খাবারে ফাইবার মানে সোনার শরীর-মন তাজা! আপনার আদুরেকে ভালো রাখতে তাই কী কী খাওয়াবেন?

খাবারে ফাইবার মানে সোনার শরীর-মন তাজা! আপনার আদুরেকে ভালো রাখতে তাই কী কী খাওয়াবেন?

ছোট্ট গুবলাই অনিন্দিতার চোখের মণি। গুবলাই চোখের আড়াল হলেই ওর দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। তাই গুবলাইকে সারাক্ষণ মায়ের আশেপাশেই দেখা যায়। ওর এখন তিন বছর বয়স। ক’দিন বাদেই ওকে কিন্ডারগার্টেন-এ ভর্তি করানো হবে, এমনটাই প্ল্যান বাড়ির সকলের। কিন্তু অনিন্দিতার কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ ছোট্ট গুবলাই কিছুতেই খেতে চায় না। খাওয়াদাওয়া নিয়ে সবসময় ওর বায়না লেগেই আছে (High Fibre Foods List)।

গত দু’দিন ধরে ওর পেটও ঠিক সময় পরিষ্কার হচ্ছে না। দিনে দু’বারের বদলে একবার করে পটি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দু’দিনই পায়খানা শক্ত ছিল অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হচ্ছে ওর! অনিন্দিতার কপালে রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ। পরপর দু’দিন এমন দেখে তৃতীয় দিন ও গুবলাইকে নিয়ে গেল চিকিৎসকের কাছে। তিনি পুরো ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনে বললেন, গুবলাইয়ের ডায়েটে বদল চাই। ওকে এখন থেকে নিয়মিত ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে‌, সে কোষ্ঠকাঠিন্য হোক বা না হোক (High Fibre Diet Plan)। অনিন্দিতা জিজ্ঞেস করল, ‘ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার বলতে (Baby Der Khabar)?’

এমন প্রশ্ন যে শুধু অনিন্দিতার মনেই জেগেছে তা নয়। ওর মতো আরও অনেক মায়েরাই শিশুস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের এই প্রশ্ন করে থাকেন। আসলে মায়েরা বাচ্চার বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবারে যতটা গুরুত্ব দেন, ততটা দেন না ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারে, এমনটাই মত শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। অথচ ফাইবারের অভাবে শুধু গুবলাই নয়, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় পড়তে পারে তার থেকে বয়সে বড় বাচ্চারাও। তাই বাচ্চাদের প্লেটে ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার চাই-ই (Bachar Khabar Talika)। কোন কোন খাবার গুবলাইয়ের প্লেটে রাখলে সে সঠিক পরিমাণে ফাইবার পাবে? বিশেষজ্ঞরাই তার একটা তালিকা তৈরি করে দিচ্ছেন। দেখে নেওয়া যাক সেই তালিকায় কী কী খাবার রয়েছে।

 

 

বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য আঁশযুক্ত খাবারের তালিকা (High Fibre Foods List for Your Kid)

 

#1. কলা: ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারের তালিকায় কলা প্রথম সারিতে। কারণ ১০০ গ্ৰাম ওজনের একটি কলায় রয়েছে আড়াই গ্ৰামের বেশি ফাইবার । তাই বাচ্চার ব্রেকফাস্টে একটা কলা মাস্ট।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: কলা ছোট ছোট স্লাইস করে কেটে সাজিয়ে দিন। এতে যদি ছোট্ট সোনা মুখ গোমড়া করে থাকে তবে ব্যানানা শেকও (Banana Shake) বানিয়ে দিতে পারেন। কলা ছোট ছোট স্লাইস করে কেটে দই আর লেবুর রস সহযোগে ব্লেন্ড করে নিন। এরপর মিশ্রণটি ঠান্ডা করে ওকে দিন।

 

 

#2. আপেল: আপেলে রয়েছে কলার মতোই সমান পরিমাণ ফাইবার। তাই কলার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা তালিকায় রাখছেন আপেলও। ছোট্ট সোনাকে লাঞ্চের পর বা ব্রেকফাস্টে একটা মাঝারি সাইজের আপেল অবশ্যই খাওয়ান।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: আপেল দিয়ে বানিয়ে দিতে পারেন অ্যাপেল শেক। আপেলের খোসা ছাড়িয়ে চিনি, লেবুর রস আর দুধ সহযোগে ব্লেন্ড করে নিন। ব্লেন্ডের পর মিশ্রণটি ঠান্ডা করে ওকে খেতে দিন।

 

 

