণ অনেকটাই এড়ানো যায়। (Home Remedies for Cold and Cough for Babies)

ভাইরাল সংক্রমণের কারণেই রুমির শ্বাসনালীতে কফ জমেছিল। ডাক্তারকাকুর কথা শুনে চলায় দু’-একদিনের মধ্যেই ঘরোয়া উপায়ে রুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে‌। এর কয়েক দিনের মধ্যেই ও কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়। তবে স্কুলে যাওয়ার সময় ধুলো থেকে বাঁচতে ও মাস্ক পরতে ভোলেনি। (Home Remedies To Get Rid Of Mucus In Children)

 

আরও পড়ুনঃ ছোট্ট শিশুকে সর্দির হাত থেকে বাঁচাতে বাড়িতেই বানান চ্যবনপ্রাশ ও কফ সিরাপ, পদ্ধতি রইল এখানে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null