বুলিং বা টিটকিরি কতটা ক্ষতি করছে আপনার বাচ্চার? জেনে নিন ও সতর্ক হোন!

বুলিং বা টিটকিরি কতটা ক্ষতি করছে আপনার বাচ্চার? জেনে নিন ও সতর্ক হোন!

সঞ্চারী ওর পাঁচ বছরের ছেলে রোহনকে ভর্তি করিয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। এর আগে ও কিন্ডারগার্টেনে পড়ত। ছোট্ট রোহন বরাবর‌‌‌ হাসিখুশি স্বভাবের। কখনও মা রেগে গিয়ে শাস্তি দিলেও ও কাঁদে না। স্কুলে ওর দু’জন নতুন বন্ধু হয়েছে। তাদের সঙ্গে ও টিফিন শেয়ার করে খায়। কিন্তু ইদানীং রোহন যেন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। সঞ্চারী লক্ষ করেছে, ও স্কুল যাওয়ার সময় হলেই চুপচাপ হয়ে পড়ে। টানা এক সপ্তাহ এমনটা দেখার পর ওর মনে সন্দেহ জাগে। (Ways to Help Your Child Deal With Bullying)

রোহনকে একদিন ঘুম পাড়ানোর সময় জানতে চাইল, কী হয়েছে? স্কুলে যাবার সময় মুখ গোমড়া করে থাকিস কেন? রোহন মাকে জানাল, ওকে কয়েক দিন ধরে বন্ধুরা ‘মোটা মোটা’ বলে ডাকছে। এতে ওর খারাপ লাগে। তাই ওর স্কুল যেতে ভালোই লাগে না। ওর দাবি, আর স্কুলে যাবে না, এবার থেকে নাকি মায়ের কাছেই পড়াশোনা করবে। সঞ্চারী বুঝতে পারল, ব্যাপারটা গুরুতর। তখনই ঠিক করল এ ব্যাপারে একজন মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

মনোবিদের কাছে যেতে তিনি পুরো ঘটনাটা মন দিয়ে শুনলেন। এরপর বললেন, স্কুলে ঢোকার পর দশের ভেতর চার জনই এমন আচরণের শিকার হয়। (Bullying at Preschool)। সোনামণি যত বড় হবে ততই ও এমন নানা সমস্যায় পড়বে। সে বুলিং হোক বা আর কোনও ভাবে হয়রানি! ওর সমস্যায় ওকে সাহায্য করতে হলে অভিভাবকের প্রথমেই কয়েকটি কথা মনে রাখা দরকার (Helping Kids Deal With Bullies)। এরপর তিনি সেই কথাগুলোই এক এক করে বললেন।

  • ওকে সময় দিন: প্রতিদিন স্কুলে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা খুদের ছোট্ট মনে নানারকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ওরও এমন একজন প্রয়োজন, যার সঙ্গে ও ওর মনের কথা ভাগ করে নিতে পারে। তাই যতই কাজের চাপ থাক, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় ওর জন্য রাখুন। স্কুলের কোন কোন ঘটনা ওর ভালো বা খারাপ লেগেছে, ওর থেকে জানতে চান। ছোট্ট সোনা ওর কথাগুলো বলার জন্য কাউকে না-পেলে নিজের সমস্যার কথাও ওকে মনের মধ্যে চেপে রাখতে হয়।
  • ওকে উৎসাহ দিন: কোনও বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হলে ছোট্ট সোনা সহজেই ভেঙে পড়ে বা ভয় পায়। সব বাচ্চারই এই দুর্বলতা থাকে। এটি কাটানোর জন্যই ওকে উৎসাহ দেওয়া জরুরি। ও কোনও কাজ করতে ভয় পেলে বলুন একমাত্র ও-ই পারে কাজটি ঠিক মতো করতে। কাজটি করতে গিয়ে ভুল হলে, ওকে বুঝিয়ে দিন ভুলটা কেন হল। এতে ও আরও মনোযোগ সহকারে কাজটি করবে। আপনার উৎসাহ পেলে ও জীবনের অনেক সমস্যার থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে (How to Help Your Children If They are Being Bullied)।
  • প্রশংসা করুন: ছোট্ট খোকা বা খুকু কোনও কাজে সফল হলে মনে মনে তার প্রশংসার জন্য অপেক্ষা করে। মনোবিদের কথায়, এটি শিশুমনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। খুদে তাই কোনও কাজ ভালোভাবে করলে ওকে তার জন্য প্রশংসা করুন। এতে ওর মধ্যে পজিটিভ শক্তি বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আপনার প্রশংসা পেয়ে ওর মনোবল আরেকটু বেড়ে যাবে।
  • ওর পাশে থাকুন: শুধু সমস্যার কথা শুনলেই হবে না‌। ওর সমস্যা যেন আপনারও সমস্যা, আপনার মুখে যেন ও নিজের চিন্তাই দেখতে পায়। এতে ও আপনাকে খুব কাছের মনে করবে। তা ছাড়া সমস্যার সমাধান করতে দু’জনে মিলে হাত লাগান। একা আপনি উপদেশ না-দিয়ে ও কী ভাবছে তাও জেনে নিন। এতে ওর চিন্তায় ভুল থাকলে তা শুধরে দিতে সুবিধা হবে।
    কীভাবে ছোট্ট সোনার সমস্যায় অভিভাবক সাহায্য করতে পারেন তা শুনে খুবই উপকৃত হল সঞ্চারী। এরপর মনোবিদ ছোটদের বুলি হওয়া বা টিটকিরির মুখোমুখি হওয়ার প্রসঙ্গে এলেন। সেক্ষেত্রে কী করা উচিত, বুঝিয়ে দিলেন।