#3. গাজর: ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারই যদি চান, তবে গাজরের বিকল্প খুব কম। বিশেষজ্ঞদের মত, ১০০ গ্ৰাম ওজনের কাঁচা গাজরে থাকে তিনগ্ৰাম ফাইবার। এই গাজর যদি রান্না করা হয়, তবে ফাইবারের পরিমাণ বেড়ে হয় চারগ্ৰাম। তাই লাঞ্চ হোক বা ডিনার, প্রধান আইটেমে এবার থেকে গাজর মাস্ট (High Fibre Food List)।

 

কীভাবে খাওয়াবেন:একদম ছোট্টদের জন্য তরল খাবারই নিরাপদ। তাই ছোট সোনার জন্য গাজরের পিউরি বানিতে নিতে পারেন। খোসা ছাড়িয়ে সিদ্ধ করে নিন। এরপর সিদ্ধ করা গাজর অল্প জল আর পরিমাণ মতো মিষ্টি দিয়ে ব্লেন্ড করে নিন। ওকে দেওয়ার আগে মিশ্রণটা ঠান্ডা করে নিন।

 

 

#4. ওটস: ওটস অনেক বাচ্চারই ছোটবেলার স্টেপল ফুড। এই খাবার যে ফাইবারে সমৃদ্ধ, তা অনেক মায়েরই অজানা। এক কাপ রান্না করা ওটস্-এ রয়েছে প্রায় চারগ্ৰাম ফাইবার। তাই লাঞ্চ বা ডিনার যে কোনও একসময় বাচ্চার প্লেটে ওটস্ অবশ্যই রাখুন।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার স্বাদ পাল্টাচ্ছে। তাই সিদ্ধ ওটস-এর পোরিজের বদলে তৈরি করতে পারেন ওটমিল ব্লেন্ড উইথ ফ্রুটস্ (Oatmel Blend with Fruits)। আপেল ও নাশপাতি ছোট ছোট করে কেটে প্যানে অল্প আঁচে নেড়ে নিন। অন্য প্যানে গরম দুধে ওটস ঢেলে সিদ্ধ করে নিন। এবারে ফল ও সিদ্ধ ওটস একসঙ্গে ব্লেন্ড করে নিন। মিশ্রণটি ঠান্ডা হয়ে এলে বাচ্চার প্লেটে সাজিয়ে দিন।

 

 

আরও পড়ুন ঃ ডিম লম্বা, ডিম গোল, ডিম চ্যাপটা, ডিমের ঝোল!

 

#5. নাশপাতি: ১০০ গ্ৰাম ওজনের একটি নাশপাতিতে রয়েছে তিন গ্ৰাম ফাইবার। নাশপাতি যদি খোসা সমেত খাওয়ানো যায় তো আরও ভালো। সপ্তাহে অন্তত তিন থেকে চারদিন লাঞ্চের পর নাশপাতি রাখুন শিশুর প্লেটে, এমনটাই পরামর্শ বিশেষজ্ঞের।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: ভালো করে খোসা ছাড়িয়ে আগে সিদ্ধ করে নিন। এরপর জল সমেত ব্লেন্ড করে তৈরি করুন নাশপাতির পিউরি। পরিবেশনের আগে অবশ্যই মিশ্রণটি ঠান্ডা করে নিন।

 

 

#6. রাস্পবেরি: ফাইবারের আরেক সমৃদ্ধ উৎস হল রাস্পবেরি। হাফ কাপ রাস্পবেরিতে থাকে প্রায় চার গ্ৰাম ফাইবার। তাই অন্যান্য ফলের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন বাচ্চাকে রাস্পবেরি খাওয়ানোর (High Fibre Fruits)।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: রাস্পবেরি ফিলড উইথ ইয়োগার্ট (Raspberry Field with Yogurt), এই রেসিপি শিশুদের খুবই প্রিয়। এখন ভারতে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্যাকেট-বন্দি রাস্পবেরিও সহজে পাওয়া যায়। প্রথমে ইয়োগার্ট একটি জিপলক ব্যাগে ভরে ঠান্ডা হতে দিন। রাস্পবেরিগুলো ভালো করে ধুয়ে নিন। ইয়োগার্ট ঠান্ডা ও একটু শক্ত হয়ে এলে স্কুইজ করে ভরে দিন রাস্পবেরির ভিতর। উপর থেকে অল্প চকোসিরাপ ছড়িয়ে ওকে খেতে দিন।

 

 