বুলিং বা টিটকিরি/হয়রানির হাত থেকে বাচ্চাকে বাঁচাবেন যেভাবে (Ways to Help Your Child Deal With Bullying)

#1. ওকে শক্তি জোগান: ছোট্ট সোনাকে নিয়ে ওর বন্ধুরা মজা করলে ও সহজেই মন খারাপ করে বসে। যারা মজা করছে, তারা সংখ্যায় বেশি হলে ওর একা একা বোধও হতে পারে। তাই ওকে নিয়ে হাসাহাসির কোনও ঘটনা ঘটলে আগে ওকে মানসিক শক্তি জোগান। ও যে একা নয়, ওর মা-বাবা যে এমন সময়ে ওর পাশে রয়েছে, তা ওকে বলুন। মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেললে খুদে ডিপ্রেশড বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই মনোবিদ এই পরামর্শ দেন। (Skills for Teaching Your Child to Stand Up to Bullies)

 

আরও পড়ুন: যৌথ বা অণু পরিবার, কচি-মনের চাহিদা মেটানোই শেষ কথা!

 

#2. ভালো কথা ভাবতে বলুন: কোনও খারাপ কথা বলে ওকে নিয়ে কেউ মজা করলে ও যেন সহজে ভেঙে না-পড়ে। এই সময় ও যেন ওর ভালোগুণের কথা ভাবে। ও সুন্দর ছবি আঁকতে জানলে, ওকে মনে করিয়ে দিন ওর মতো সুন্দর ছবি কম শিশুই আঁকতে পারে। মোট কথা, কোনও ভাবেই যেন ছোট্ট খুদে মন খারাপ না-করে। এতে ওর পড়াশোনায় প্রভাব পড়তে পারে।

#3. ঠিক ভঙ্গিটি শেখান: ছোট থেকেই ওকে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শেখান। ওকে নিয়ে যখন কেউ মজা করছে, তখনও যেন ও একইভাবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। ওকে বোঝান, এতে ওর কোনও ভুল নেই। বরং যারা ওকে খারাপ কথা বলছে, তারাই আসলে না-জেনে ভুল করছে। তাই ভুল না-করলে মাথা নিচু করে কথা বলারও কোনও কারণ নেই।

#4. এড়িয়ে চলতে বলুন: সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট বন্ধুরাই এমন করে থাকে। তাই যারা ওর সঙ্গে এমন করছে, তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে বলুন (How to Empower Your Child to Keep Him Safe from Bullying)। তারা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করলে, ওকে অন্য জায়গায় গিয়ে পছন্দের জিনিসে মনোযোগ দিতে বলুন। এতে ওর মন খারাপ কেটে যাবে।

#5. ওর বন্ধুদের বোঝান: খুদের সঙ্গে যারা এমন করছে, তাদের সরাসরি বোঝাতে পারেন তারা যা করছে, তা অন্যের মনে দুঃখ দিচ্ছে। বোঝানোর সময় খেয়াল রাখুন ওরাও আপনার ছেলের মতোই। ফলে কোনও ভাবেই ওদের বকাবকি করা উচিত হবে না। (How to Deal With Bullies)

#6. ওদের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলুন: শুধু ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলাই যথেষ্ট নয়। এই বিষয়ে কথা বলুন তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। টিটকিরির সমস্যা ওদের বাবা-মাকে জানালে ওঁরাও ওঁদের ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারবেন। এতে আখেরে আপনারও সুবিধা হবে।

#7. স্কুলে জানান: ছোট্ট সোনাকে বন্ধুরা টিটকিরি মারলে ওর স্কুলেও তা জানিয়ে রাখুন। এতে স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাই আরও মনোযোগ দেবেন ওর বন্ধুদের প্রতি। তাঁরাই ওর বন্ধুদের বোঝাবেন কোনটা করা উচিত নয় বা কোনটা করা উচিত। স্কুলে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীরই নির্দিষ্ট প্রিয় টিচার থাকেন। তাই তাঁরা চেষ্টা করলে বুলির সমস্যা সহজেই মেটাতে পারে।

#8. প্রতিবাদ করতে শেখান: আপনার খুদের বদলে স্কুলে অন্য কাউকে নিয়ে হাসাহাসি হলেও তা ওর মনে সমান প্রভাব ফেলে। তাই ওকে প্রতিবাদ করতে শেখান। কোনও বন্ধুকে নিয়ে অন্যরা এমন মজা করলে বন্ধুর পাশে ওকে দাঁড়াতে বলুন। ওদেরকে বোঝাতে বলুন, বন্ধুদের মধ্যে এমন খারাপ কথা বলা উচিত নয়। এতে বন্ধুরা কষ্ট পায়। সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে বন্ধুদের সমস্যা বন্ধুদের মধ্যেই মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারে, তাও ওকে জানান।

মনোবিদের পরামর্শ পেয়ে সঞ্চারীর দৃষ্টি অনেকটাই খুলে গেল। ওঁর পরামর্শ মেনে ও সেদিনই রোহনকে ভালো করে বোঝাল। ওর কথায় রোহনও যেন অনেকটা স্বস্তি পেল। পরদিন সঞ্চারী ওর স্কুলের শিক্ষককেও সবটা জানালো। রোহন ওর মায়ের কথা মতো স্বাভাবিক থাকায় ক’দিনের মধ্যেই ওর বন্ধুরা চুপ হয়ে যায়। এরপর আর কখনই রোহনকে নিয়ে কেউ তেমন হাসিঠাট্টা করত না। (Ways to Help Your Child Deal With Bullying)

 

আরও পড়ুন: বাচ্চার শরীরের জোর নিয়ে তো সজাগ জানি, ওর মনের জোর বাড়াতে কী করছেন?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null