#7. সবুজ মটর (green peas): শুনে অবাক হলেও মটর কিন্তু ফাইবারের অন্যতম সেরা উৎস। ১০০ গ্ৰাম মটরে থাকে পাঁচ গ্ৰাম ফাইবার। বিশেষজ্ঞরা তাই ফাইবারসমৃদ্ধ ফলজাতীয় খাবারের পাশাপাশি সবুজ মটরও বাচ্চার ডায়েট চার্টে রাখতে বলেন।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: বাচ্চাদের খাবার হিসেবে মটরের পিউরিই সবচেয়ে ভালো ও সহজ রেসিপি। মটরগুলো প্রথমে ভালো করে সিদ্ধ করে নিন। এরপর ব্লেন্ডারে অল্প জল দিয়ে ব্লেন্ড করে নিন‌‌। মটরের খোসা ঠিক মতো ব্লেন্ড হল কি না তা দেখে নিন, চাইলে দুধ দিয়েও ব্লেন্ড করতে পারেন। পরিবেশনের আগে মিশ্রণটি ঠান্ডা করে নিন।

 

 

#8. বিনস্: ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে বিনস্-এর খ্যাতি বহুদিনের। বাচ্চার খাবার হিসেবে সব চিকিৎসকই বিনস্-এর কথা বলেন। ১০০ গ্ৰাম বিনস্-এ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন গ্ৰাম ফাইবার। তাই বাচ্চার লাঞ্চে বা ডিনারে রাখতেই পারেন বিনসের রেসিপি।

 

কীভাবে খাওয়াবেন: গাজর ও বিনস্ একসঙ্গে সিদ্ধ করুন। এরপর অল্প জল সহযোগে ব্লেন্ড করে নিন। পরিবেশনের আগে মিশ্রণটি ঠান্ডা করে নিন। এছাড়া শুধু বিনস্ সিদ্ধ করেও একইভাবে বিনস্-এর পিউরি বানিয়ে ফেলতে পারেন।

 

 

ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার কি শুধুই কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে বাচ্চার ডায়েটে রাখা উচিত? মোটেই না, বরং ফাইবারের আছে আরও অনেক গুণ যা ছোটবেলা থেকে একটি শিশুর প্রয়োজন। এবারে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।

 

 

আঁশযুক্ত খাবারের উপকারিতা (Health benefits of fiber-rich foods)

 

  • হজম করায়: ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার অন্যান্য খাবারকে হজম করিয়ে বাচ্চার খাদ্যতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

 

  • পেট ভর্তি রাখে: ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার হজম হতে বেশি সময় লাগে। তাই অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেট ভর্তি থাকে।

 

  • ভিটামিন-সমৃদ্ধ : বেশিরভাগ ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারই একাধিক ভিটামিনে সমৃদ্ধ। এতে ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ বাচ্চার থেকে দূরে থাকে।

 

  • সুস্থ রাখে: বাচ্চার শরীরে অতিরিক্ত চর্বি যাতে না জমে সে খেয়ালও রাখে ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার। এর ফলে ওবেসিটির মতো সমস্যা দূরে থাকে।
    বাচ্চাকে ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার তো খাওয়াবেনই, তবে সেই খাবার রান্না করার আগে মাথায় রাখতে হবে বেশ কিছু টিপস্ (Bacchader Pustikor Khabar)।

 

 

ফাইবারের গুণমান ধরে রাখতে কী কী রাঁধবেন (Tips for More Fiber)

 

  • পিউরিই সবচেয়ে নিরাপদ: বাচ্চারা সহজে সব খাবার চিবোতে পারে না। তা ছাড়া খাবার গলায় আটকে যাওয়ার মতো সমস্যাও হতে পারে। তাই বাচ্চার জন্য পিউরি বা তরল জাতীয় খাবারই সবচেয়ে নিরাপদ।

 

  • মশলা একদম নয়: একবছরের কমবয়সি বাচ্চার খাবারে মশলা একদম নয়। বাচ্চার ছোট্ট খাদ্যতন্ত্রে এসব সহ্য নাও হতে পারে। এছাড়া রান্নায় নুন বা চিনি দেওয়ার আগেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

  • ধুয়ে নিন: ফলের ত্বকে নানারকম কীটনাশক থাকে, এছাড়াও লেগে থাকে রাস্তার ধুলোবালি। তাই রান্নার আগে গরম জলে ভালো করে ধুয়ে নিন সব ফল।

 

বিশেষজ্ঞরা টডলার (এক থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত)-দের প্রতিদিন ১৮-১৯ গ্ৰাম ফাইবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। তা না হলে হজমের সমস্যা-সহ নানারকম সমস্যাই দেখা দিতে পারে। ছোট্ট গুবলাই কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খেয়ে কয়েকদিনেই সুস্থ হয়ে ওঠে (Sisur Khabar)। তাই অনিন্দিতার মতোই আপনিও বদলে ফেলুন ছোট্ট সোনার ডায়েট চার্ট। কারণ ফাইবার জাতীয় খাবারই পারে আপনার সোনাকে চনমনে রাখতে।

 

আরও পড়ুনঃ বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্য; কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null